ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতের সমাজসংস্কার আন্দোলন ব্রিটিশ সরকারের নীতিকে কতটা প্রভাবিত করেছিল?

সূচনা: ভারতীয় সংস্কারকদের উদ্যোগে ছড়িয়ে-পড়া সমাজসংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ভাবধারার মুক্ত বাতাস ভারতীয় সমাজে প্রবেশ করে এই সমাজের সার্বিক অগ্রগতি ঘটিয়েছিল। এই সংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন কুসংস্কার দূর করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে।


সমাজসংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগ

[1] শিশুহত্যা রদ: ভারতীয় হিন্দুসমাজে বহু সন্তানহীনা নারী ঈশ্বরের কাছে সন্তান কামনা করে বলত যে, তার একাধিক সন্তান জন্মগ্রহণ করলে একটি সন্তানকে সে গঙ্গাসাগরে উৎসর্গ করবে। রাজপুতানা, মধ্য ও পশ্চিম ভারতের দরিদ্র রাজপুত, জাঠ ও মেওয়াট জাতির মধ্যেও শিশুকন্যাকে হত্যার কুপ্রথা প্রচলিত ছিল। সরকার ১৭৯৫ ও ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে দুটি পৃথক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে শিশুহত্যা নিষিদ্ধ করে। ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে আইন প্রণয়ন করে নববিজিত অঞ্চলগুলিতে শিশুহত্যা নিষিদ্ধ করা হয়।


[2] সতীদাহপ্রথা রদ: ভারতীয় সমাজে দীর্ঘকাল ধরে ‘সতীদাহপ্রথা’ নামে এক অমানবিক প্রথা প্রচলিত ছিল। এই প্রথা অনুসারে মৃত স্বামীর চিতায় তার জীবন্ত বিধবা স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারা হত। সরকার ১৮১২, ১৮১৫ ও ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে কয়েকটি বিধিনিষেধ ঘােষণা করে সতীদাহপ্রথা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। রাজা রামমােহন রায় সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন ও শক্তিশালী জনমত গড়ে তােলেন। শেষপর্যন্ত বড়ােলাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর এক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ করেন।


[3] বিধবাবিবাহ আইন: হিন্দুসমাজে দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের বিরুদ্ধে এবং বিধবাবিবাহের সপক্ষে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তীব্র আন্দোলন গড়ে তােলেন। রক্ষণশীল হিন্দু নেতারা বিধবাবিবাহের সপক্ষে প্রচার করলেও বিধবাবিবাহ হিন্দুশাস্ত্রসম্মত বলে বিদ্যাসাগর বিভিন্ন শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেন। শেষপর্যন্ত বড়ােলাট লর্ড ডালহৌসি ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই বিধবাবিবাহকে আইনসম্মত বলে ঘােষণা করেন।


[4] নরবলি প্রথা রদ: উড়িষ্যার খােন্দ উপজাতি তাদের চাষের জমির উর্বরতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নরবলি দিত। বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ এই নরবলি প্রথার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও তা বিশেষ সফল হয়নি। পরবর্তীকালে ১৮৪৭ ও ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে সরকারি কর্মচারীদের বিশেষ উদ্যোগে এই অমানবিক প্রথার অবসান ঘটে।


[5] সহবাস সম্মতি আইন: সহবাসের (১৮৯১ খ্রি.) ফলে দশ-এগারাে বছরের বালিকাবধূ ফুলমণির মৃত্যুর ঘটনা সারা দেশে আলােড়ন সৃষ্টি করে। এই ঘটনায় অত্যন্ত বিচলিত তৎকালীন বড়োেলাট লর্ড ল্যান্সডাউনের উদ্যোগে স্যার অ্যান্ড্রু স্কোবল 'সহবাস সম্মতি বিল' উত্থাপন করেন। এই আইনে বিবাহের সর্বনিম্ন বয়স দশ থেকে বাড়িয়ে বারাে বছর করার প্রস্তাব দেওয়া হয়।


[6] দাসত্বপ্রথা রদ: ভারতীয় সমাজে প্রাচীন কাল থেকেই দাসত্বপ্রথা প্রচলিত ছিল। বড়ােলাট লর্ড অকল্যান্ড ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে এক আইনের মাধ্যমে ভারতে দাসত্বপ্রথা নিষিদ্ধ ঘােষণা করেন।


উপসংহার: ব্রিটিশ সরকার প্রথমদিকে ভারতের সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন মনােভাব গ্রহণ করলেও শেষপর্যন্ত ভারতীয় সংস্কারকদের চাপে সেই উদাসীনতা ভঙ্গ হয়।


দক্ষিণ ভারতে সমাজসংস্কার ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে নারায়ণ গুরুর ভূমিকা আলােচনা করাে।


উনবিংশ শতকে শিখ সম্প্রদায়ে সংঘটিত বিভিন্ন সমাজসংস্কার আন্দোলনগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।


ঔপনিবেশিক শাসনকালে সমাজসংস্কার আন্দোলন ভারতীয় সমাজে কীরূপ প্রভাব ফেলেছিল?