অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি বলতে কী বােঝ? অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির শর্তগুলি কী ছিল | কোথায় অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি প্রয়ােগ করা হয়?

অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি

ভারতের সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ গভর্নর-জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি (১৭৯৮-১৮০৫ খ্রি.) তার শাসনকালে এদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটানাে ও সাম্রাজ্যের ভিত্তি সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে এক আধিপত্যকারী নীতির প্রবর্তন করেন এবং বহু দেশীয় রাজ্যকে এই নীতি গ্রহণে বাধ্য করেন। ওয়েলেসলি প্রবর্তিত এই নীতি 'অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি' বা 'বশ্যতামূলক মিত্রতা নীতি' (Subsidiary Alliances Doctrine) নামে পরিচিত।


অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির শর্তাবলি


অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি প্রসঙ্গে লর্ড ওয়েলেসলি নিজেই বলেছেন যে, দেওয়ানি লাভের পর অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি ছিল সবচেয়ে পৃথক ও উপযােগী ব্যবস্থা। অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির বিভিন্ন শর্তে বলা হয় যে一


[1] ব্রিটিশ বাহিনী নিয়ােগ: এই মিত্রতা চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশীয় রাজ্যগুলি তাদের রাজ্যে ব্রিটিশ রেসিডেন্ট বা প্রতিনিধি-সহ একদল ব্রিটিশ সেনা মােতায়েন করবে।


[2] সেনাদলের ব্যয়: দেশীয় রাজ্যগুলি নিজেদের রাজ্যে মােতায়েন করা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ব্যয়ভার নির্বাহ করবে অথবা ব্যয়ভার বহনের পরিবর্তে রাজ্যের একাংশ ব্রিটিশ সরকারকে ছেড়ে দেবে।


[3] ব্রিটিশ রেসিডেন্ট নিয়ােগ: চুক্তিতে আবদ্ধ দেশীয় রাজ্যগুলির রাজার দরবারে একজন ইংরেজ প্রতিনিধি বা রেসিডেন্ট থাকবে।


[4] রাজ্যের নিরাপত্তা: মিত্রতা চুক্তিতে আবদ্ধ দেশীয় রাজ্যগুলির নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকবে ইংরেজ কোম্পানির হাতে। ব্রিটিশ কোম্পানি মিত্র রাজ্যগুলিকে বৈদেশিক আক্রমণ ও অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে রক্ষা করবে।


[5] বিদেশনীতি: মিত্র দেশীয় রাজ্যগুলির বিদেশনীতি কোম্পানির নির্দেশে পরিচালিত হবে। অর্থাৎ মিত্র দেশীয় রাজ্যগুলি ইংরেজ কোম্পানির অনুমতি ছাড়া অন্য কোনাে শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বা কোনাে দেশীয় রাজ্যের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর বা মিত্ৰতায় আবদ্ধ হতে পারবে না।


[6] কর্মচারী নিয়ােগ: মিত্র দেশীয় রাজ্যগুলি ব্রিটিশ ছাড়া অন্য কোনাে ইউরােপীয়কে তাদের রাজ্যে কর্মচারী হিসেবে নিয়ােগ করতে পারবে না। ইতিপূর্বে নিয়ােগ হওয়া অব্রিটিশ ইউরােপের কর্মচারীদের বরখাস্ত করতে হবে।


[7] মিত্র রাজ্যগুলির বিরােধ: মিত্রতা চুক্তিতে আবদ্ধ দেশীয় রাজ্যগুলির মধ্যে কোনাে বিরােধ বাধলে ব্রিটিশ সরকারের মীমাংসা সকল মিত্রকে মেনে নিতে হবে।


[8] কোম্পানির শক্তি: ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ভারতের শ্রেষ্ঠ শক্তি হিসেবে সকল মিত্র রাজ্য মেনে নিতে বাধ্য থাকবে।


অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির প্রয়ােগ


বিভিন্ন দেশীয় রাজ্য অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এই রাজ্যগুলি হল


[1] হায়দ্রাবাদ: দেশীয় রাজ্যের রাজাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা দুর্বলচিত্ত ও ভীরু হায়দ্রাবাদের নিজাম সর্বপ্রথম ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্য জানিয়ে অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তিতে স্বাক্ষর (১৭৯৮ খ্রি.) করেন।


[2] অন্যান্য রাজ্য: নিজামের পর একে একে সুরাট (১৭৯৯ খ্রি.), তাঞ্জোর (১৮০০ খ্রি.), কর্ণাটক (১৮০১ খ্রি.), অযােধ্যা (১৮০১ খ্রি.) প্রভৃতি দেশীয় রাজ্য অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।


[3] মহীশূরে বিরােধ: মহীশূরের টিপু সুলতান অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তি গ্রহণে রাজি না হলে ইংরেজদের সঙ্গে তার সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে। চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধে টিপুর পতন ঘটে (১৭৯৯ খ্রি.)।


[4] মারাঠাদের সঙ্গে বিরােধ: মারাঠা পেশােয়া দ্বিতীয় বাজিরাও ইংরেজদের সঙ্গে বেসিনের সন্ধি সাক্ষর করে (১৮০২ খ্রি.) অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তি মেনে নেন। কিন্তু অন্যান্য মারাঠা সামন্ত রাজারা তা মানতে অস্বীকার করলে দ্বিতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সিন্ধিয়া (১৮০৩ খ্রি.), ভোসলে (১৮০৩ খ্রি.), হােলকার (১৮১৮ খ্রি.) প্রমুখ এই চুক্তি মেনে নেন।


[5] রাজপুত রাজ্যসমূহের ভূমিকা: মাল, বুন্দেলখণ্ড, উদয়পুর, যােধপুর, জয়পুর ও অন্যান্য বিভিন্ন ক্ষুদ্র রাজপুত রাজ্যগুলি ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তি গ্রহণ করে।