উড-এর ডেসপ্যাচের বৈশিষ্ট্য ও সুপারিশগুলি লেখাে।

উড-এর ডেসপ্যাচের বৈশিষ্ট্যসমূহ

1813 খ্রিস্টাব্দের চার্টার অ্যাক্টে ভারতীয় জনগণের শিক্ষার বিস্তারের জন্য কোম্পানির তহবিল থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা করা হলেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পরিচালিত সরকার শিক্ষাকে সঠিক অর্থে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে মেনে নেয়নি। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে ধীরে ধীরে অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ালেও, কোনাে সুনির্দিষ্ট নীতি অনুসরণ করে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হয়নি। উড-এর ডেসপ্যাচেই সর্বপ্রথম একটি সুসংগঠিত সরকারি শিক্ষানীতির আভাস পাওয়া যায়।


উড-এর ডেসপ্যাচের সুপারিশসমূহ


আগামী দিনে শিক্ষাকে কীভাবে সংগঠিত করা হবে, শিক্ষাক্ষেত্রে উদ্ভূত বিভিন্ন সমস্যার সমাধান কীভাবে করা হবে—সে বিষয়ে উড-এর ডেসপ্যাচে কতকগুলি সুপারিশ লিপিবদ্ধ করা হয়। এখানে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সুপারিশ উল্লেখ করা হল


(1) শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য: ডেসপ্যাচের প্রস্তাবনায় বলা হয়


  • ভারতীয় জনগণের মধ্যে পাশ্চাত্য জ্ঞানের বিস্তার ঘটানােই হল এদেশের শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য। এই পাশ্চাত্যজ্ঞান হবে ভারতের জনগণের কাছে আশীর্বাদস্বরূপ।


  • এই শিক্ষার অপর একটি উদ্দেশ্য হবে, ভারতের জনগণের বুদ্ধির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তাদের নৈতিক চরিত্রগঠনের সহায়ক হয়ে ওঠা।


  • এই শিক্ষা ভারতের জনগণকে শ্রম ও পুঁজি বিনিয়ােগের ফলাফল বুঝতে এবং দেশজ প্রাকৃতিক সম্পদের অর্থনৈতিক গুরুত্ব উপলব্ধি করতে সাহায্য করবে। এই শিক্ষার বিকাশ ঘটলে কোম্পানি আগামী দিনে ভারতবাসীর মধ্য থেকে দক্ষ ও বিশ্বস্ত কর্মী পাবে।


  • এই শিক্ষার আর একটি উদ্দেশ্য হবে—ভারত থেকে। কাঁচামাল সংগ্রহ করে ইংল্যান্ডের শিল্পের বিকাশ ঘটানাে এবং ভারতবাসীর মানসিকতাকে এরকমভাবে গড়ে তােলা যাতে ভারতের বাজারে ইংল্যান্ডে উৎপন্ন পণ্যসামগ্রীর অফুরন্ত চাহিদা সৃষ্টি হয়।


সব মিলিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যের জন্য‌ একটি নির্দিষ্ট বাজার সৃষ্টি করাকে ভারতীয় শিক্ষার একটি বিশেষ লক্ষ্য হিসেবে স্থির করা হয়েছিল৷


(2) শিক্ষার বিষয়বস্তু: উড-এর ডেসপ্যাচে প্রাচ্যশিক্ষার গুরুত্বকে স্বীকার করা হলেও, বলা হয়েছে প্রাচ্য বিজ্ঞান ও দর্শন অজস্র ভুলে ভরা। তাই প্রাচ্য বিজ্ঞান ও দর্শনের পরিবর্তে পাশ্চাত্য কলা, বিজ্ঞান, দর্শন ও সাহিত্যই হবে ভারতবাসীর কাছে শিক্ষার বিষয়বস্তু।


(3) শিক্ষার মাধ্যম ও ভাষাশিক্ষা: উড-এর ডেসপ্যাচে শিক্ষার মাধ্যম এবং ভাষাশিক্ষা বিষয়ে অত্যন্ত মূল্যবান নির্দেশ দান করা হয়। ভারতীয় জনগণ যাতে ইউরােপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে ইংরেজি ও দেশীয় ভাষা উভয়ই ব্যবহার করতে পারে—সে প্রসঙ্গে ডেসপ্যাচে নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।


(4) শিক্ষা বিভাগ স্থাপন: উড-এর ডেসপ্যাচে কোম্পানির অন্তর্ভুক্ত পাঁচটি প্রদেশে একটি করে সরকারি শিক্ষা বিভাগ স্থাপনের সুপারিশ করা হয়। ওই পাঁচটি প্রদেশ হলবাংলা, বােম্বাই, মাদ্রাজ, পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ। সুপারিশে আরও উল্লেখ করা হয়—ওই শিক্ষা বিভাগগুলির প্রধান 56717- Director of Public Instruction, সংক্ষেপে DPI। DPI-কে সাহায্য করার জন্য তার অধীনে একদল পরিদর্শক (Inspectors) নিযুক্ত থাকবেন। এই বিভাগ প্রত্যেক প্রদেশের শিক্ষার অগ্রগতি সম্পর্কে প্রাদেশিক সরকারের নিকট বার্ষিক প্রতিবেদন পেশ করবেন।


বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন: উড-এর ডেসপ্যাচে দ্বিতীয় প্রস্তাব হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের গুরুত্বকে তুলে ধরা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শে স্থাপিত হবে। কলকাতা, বােম্বাই এবং মাদ্রাজে একটা করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে।ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন একজন আচার্য, একজন উপাচার্য এবং কয়েকজন সরকার মনােনীত সদস্যের দ্বারা গঠিত 'সিনেট'।


(5) স্তরবিন্যাস শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন: উড-এর ডেসপ্যাচে স্তরবিন্যস্ত শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের সুপারিশও করা হয়। এই সুপারিশে বলা হয় স্তরবিন্যস্ত শিক্ষাব্যবস্থার চূড়ায় থাকবে বিশ্ববিদ্যালয় ও তার অধীনস্থ মহাবিদ্যালয়সমূহ, মাঝে থাকবে হাইস্কুল শিক্ষা তথা মাধ্যমিক শিক্ষা এবং সর্বনিম্ন স্তরে থাকবে প্রাথমিক শিক্ষা।


(6) চুঁইয়ে পড়া নীতির সমালোচনা ও জনশিক্ষার দায়িত্বগ্রহণ: উড-এর ডেসপ্যাচে শিক্ষার চুঁইয়ে পড়া নীতির গভীর সমালােচনা করা হয় এবং সরকার যাতে অধিক পরিমাণে জনশিক্ষা প্রসারের দায়িত্ব গ্রহণ করে, সে বিষয়ে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মাধ্যম হিসেবে ইংরেজিকে প্রাধান্য দেওয়া হলেও মাতৃভাষার প্রয়ােজনীয়তা ও গুরুত্বকে স্বীকার করা হয়। পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে ইংরেজির পাশাপাশি মাতৃভাষার সাহায্য গ্রহণের সুপারিশ করা হয়।


(7) শর্তসাপেক্ষে অর্থ সাহায্যের ব্যবস্থা: উড-এর ডেসপ্যাচে বেসরকারি বিদ্যালয়সমূহকে উৎসাহদানের উদ্দেশ্যে শর্তসাপেক্ষে 'grant-in-aid' প্রথা প্রবর্তনের সুপারিশ করা হয়। বলা হয়, অর্থ সাহায্য নিতে আগ্রহী বিদ্যালয়গুলিকে নিম্নলিখিত শর্তগুলি মেনে চলতে হবে


  • বিদ্যালয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে।

  • বিদ্যালয়ের পরিচালন কমিটি আইনানুগভাবে নির্বাচিত হবে।

  • বিদ্যালয় পরিদর্শকের নির্দেশানুসারে বিদ্যালয়ের কাজ চালাতে হবে।

  • বিদ্যালয় ছাত্রদের কাছ থেকে সামান্য পরিমাণ হলেও বেতন আদায় করবে।

  • শিক্ষকদের শিক্ষাগত যােগ্যতা, শিক্ষার মান ও ফলাফল উন্নত করতে হবে।


(8) শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা: উড তাঁর ডেসপ্যাচে এদেশের শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের জন্য নর্মাল স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং প্রশিক্ষণ গ্রহণ কালে তাদের বৃত্তিদানের সুপারিশ করেন।


(9) বৃত্তি শিক্ষার ব্যবস্থা: উড-এর ডেসপ্যাচে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি আইন, চিকিৎসাশাস্ত্র, কারিগরি ও প্রযুক্তিবিদ্যা প্রভৃতি বৃত্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলনের সুপারিশ করা হয়।


(10) স্ত্রীশিক্ষার প্রসার: উড-এর ডেসপ্যাচে অধিক সংখ্যায় বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করা হয়। বালিকাদের চারিত্রিক মাধুর্য ও ব্যক্তিত্বের বিকাশের উপযােগী পৃথক পাঠক্রম প্রণয়নের কথাও বলা হয়।


(11) সংখ্যালঘুদের শিক্ষা: মুসলমান রাজশক্তিকে পরাস্ত করে, ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাই এদেশে মুসলমান সম্প্রদায়ের ইংরেজ-বিদ্বেষ ছিল প্রবল। এই বিদ্বেষের কারণে মুসলমানরা ইংরেজ-প্রবর্তিত শিক্ষায় কোনাে আগ্রহ প্রকাশ করেনি। ফলে তারা আধুনিক শিক্ষার দিক থেকে অনেকখানি পিছিয়ে পড়েছিল। এই অবস্থার উন্নতি ঘটানাের জন্য উড-এর ডেসপ্যাচে মুসলমানদের জন্য পৃথক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তােলার সুপারিশ করা হয়।


(12) পাঠ্যপুস্তক রচনা: উড-এর ডেসপ্যাচে, প্রাথমিক স্তরে এবং আংশিকভাবে মাধ্যমিক স্তরে মাতৃভাষার মাধ্যমে পঠনপাঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়। ভারতে শিক্ষার বিষয়বস্তু হিসেবে পাশ্চাত্য দর্শন ও বিজ্ঞানকে নির্বাচন করা হয়। তাই শিক্ষার্থীদের কাছে সহজে পৌঁছােনাের জন্য উড-এর ডেসপ্যাচে পাশ্চাত্য দর্শন ও বিজ্ঞান-এর ইংরেজিতে লেখা বইগুলিকে দেশীয় ভাষায় অনুবাদের জন্য সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়।


মধ্যযুগে ভারতের নারীশিক্ষা কেমন ছিল—সে সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখাে।


মধ্যযুগে হিন্দুশিক্ষা কেমন ছিল-সে সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখাে।


ইসলামিক শিক্ষা ব্যবস্থায় মক্তবের ভূমিকা আলোচনা করাে।


ইসলামিক শিক্ষাব্যবস্থায় মাদ্রাসার ভূমিকা লেখাে।


1813 খ্রিস্টাব্দের চাটার অ্যাক্টের পটভূমি লেখাে। ওই অ্যাক্টের শিক্ষা বিষয়ক এবং মিশনারি- সংক্রান্ত ধারা দুটি লেখাে। ওই ধারা দুটি কতটা কার্যকরী হয়েছিল?


1813 খ্রিস্টাব্দের চার্টার অ্যাক্টের বিষয়বস্তু আলােচনায় প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদীদের মতামত লেখাে। ওই চার্টার অ্যাক্টের গুরুত্ব ও তাৎপর্য লেখাে।


উড-এর ডেসপ্যাচের পটভূমি আলােচনা করাে।