উনবিংশ শতকের শেষদিক থেকে ভারতে সাম্প্রদায়িকতার প্রসারের বিবরণ দাও।

সূচনা: ব্রিটিশ সরকার ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহের পর থেকে সাম্প্রদায়িক বিভেদনীতির মাধ্যমে ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলন দুর্বল করার উদ্যোগ নেয়। সরকার শাসনকার্যে বিভাজন ও শাসননীতি (Divide and Rule Policy) প্রয়ােগ করে বিভিন্ন সময়ে হিন্দু, মুসলিম বা অনগ্রসর শ্রেণিকে তােষণ করতে থাকে। এর ফলে উনবিংশ শতকের শেষদিক থেকে ভারতে সাম্প্রদায়িক বিভেদের ধারাবাহিক প্রসার ঘটে।


ভারতে সাম্প্রদায়িকতার প্রসার

[1] দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রসার: ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায় এদেশে তাদের ধর্মীয় আদর্শকে খুবই গুরুত্ব দিত। এদেশে হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রসারে যেমন কখনাে কখনাে মুসলিমবিরােধিতা লক্ষ করা যায়, তেমনি মুসলিম জাতীয়তাবাদেও হিন্দু-বিরােধিতা লক্ষ করা যায়। আলিগড় আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা স্যার সৈয়দ আহমেদ খান দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রচার করে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদের প্রাচীর গড়ে তােলেন। তিনি মুসলিম সম্প্রদায়কে বােঝাতে সচেষ্ট হন যে, হিন্দু ও মুসলিম দুটি পৃথক জাতি। এদের সুসম্পর্ক ও সহাবস্থান সম্ভব নয়। তিনি মুসলিম সম্প্রদায়কে জাতীয় কংগ্রেস ও হিন্দু সম্প্রদায় থেকে দূরে থাকতে পরামর্শ দেন।


[2] সরকারি উসকানি:


  • লর্ড ক্রসের আইনের (১৮৯২ খ্রি.) দ্বারা সরকার ভারতে সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের নীতি চালু করে।


  • কার্জনের স্বরাষ্ট্র সচিব রিজলে ঘােষণা করেন (১৯০১ খ্রি.) যে, ভারতে প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠলে উচ্চবর্গের হিন্দুদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। এজন্য তিনি বিভিন্ন ধর্মগােষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের পৃথক প্রতিনিধিত্বের সুপারিশ করেন।


  • ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ সরকারের বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা সমর্থন করায় লর্ড মিন্টো তাকে ১৪ লক্ষ টাকা সরকারি ঋণ দেন।


  • ফ্রান্সিস রবিনসন উল্লেখ করেছেন, উচ্চপদস্থ ইংরেজ আমলারা যুক্তপ্রদেশের উচ্চবর্গের মুসলমানদের স্মরণ করাতেন যে, ভারতে ইসলামের অস্তিত্ব বিপন্ন, উর্দু ভাষা আক্রান্ত, শিক্ষাব্যবস্থাকে মুসলিম সংস্কৃতির প্রভাবমুক্ত করতে হিন্দুরা সচেষ্ট ইত্যাদি। যুক্তপ্রদেশে বহু ইংরেজ আমলা মুসলিম সম্প্রদায়কে বােঝানাের চেষ্টা করে যে, হিন্দুদের আগ্রাসনে ভারতে ইসলামের ভাষা, সংস্কৃতি ও অস্তিত্ব বিপন্ন।


[3] বঙ্গভঙ্গ: সরকার বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে বাংলায় হিন্দু-মুসলিম বিভেদ সৃষ্টি করে কংগ্রেস ও ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলন ধ্বংস করার উদ্যোগ নেয়। সরকার পূর্ববঙ্গের মুসলিমদের বােঝানাের চেষ্টা করে যে, বাংলা দ্বিখণ্ডিত হলে পূর্ববঙ্গের মুসলিমদের বহু সুবিধা হবে। মুসলিম সম্প্রদায় তা বিশ্বাস করে বঙ্গভঙ্গকে সমর্থন করে। বঙ্গভঙ্গের পর পূর্ববঙ্গের লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার বামফিল্ড ফুলার ঘােষণা করেন যে, পূর্ববঙ্গে সরকারি চাকরিতে হিন্দুদের বাদ দিয়ে মুসলিমদের নিয়ােগ করা হবে।


[4] সিমলা ডেপুটেশন: মুসলিম নেতা আগা খাঁর নেতৃত্বে ৩৫ জন ধনী অভিজাত মুসলিমের একটি প্রতিনিধি দল ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে (১ অক্টোবর) সিমলায় বড়ােলাট লর্ড মিন্টোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নিজ সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষার দাবিতে একটি স্মারকলিপি পেশ করে। এটি সিমলা ডেপুটেশন নামে পরিচিত। এই স্মারকলিপিতে সরকারি চাকরিতে বেশি সংখ্যক মুসলিমদের নিয়ােগ, পরীক্ষা ছাড়া উচ্চপদে। মুসলিমদের নিয়ােগ, আইনসভায় মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা, একটি পৃথক মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় গঠন প্রভৃতি সাম্প্রদায়িক দাবি জানানাে হয়। সরকার ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনে এই দাবি কার্যকরী করে।


[5] মুসলিম লিগের প্রতিষ্ঠা: মুসলিম সম্প্রদায় তাদের রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে একটি সংস্থা গঠনের প্রয়ােজন উপলদ্ধি করে। ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহর উদ্যোগে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় সর্বভারতীয় মুসলিম অধিবেশন বসে। সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে ৩০ ডিসেম্বর সর্বভারতীয় মুসলিম লিগ প্রতিষ্ঠিত হয়।


[6] হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা: মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাও যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। দয়ানন্দ সরস্বতীর আর্যসমাজ ও শুদ্ধি আন্দোলন, তিলকের গােরক্ষা সমিতির প্রতিষ্ঠা, শিবাজি ও গণপতি উৎসবের প্রচলন, বিপিনচন্দ্র পাল ও অরবিন্দ ঘােষের হিন্দু দেবীর প্রচার প্রভৃতি মুসলিম সম্প্রদায় সুনজরে দেখেনি।


উপসংহার: ভারতে সাম্প্রদায়িকতার প্রসার এদেশের সমাজ-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যথেষ্ট কুপ্রভাব ফেলেছিল। স্বাধীনতার পরবর্তীকালেও এই প্রভাব অব্যাহত রয়েছে।