'ইয়ং বেঙ্গল' বা 'নব্যবঙ্গ’ নামে কারা পরিচিত | নব্যবঙ্গ আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতা পর্যালােচনা করাে।

'ইয়ং বেঙ্গল' বা ‘নব্যবঙ্গ’

উনবিংশ শতকে কলকাতার হিন্দু কলেজের অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরােজিওর (১৮০৯-৩১ খ্রি.) নেতৃত্বে বাংলায় এক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। ডিরােজিওর নেতৃত্বাধীন তরুণ গােষ্ঠী ইয়ং বেঙ্গল’ বা ‘নব্যবঙ্গ’ নামে পরিচিত। ইয়ং বেঙ্গল গােষ্ঠীর ডিরােজিওর অনুগামী সদস্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন কৃয়মােহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রামগােপাল ঘােষ, প্যারীচাঁদ মিত্র, রামতনু লাহিড়ী, দক্ষিণারঞ্জন মুখােপাধ্যায়, রসিককৃয় মল্লিক, তারাচাঁদ চক্রবর্তী, শিবচন্দ্র দেব প্রমুখ। তাদের নেতৃত্বে বাংলায় যে উগ্র সংস্কার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে তা ইয়ং বেঙ্গল মুভমেন্ট বা নব্যবঙ্গ আন্দোলন নামে পরিচিত। আর এই আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন ডিরােজিও।


ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতা


ইয়ং বেঙ্গল গােষ্ঠীর সদস্যরা যে সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন শুরু করেছিল তা ডিরােজিওর মৃত্যুর পরও সক্রিয় ছিল। কিন্তু ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের সাফল্য ছিল খুবই সামান্য। ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়। বিভিন্ন পণ্ডিত ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি, সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতার কারণ উল্লেখ করেছেন।


[1] নেতিবাচক ভাবাদর্শ: ইয়ং বেঙ্গল গােষ্ঠীর সমস্ত কর্মসূচিই ছিল নেতিবাচক। তাঁদের কোনাে গঠনমূলক কর্মসূচি ছিল না। হিন্দুধর্ম সম্পর্কে সবকিছু না জেনেই তারা এই ধর্মের বিরােধিতায় উগ্রভাবে সােচ্চার হন। অথচ পাশ্চাত্য সভ্যতা সম্পর্কেও তাঁদের কোনাে স্বচ্ছ ধারণা ছিল না। তাদের এই কালাপাহাড়ি মনােভাবের জন্য হিন্দুসমাজ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।


[2] জনসমর্থনের অভাব: ইয়ং বেঙ্গল গােষ্ঠীর সদস্যরা তাদের আন্দোলনকে সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে পারেননি। ড. সুমিত সরকার বলেছেন যে, মুষ্টিমেয় বুদ্ধিজীবী অংশ ছাড়া বাঙালি সমাজের বৃহত্তর অংশের ওপর ইয়ং বেঙ্গল মতাদর্শের কোনাে প্রভাব পড়েনি।” অভিজাত পরিবারের শহরের কিছু তরুণ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এই আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল।


[3] সামাজিক বিচ্ছিন্নতা: ইয়ং বেঙ্গল গােষ্ঠীর অনেকেই ইংরেজ কোম্পানির সহযােগী হিসেবে বিলাসবহুল জীবনযাত্রা অতিবাহিত করেন। সমাজের সাধারণ খেটে খাওয়া কৃষক শ্রমিকের সঙ্গে তাঁদের কোনাে যােগাযােগ ছিল না।


[4] উগ্রতা: ইয়ং বেঙ্গল গােষ্ঠীর সদস্যদের উগ্র ও অতি বিপ্লবী কার্যকলাপ সমাজে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল। তাই কলকাতার এলিটিস্ট সমাজে এবং পত্রপত্রিকার মধ্যেই তাদের কার্যকলাপ সীমাবদ্ধ ছিল। ঐতিহাসিক ডেভিড কফ তাঁদের ভ্রান্ত পুঁথি-পড়া বুদ্ধিজীবী বলে অভিহিত করেছেন।


[5] দরিদ্রদের প্রতি উদাসীনতা: ইয়ং বেঙ্গল গােষ্ঠী দেশের দরিদ্র কৃষক ও শ্রমিকদের দুরবস্থা ও সমস্যা সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সৃষ্ট কৃষকদের দুর্দশা এবং কুটিরশিল্প ধ্বংসের ফলে দরিদ্র সাধারণ মানুষের আর্থিক দুর্দশা থেকে মুক্ত করার কোনাে উদ্যোগ তারা গ্রহণ করেননি।


[6] মুসলিম-বিচ্ছিন্নতা: ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন শুধু হিন্দু সমাজের সংস্কার নিয়ে চিন্তাভাবনায় ব্যস্ত ছিল। মুসলিমসমাজের সংস্কার নিয়ে গােষ্ঠীর সদস্যরা কোনাে চিন্তাভাবনা করেননি।


[7] সংস্কারবিমুখতা: ডিরােজিওর মৃত্যুর পরবর্তীকালে তাঁর অনুগামীদের অনেকেই সংস্কারবিমুখ হয়ে সংস্কার কর্মসূচি থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। অনেকে সরকারি চাকরি বা ব্যাবসায় মনােযােগ দিয়ে নিজেদের সংসার জীবনে উন্নতির চেষ্টা করেন। রসিককৃয় মল্লিক, মাধবচন্দ্র মল্লিক, গােবিন্দচন্দ্র বসাক প্রমুখ ডেপুটি কালেক্টর এবং কিশােরীচাঁদ মিত্র ও শিবচন্দ্র দেব ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হন।


উপসংহার: সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারের ক্ষেত্রে ডিরােজিও ও তার অনুগামীদের উগ্র মনােভাব দেশবাসী সাদরে গ্রহণ করেনি। অনেকে তাদের 'উচ্ছঙ্খল’, 'কালাপাহাড় প্রভৃতি আখ্যা দিয়েছেন। বিভিন্ন ত্রুটিবিচ্যুতি এবং সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সমাজ ও ধর্মসংস্কারের ক্ষেত্রে তাদের আন্তরিক ও নিঃস্বার্থ উদ্যোগকে অস্বীকার করা যায় না। ড. সুমিত সরকার বলেছেন, "তারা ছিল পিতা ও সন্তানহীন একটি প্রজন্ম।"


ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার সম্পর্কে আলােচনা করাে।


পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণে ঔপনিবেশিক ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্যোগ সম্পর্কে উল্লেখ করাে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণের তাৎপর্য উল্লেখ করাে।


মধ্যবিত্ত শ্রেণি বলতে কী বােঝ? ব্রিটিশ ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সাধারণ বৈশিষ্ট্য আলােচনা করাে।