ঊনবিংশ শতাব্দীর সামাজিক উন্মেষে স্বামী বিবেকানন্দের অবদান বিশ্লেষণ করাে।

ভূমিকা: উনবিংশ শতাব্দীর ভারতের সমাজব্যবস্থা ছিল জাতপাত, বর্ণ, ধর্মের বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল যে গুটিকয়েক সমাজসংস্কারকের প্রচেষ্টায় ভারতীয় সমাজ ধীরে ধীরে আধুনিক হয়ে উঠেছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন স্বামী বিবেকানন্দ।


সামাজিক উন্মেষে বিবেকানন্দের অবদান

[1] সমাজভাবনা: স্বামীজি অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার ত্যাগ করে সকলকে যুক্তিবাদী হয়ে ওঠার কথা বলেন। স্বামীজির স্বপ্ন ছিল সমাজে সকল শ্রেণিই একদিন একসূত্রে আবদ্ধ হবে। সমাজের দরিদ্র, অনুন্নত বা পিছিয়ে পড়া মানুষদের সামনের সারিতে নিয়ে আসার প্রয়ােজন রয়েছে। বলে তিনি মনে করতেন।


[2] জাতিভেদ প্রথার বিরােধিতা: স্বামীজি জাতিভেদ প্রথার তীব্র নিন্দা করেন। তিনি ভারতবাসীকে জাতিভেদ প্রথা ত্যাগ করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে উন্নতির জন্য উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেন। তিনি বলেন ভারতে ভবিষ্যতে আসবে শূদ্রের যুগ। শুদ্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে এক নতুন ভারত জন্ম নেবে, স্বামীজি বলেন—"নতুন ভারত বেরুক লাঙ্গল ধরে, চাষার কুটির ভেদ করে, জেলে মাল্লা-মুচি-মেথরের ঝুপড়ির মধ্যে হতে, বেরুক মুদির দোকান থেকে, ভুনাওয়ালার উনুনের পাশ থেকে, বেরুক কারখানা থেকে, হাট থেকে, বাজার থেকে, বেরুক ঝােপ জঙ্গল পাহাড়-পর্বত থেকে।"


[3] দরিদ্র ভারতবাসীর সেবা: বিবেকানন্দ বলেছেন যথার্থ দেশসেবক হতে হলে দেশবাসীকে মনে প্রাণে ভালােবাসতে হবে। আর এক্ষেত্রে সবার আগে দরিদ্র ভারতবাসীর সেবা করতে হবে। কারণ ধূলিধূসরিত, ক্ষুধার্ত দেশবাসীর মুক্তি ছাড়া ভারতের উন্নতির সম্ভবনা নেই। তাই দেশবাসীর প্রতি তিনি আহ্বান জানিয়ে বলেন—"সদর্পে বল—আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই, বল —মূখ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই।"


[4] নারীমুক্তির সমর্থক: বিবেকানন্দ সমাজে নারীদের মর্যাদাবৃদ্ধির জন্য, নারীমুক্তির গুরুত্ব অনুভব করেছিলেন। তিনি স্ত্রীশিক্ষার প্রসারকে সমর্থন করেন, কারণ তিনি মনে করেন মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার আলাে ছড়িয়ে পড়লে তারা ভালাে মন্দ বুঝতে শিখবে। তিনি বাল্য বিবাহেরও বিরােধী ছিলেন। তিনি কখনােই মনে করতেন না যে পাশ্চাত্য নারীরাই হল ভারতীয় নারীদের কাছে আদর্শস্বরূপ। আমেরিকায় থাকাকালীন এক ভাষণে তিনি বলেছিলেন—“ভারতীয় বিধবারা যথেষ্ট কর্তৃত্বশালী ও মর্যাদার অধিকারী।”


[5] সামাজিক সাম্যের প্রচারক: স্বামীজি বলেন একচেটিয়া অধিকারের দিন শেষ হয়েছে। সকলের জন্য সমান ভােগ ও সমান অধিকারের ব্যবস্থা করতে হবে। অনুন্নতদের উন্নত করে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তিনি আরও বলেন শিক্ষিত ব্যক্তিরা শিক্ষা দিয়েও ধনী ব্যক্তিরা ধন দিয়ে সেবা করলে সমাজের মঙ্গল হবে। স্বামীজি অনুন্নত শ্রেণির প্রতি বলেন কেবল উচ্চ শ্রেণির লােকেদের দোষ দিলে চলবে না। উন্নতির জন্য নিজেদেরও চেষ্টা করে যেতে হবে।


[6] সাধারণের সুখদুঃখের শরিক: স্বামীজি আসমুদ্রহিমাচল পরিভ্রমণ করে সাধারণ ভারতবাসীর সুখ দুঃখের শরিক হয়েছিলেন। ভারত পরিভ্রমণকালে তিনি ভারতীয় সমাজের দোষ, ত্রুটি, অন্যায়, অবিচারগুলি প্রত্যক্ষ করেন। পরিভ্রমণকালে ভারতীয় সমাজে রক্ষণশীলতা, জাতিভেদের সংকীর্ণতা, দারিদ্র্য, শােষণ সবকিছুই তার চোখে পড়ে। সাধারণ দরিদ্র ভারতবাসীর দুঃখমােচনের জন্য তিনি স্বাবলম্বী হওয়ার কথা বলেন।


[7] যুবসমাজের অনুপ্রেরণা: স্বামীজি ছিলেন যুবসমাজের কাছে আদর্শ। তিনি যুবকদের লৌহকঠিন পেশি, ইস্পাতকঠিন চরিত্র ও বজ্রদীপ্ত মনের অধিকারী হয়ে ওঠার কথা বলেন। সকল সামাজিক সংকীর্ণতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আহ্বান জানান যুবসমাজের প্রতি। তিনি যুবসমাজের উদ্দেশ্যে বলেন—“গীতা পাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলা ভালাে।” যুবকদের উদ্দেশ্যে স্বামীজি আরও বলেন -"ওঠো, জাগাে নিজের প্রাপ্য বুঝে নাও।"


[8] রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজসেবা: সমাজকল্যাণের আদর্শকে বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য স্বামীজি প্রতিষ্ঠা করেন রামকৃষ্ণ মিশন (১৮৯৭ খ্রি. ১ মে)। এই মিশনের বহু উদ্দেশ্যের মধ্যে অন্যতম হল জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে দুঃস্থ মানুষদের সেবা করা। আজও নির্যাতিত, অবহেলিত, শােষিত মানুষের পাশে দাঁড়নাে ও তাদের দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করার ব্রত পালন করে চলেছে রামকৃষ্ণ মিশন।


মূল্যায়ন: স্বামীজি মনে প্রাণে চেয়েছিলেন এক গোঁড়ামিমুক্ত, কুসংস্কারমুক্ত জাতপাতহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠুক। এই সমাজের পরিচালিকা শক্তি হােক, শূদ্রগণ। সমাজসংস্কারকদের প্রতি তাঁর সাবধান- বাণী ছিল—“সামাজিক ব্যধির প্রতিকার বাহিরের চেষ্টা দ্বারা হইবে না, মনের উপর কার্য করিবার চেষ্টা করিতে হইবে।”