মুসলিম লিগের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে আলােচনা করাে। লিগ প্রতিষ্ঠার পর প্রথমদিকে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে লিগের সম্পর্ক কীরূপ ছিল?

মুসলিম লিগের প্রতিষ্ঠা


[1] প্রেক্ষাপট:


  • ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে সিমলায় বড়ােলাট লর্ড মিন্টোর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে মুসলিম নেতৃবৃন্দ সেখানে কিছুদিন অবস্থান করেন। এই সময় তারা একান্ত আলােচনায় উপলব্ধি করেন যে, সরকারের কাছে মুসলিমদের দাবিদাওয়া জানানাের উদ্দেশ্যে নিজেদের একটি সংগঠন গড়ে তােলা দরকার।


  • কথিত আছে যে, মুসলিম নেতৃবৃন্দ সিমলায় লর্ড মিন্টোর সঙ্গে দেখা করলে মিন্টো তাদের একটি মুসলিম সংগঠন গড়ে তােলার পরামর্শ দেন।


  • ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহর ডাকে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় একটি সর্বভারতীয় মুসলিম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এখানে ৩০ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে 'সারা ভারত মুসলিম লিগ' (All India Muslim League) গঠিত হয়। লিগের প্রথম সভাপতি নিযুক্ত হন আগা খাঁ।


[2] উদ্দেশ্য: মুসলিম লিগ প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্যগুলি ছিল

  • ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্য জ্ঞাপন।

  • মুসলিমদের অধিকার ও স্বার্থরক্ষার জন্য কাজ করা।

  • জাতীয় কংগ্রেস ও হিন্দুদের প্রভাব-প্রতিপত্তি খর্ব করা।

  • কংগ্রেস-বিরােধী অন্যান্য সংগঠনের সঙ্গে মৈত্রী প্রতিষ্ঠা করা প্রভৃতি।


[3] প্রসার: প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লিগ দ্রুত মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রধান রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। দেশের বিভিন্ন প্রদেশে এর শাখা গড়ে ওঠে। লিগের দাবির ভিত্তিতে মর্লে-মিন্টো আইনের (১৯০৯ খ্রি.) দ্বারা মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়, অর্থাৎ শুধু মুসলিমদের দ্বারাই আইনসভায় মুসলিম প্রতিনিধিদের নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে সাম্প্রদায়িক বিভেদ আরও বৃদ্ধি পায়।


ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে মুসলিম লিগের সম্পর্ক

[1] বঙ্গভঙ্গ রদ: ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ভাগ করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পৃথক পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ সৃষ্টি হলে মুসলিম সম্প্রদায় খুশি হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা তীব্র আন্দোলনের ফলে সরকার ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ রদ করে দুই বাংলা আবার যুক্ত করতে বাধ্য হয়। ফলে ঢাকা-কেন্দ্রিক পূর্ববঙ্গের মুসলিম আধিপত্যের যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল তা নষ্ট হয়ে যায়। এজন্য মুসলিম সম্প্রদায় সরকারের ওপর ক্ষুদ্ধ হয়।


[2] প্রগতিশীল নেতৃত্ব: এতদিন মুসলিম লিগে আলিগড়ের নেতাদের একাধিপত্য ছিল। প্রতিষ্ঠার কিছুকাল পর একদল প্রগতিশীল তরুণ মুসলিম নেতা মুসলিম লিগে যােগ দেন এবং নেতৃত্বের আসন গ্রহণ করেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মৌলানা মহম্মদ আলি, মৌলানা সৌকত আলি, মহম্মদ আলি জিন্না, হাকিম আজমল খান, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, হজরত মােহানী প্রমুখ। নতুন এই যুব নেতারা ঘােষণা করেন যে, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে শামিল হয়ে ভারতের স্বায়ত্তশাসন লাভই তাদের প্রধান লক্ষ্য।


[3] লক্ষ্ণৌ চুক্তি: লিগের তরুণ নেতাদের প্রচেষ্টায় হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরি হয়। এর ফলে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মধ্যে লক্ষ্ণৌ চুক্তি (১৯১৬ খ্রি.) স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে一


  • কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ যৌথভাবে সরকারের কাছে শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের দাবি জানাবে।

  • কংগ্রেসের স্বরাজ-এর আদর্শ লিগ মেনে নেবে।

  • লিগের পৃথক নির্বাচনের দাবি কংগ্রেস মেনে নেবে।

  • প্রতিটি প্রাদেশিক আইনসভায় মুসলিম সদস্যের সংখ্যা নির্দিষ্ট করা হবে।

  • কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের এক-তৃতীয়াংশ সদস্য মুসলিম হবেন। ড. বিপান চন্দ্র মনে করেন যে, লক্ষ্ণৌ চুক্তি হিন্দু মুসলিম ঐক্যের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে।


[4] খিলাফৎ আন্দোলন: প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৮ খ্রি.) তুরস্ক পরাজিত হলে ব্রিটেন তুরস্কের ব্যবচ্ছেদ এবং তুরস্কের খলিফার ক্ষমতা খর্ব করার উদ্যোগ নেয়। এতে ভারতীয় মুসলিমরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে খিলাফৎ আন্দোলন শুরু করে। কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ ঐক্যবদ্ধভাবে এই আন্দোলনে শামিল হয়।


[5] অসহযােগ আন্দোলন: গান্ধিজি ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে অহিংস অসহযােগ আন্দোলন শুরু করেন এবং স্বরাজের দাবি জানান। কংগ্রেসের এই আন্দোলন ও দাবির প্রতি মুসলিম লিগ সমর্থন জানায়। এর ফলে হিন্দু-মুসলিম সংহতি বৃদ্ধি পায় এবং সাময়িকভাবে হলেও সাম্প্রদায়িক বিভেদ হ্রাস পায়।