প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ভারতের শ্রমিক আন্দোলনের বিবরণ দাও?

বিশ শতকের গােড়ায় স্বদেশি আন্দোলনের সময় থেকে শ্রমিক আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। শ্রম-অসন্তোষকে কেন্দ্র করে এই সময় বাংলাসহ দেশের বিভিন্ন অংশে শ্রমিক ধর্মঘট শুরু হয়। এই আন্দোলনের পরিধি ছােটো হলেও সমকালীন ভারতীয় সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতিকে তা যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল।


শ্রমিক আন্দোলন

[1] সমকালীন ভারতের বিভিন্ন ঘটনার প্রভাব: কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মধ্যে স্বাক্ষরিত লক্ষ্ণৌ চুক্তি (১৯১৬ খ্রি.), তিলক ও বেসান্তের নেতৃত্বাধীন হােমরুল আন্দোলন (১৯১৬ খ্রি.) এবং জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ড (১৯১৯ খ্রি.) শ্রমিকশ্রেণিকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। ফলে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।


[2] নভেম্বর বিপ্লবের প্রভাব: লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার নভেম্বর বিপ্লবে (১৯১৭ খ্রি.) শ্রমিকশ্রেণির অসামান্য সাফল্য পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মতাে ভারতের শ্রমিকদের মধ্যেও অভূতপূর্ব আলােড়ন সৃষ্টি করে।


[3] শ্রমিকদের ওপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতে শ্রমিকদের সংখ্যা বাড়লেও তাদের মজুরি, বাসস্থান, কাজের মেয়াদ প্রভৃতি সংক্রান্ত সমস্যাগুলির কোনাে সুরাহা হয়নি। ফলে তাদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়।


[4] শ্রমিক সংগঠনগুলির ভূমিকা: শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার জন্য বি.পি ওয়াদিকার নেতৃত্বে প্রথম গড়ে ওঠে সুসঙ্গবদ্ধ মাদ্রাজ লেবার ইউনিয়ন এটি গঠন করেন সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার এবং রামানুজুলু নাইডু। ভারতের প্রথম বৃহত্তম শ্রমিক সংগঠন হল অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (All India Trade Union Congress AITUC) (১৯২০ খ্রি. ৭ জুলাই)। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সারাদেশে প্রায় ১২৫টি ট্রেড ইউনিয়ন গঠিত হয়। এগুলির প্রায় আড়াই লক্ষ শ্রমিক সদস্য নিজেদের স্বার্থরক্ষায় আন্দোলনের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করে।


[5] কংগ্রেসের ভূমিকা: জাতীয় কংগ্রেস কখনােই শ্রমিকশ্রেণিকে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জুড়ে দিতে চায়নি। গান্ধিজি নিজে শ্রমিক আন্দোলনের বিরােধী ছিলেন।


[6] কমিউনিস্টদের সহযােগিতা: শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থে, শ্রমিকশ্রেণির উন্নতিতে কমিউনিস্টরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। হেমন্ত সরকার, পি.সি. যােশি, মিরাজ কর, মুজাফফর আহমেদ, শ্রীপদ অমৃত ডাঙ্গে, সিঙ্গারাভেলু চেটিয়ার প্রমুখের নেতৃত্বে শ্রমিক আন্দোলনের প্রসার ঘটেছিল। ভারত সরকারের বার্ষিক রিপাের্টে (১৮১৮-২৯ খ্রি.) উল্লেখ রয়েছে কয়েকটি বৃহৎ শহরে শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে সাম্যবাদী প্রচার ও প্রভাব কর্তৃপক্ষের মনে যথেষ্ট উদবেগ সৃষ্টি করেছে।


শ্রমিক আন্দোলনের প্রসার


প্রথম পর্যায়: নিজেদের স্বার্থরক্ষা ও দুর্দশা লাঘবের জন্য শ্রমিকশ্রেণি ১৯ শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকেই বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে ধর্মঘটের মাধ্যমে নিজেদের দাবিগুলি তুলে ধরতে থাকে। সপ্তাহে একদিন বাধ্যতামূলক ছুটির দাবি নিয়ে বােম্বাই-এর শ্রমিকরা সংঘটিত হলে ভারত সরকার বাধ্য হয় ফ্যাক্টরি লেবার কমিশন (১৮৯০ খ্রি. ২৫ সেপ্টেম্বর) গঠন করতে। এই কমিশন শ্রমিকদের কাজের সময়সীমা এবং ছুটির বিষয়ে বেশ কয়েকটি সুপারিশ করে। এরপর ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাস থেকে সুতিবস্ত্র শিল্পে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে পর পর মােট ৩০টি ধর্মঘট সংঘটিত হয়। এর ফলে শ্রমিকদের মজুরি কিছুটা বৃদ্ধি পায়। অবশেষে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বােম্বাইয়ে এক সর্বাত্মক হরতাল সংগঠিত হয়। সুতাকলগুলি ছাড়াও এই ধর্মঘট বন্দর, রেল ওয়ার্কশপ, টাকশাল ও প্রযুক্তি শিল্পক্ষেত্রে সম্প্রসারিত হয়। শুধু তাই নয়, বােম্বাইয়ের দেখাদেখি বাংলা, বিহার আসাম ও মাদ্রাজেও ধর্মঘটের রেশ ছড়িয়ে পড়ে। বাংলার পাটকলগুলিতে ও আসামের চা বাগানে এই ধর্মঘটের প্রভাব পড়ে।


চরম পর্যায়: ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে শ্রমিক আন্দোলন চরমে পৌঁছােয়। ওই বছরে বাংলায় ৪০টি শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে ওঠে। পরবর্তী দুবছরে আরও ৩৫টি শ্রমিক ইউনিয়ন গঠিত হয়। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে কানপুরে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়। সাইমন কমিশন বিরােধী আন্দোলন (১৯২৭ খ্রি.)-কে কেন্দ্র করে শ্রমিকশ্রেণি আবার উত্তাল হয়ে ওঠে। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের ১ মে বােম্বাইয়ে শ্রমিকরা মে দিবস পালন করে তাদের আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের পর্যায়ে উন্নীত করে।


ব্রিটিশের দমননীতি


শ্রমিক আন্দোলন থামাতে ব্রিটিশ সরকার একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে।


[1] হুইটলি কমিশন (১৯২৯ খ্রি.) গঠন: সরকার শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতির জন্য হুইটলি কমিশন গঠন করে। বােঝাতে চায় যে, জাতীয় নেতাদের থেকে সরকার শ্রমিকদের উন্নয়নের জন্য বেশি চিন্তিত।


[2] শিল্পবিরােধ ও জন নিরাপত্তা বিল: বড়ােলাট লর্ড আরউইন কেন্দ্রীয় আইনসভার আপত্তি অমান্য করে শিল্পবিরােধ বিল পাস করে শ্রমিকদের ধর্মঘট বেআইনি ঘােষণা করেন ও জননিরাপত্তা বিল পাসের মাধ্যমে কমিউনিস্টদের দমন করার চেষ্টা করেন।


[3] মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা: শ্রমিক আন্দোলনকে ধ্বংস করে দেওয়ার লক্ষ্যে মুজাফফ আহমেদ, মিরাজকর, পি.সি. যােশি, গঙ্গাধর অধিকারী, শিবনাথ ব্যানার্জী, শ্রীপদ অমৃত ডাঙ্গে, মকবুল হুদা এবং দুজন ব্রিটিশ কমিউনিস্ট ফিলিপ স্প্র্যাট ও বেনজামিন ব্রাডলিসহ ৩৩ জন শ্রমিক নেতাকে ব্রিটিশ সরকার গ্রেফতার করে। রাজশক্তির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মিথ্যা মামলায় তাদের অভিযুক্ত করলে, শুরু হয় মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা।


উপসংহার: ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের জোয়ারে শ্রমিকরা যেমন শক্তিশালী হয়েছে অপরদিকে শ্রমিক আন্দোলনগুলিও বিশ শতকে ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের মূলধারাকে গতিশীল করে।