বিদেশে নিযুক্ত ভারতীয় ও চিনা চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের অবস্থা কেমন ছিল?

সূচনা: আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর থেকে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি ভারত ও চিনের বহু শ্রমিককে আফ্রিকা ও অন্যান্য স্থানের উপনিবেশগুলির বিভিন্ন কাজে প্রেরণ করে। শ্রমিকরা বিদেশে ৫ থেকে ৮ বছর মেয়াদের কাজের জন্য চুক্তিতে স্বাক্ষর করত। বিদেশে কর্মরত চুক্তিবদ্ধ ভারতীয় ও চিনা শ্রমিকদের অবস্থা ছিল খুবই শােচনীয়।


বিদেশে নিযুক্ত ভারতীয় ও চিনা চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের অবস্থা

[1] চুক্তিভঙ্গ: ভারত ও চিনের শ্রমিকদের বিদেশে পাঠানাের আগে বিভিন্ন আকর্ষণীয় শর্তে, যেমন বহু শ্রমিককে ভালাে বেতন, আরামদায়ক কাজে নিয়ােগ, মাত্র তিন বছরের জন্য কাজে নিয়ােগ প্রভৃতি দ্বারা আকৃষ্ট করে তাদের সঙ্গে এজেন্ট বা মালিকপক্ষ চুক্তি স্বাক্ষর করত। কিন্তু পরবর্তীকালে সেসব চুক্তির অধিকাংশ শর্তই মালিকপক্ষ পালন বা রক্ষা করত না। চুক্তি লঙ্ঘন করে তারা শ্রমিকদের নানাভাবে বঞ্চিত করত এবং তাদের ওপর সীমাহীন শােষণ ও নির্যাতন চালাত।


[2] অবহেলা: শ্রমিক সংগ্রহের এজেন্ট ও শ্রমিকদের প্রভুরা ভারত ও চিনের চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের অবহেলা করত। প্রভুরা কখনাে কখনাে শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন ও অত্যাচার চালাত। এজেন্টরা যতটা তাগিদ নিয়ে শ্রমিকদের বিদেশে পাঠাত, ততটা তাগিদ নিয়ে তাদের ফিরিয়ে আনত না। ফলে ফেরার সময় বহু শ্রমিক চূড়ান্ত দুর্দশার শিকার হত।


[3] অমর্যাদা: চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকরা বিদেশে নানা অমর্যাদার শিকার হত। সরকারি নথিপত্রে ভারত থেকে পাঠানাে শ্রমিকদের সাধাশভাবে 'কুলি' বলে চিহ্নিত করা হত। এর দ্বারা শ্রমিকদের প্রতি বিদেশিদের অমর্যাদাপূর্ণ ব্যবহার প্রকাশ পেত। কেন-না, 'কুলি' বলতে বুঝায় যার জন্মবৃত্তান্তে ত্রুটি রয়েছে। ক্রীতদাস প্রথার অবসান ঘটলেও চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক সৃষ্টির মাধ্যমে ইউরােপের ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি ঘুরপথে আবার ক্রীতদাস প্রথাকে ফিরিয়ে আনে।


[4] অভাব-অনটন: বিদেশে ভারত ও চিনের শ্রমিকরা খুবই সামান্য মজুরিতে কাজ করত। প্রচুর পরিশ্রম করেও তাদের পর্যাপ্ত খাবার ও প্রয়ােজনীয় পােশাক জুটত না। তারা বিদেশে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করতে বাধ্য হত। দুর্বিষহ জীবন থেকে মুক্তির জন্য বহু শ্রমিক পালিয়ে দেশে ফেরার চেষ্টা করত। কিন্তু ধরা পরে বহু শ্রমিক জেলে আবদ্ধ হত।


[5] পারিবারিক জীবনে ভাঙন: চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকরা নির্দিষ্ট মেয়াদ পূরণ হওয়ার পর দেশে ফেরার আশা নিয়ে কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশে পাড়ি দিত। কিন্তু মেয়াদ পূরণের পর অনেকেই আর দেশে ফিরতে পারত না। অনেকে বিদেশেই মারা যেত। এর ফলে বহু শ্রমিকের পারিবারিক জীবন ভেঙে যেত এবং তার পরিবারের সদস্যরা সীমাহীন দুঃখদুর্দশার শিকার হত।


[6] মৃত্যু: সমুদ্রপথে বিদেশে যাত্রাকালে এবং বিদেশের নতুন স্থানের নতুন প্রতিকূল আবহাওয়ায় প্রচুর শ্রমিকের মৃত্যু হত। নতুন দেশে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ ও বসবাসের ফলে শ্রমিকরা নানা রােগের শিকার হত। তারা সঠিক চিকিৎসাও পেত না। ফলে ডাইরিয়ার মতাে রােগে প্রচুর শ্রমিকের মৃত্যু হত।


উপসংহার: শ্রমিকদের দুরবস্থা ও মৃত্যুর ঘটনা প্রতিরােধ করে তাদের কল্যাণসাধনের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। সরকার ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে এবিষয়ে একটি আইন (Act No. XIX of 1856) পাস করে। এই আইনে বলা হয় যে, চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের নিরাপত্তার উপযুক্ত ব্যবস্থা না করে তাদের বিদেশে পাঠানাে যাবে না। এ ছাড়া মেয়াদ শেষে দেশে ফিরে আসার স্বপ্ন নিয়ে শ্রমিকরা বিদেশে পাড়ি দিলেও পরবর্তীকালে কোনাে কোনাে শ্রমিক স্বেচ্ছায় চিরকালের মতাে বিদেশেই থেকে যায়। ট্রিনিদাদের। মতাে কোনাে কোনাে সরকার তাদের দেশে ভারতীয় শ্রমিকদের বসবাসের সুযােগ করে দেয়। ফলে ওইসব উপনিবেশে ভারতীয়দের ছােটো ছােটো বসতি গড়ে ওঠে।


ঔপনিবেশিক শক্তির উদ্যোগে বিদেশে পাঠানাে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য। চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের বিদেশে প্রেরণের কারণ কী ছিল?


ভারত থেকে বিদেশে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক প্রেরণ সম্পর্কে আলােচনা করাে।


চিন থেকে বিদেশে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক প্রেরণ সম্পর্কে আলােচনা করাে।