মাটি সৃষ্টিতে নিষ্ক্রিয় বা পরােক্ষ উপাদানগুলির ভূমিকা সম্বন্ধে আলােচনা করাে।

মাটি সৃষ্টিতে নিষ্ক্রিয় উপাদানের ভূমিকা

মাটির উৎপত্তি ঘটে কতকগুলি নিষ্ক্রিয় ও সক্রিয় উপাদানের কার্যের ফলে। নিষ্ক্রিয় উপাদানগুলি হল- [1] জনক বা আদি শিলা, [2] ভূপ্রকৃতি এবং [3] সময়। মাটি সৃষ্টি এবং এর ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম গঠনে এইসব উপাদানের প্রভাব আলােচনা করা হল一


[1] জনক বা আদি শিলা : মাটির দেহ গঠন করতে যে পদার্থ সবচেয়ে বেশি পরিমাণে লাগে তার উৎসকে মূল উপাদান বলে। সাধারণত গ্র্যানাইট, নিস, অ্যান্ডেসাইট, ডাইওরাইট, ব্যাসল্ট, ডলেরাইট, চুনাপাথর ও সঞ্চিত বালি ইত্যাদি মূল উপাদান হিসেবে বা জনক শিলারূপে কাজ করে। জনক শিলা মাটি গঠনে যে যে প্রভাব ফেলে তা হল


  • মৃত্তিকার মূল উপাদান দ্বারা মৃত্তিকার ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম, যেমন গ্রথন, কাঠামাে, জল ধারণক্ষমতা, বর্ণ, pH-এর মান প্রভৃতি নিয়ন্ত্রিত হয়। এজন্য বিভিন্ন শিলায় বিভিন্ন ধরনের মাটি গঠিত হতে দেখা যায়। যেমন- (i) গ্রানাইট ও নিস্ শিলায় ফেলপারের পরিমাণ বেশি থাকলে কাদামাটি সৃষ্টি হয়। কাদামাটি বেশি হলে তা মাটির বিভিন্ন ধরনের কাঠামাে গঠনে সাহায্য করে। (ii) ব্যাসল্ট শিলা থেকে কৃয় মৃত্তিকা, ল্যাটেরাইট ও লাল মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়। (iii) চুনাপাথর ও মারবেল থেকে রেনজিনা মাটি এবং সিলিকা-সমৃদ্ধ শিলা থেকে পডসল মাটি গড়ে ওঠে।

  • আদি শিলার প্রভাব সর্বাধিক হলে এন্ডেডায়নামােমরিফক মাটির উৎপত্তি হয়। যেমন—লিথােসল, রেগােসল ও অ্যালুভিয়াম।

  • খনিজ লবণ, চুনাপাথর ও কোয়ার্টজসমৃদ্ধ মাটির রং সাদা, ধূসর ও কখনাে কখনাে জলপাই রঙের হয়।

  • আদি শিলা পেরিডােটাইট ও সারপেনটাইন হলে মাটি ক্ষারধর্মী হয়।

  • আদি শিলায় চুনের পরিমাণ বেশি থাকলে মাটি শক্ত গঠনের হয়।

  • কখনাে কখনাে আদি শিলায় গঠিত মাটি অন্যত্র পরিবাহিত হয়ে পলিমাটি অর্থাৎ পরিবাহিত মাটি গঠন করে। যদি মাটি আদি শিলার ওপর অবস্থান করে তখন তা স্থিতিশীল মাটি হয়।


[2] ভূপ্রকৃতি : ভূমির ঢাল, ঢালের অবস্থান, জলনিকাশি ব্যবস্থা ইত্যাদি মাটি গঠনে যে-যে প্রভাব ফেলে তা হল


  • পার্বত্য ভূপ্রকৃতিতে মাটি গঠনে জনক শিলার প্রভাব বেশি। ভূমির ঢাল বেশি হওয়ায় চূর্ণীকৃত পদার্থ সহজেই অপসারিত হয় বলে মাটির স্তর গঠন বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে, মাটি অপরিণত বা নবীন অবস্থায় থাকে। এই ধরনের নবীন মাটির সঙ্গে বড়াে বড়াে পাথর, শিলাখণ্ড, বােল্ডার ইত্যাদি মিশে যে মাটির সৃষ্টি হয় তাকে কঙ্কালসার (Skeletal) মাটি বলে।


  • উপত্যকার উচ্চ অংশ থেকে নিম্ন অংশ পর্যন্ত মৃত্তিকার পরিলেখের পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। একে মাটির ক্যাটেনা বলে। উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে উত্তম জলনিকাশি ব্যবস্থা থাকায় মৃত্তিকার রং লালচে হয়ে থাকে। মধ্যভাগে জলনিকাশি ব্যবস্থা মাঝারি হওয়ায় মৃত্তিকার রং হলদে হয় এবং নিম্নাংশে জলনিকাশি ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় মৃত্তিকা সবুজাভ ধূসর, নীলচে ধূসর থেকে স্বাভাবিক ধূসর রঙের হয়।


  • পার্বত্য অঞ্চলে বিভিন্ন উচ্চতায় বিভিন্ন ধরনের জলবায়ু বিরাজ করায় নানা ধরনের মৃত্তিকা গঠিত হয়।


  • উত্তর গােলার্ধে পর্বতের দক্ষিণমুখী ঢাল অধিকতর উয়, আলােকিত ও আর্দ্র থাকে। এখানে ক্ষারধর্মী চুনময় মাটি সৃষ্টি হয়। দক্ষিণ গােলার্ধে এর বিপরীত অবস্থা লক্ষ করা যায় এবং আম্লিক মাটি সৃষ্টি হয়।


  • ভূমির ঢাল অবতল হলে, মৃত্তিকা সঞ্চয়ের উপযােগী পরিবেশ গড়ে ওঠে। আবার ওই ঢাল উত্তল হলে ক্ষয়কার্যের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ভূমির একই ঢালে উত্তল ও অবতল অংশে ভিন্ন প্রকৃতির মৃত্তিকা গড়ে ওঠে। একই ঢালের উর্ধ্বাংশে মৃত্তিকার ক্ষয় বেশি ও জৈব পদার্থের সঞ্চয় কম হয়। কিন্তু নিম্নাংশে মৃত্তিকার গভীরতা ও জৈব পদার্থের সঞ্চয় বেশি হয়।


  • খাড়া ঢালযুক্ত ভূমিভাগে ক্ষয়কার্য বেশি এবং অনুস্রাবণ অপেক্ষা পৃষ্ঠপ্রবাহ বেশি হওয়ায় ভূমিভাগ উদ্ভিদহীন হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে মৃত্তিকা অগভীর হয় এবং বোল্ডার, নুড়ি, পাথর, কাঁকর, বালি ইত্যাদিতে পরিপূর্ণ থাকে।


[3] সময় : মৃত্তিকা গঠনে সময়ের ভূমিকা সঠিকভাবে নির্ণয় করা মুশকিল হলেও দেখা গেছে যে


  • অপ্রবেশ্য পদার্থ অপেক্ষা বেলেপাথরের ন্যায় প্রবেশ্য পদার্থে মৃত্তিকা গঠন দ্রুতগতিতে সংঘটিত হয়। হিমবাহ সঞ্চয়ের (Tills) ওপর মৃত্তিকা গঠিত হতে কয়েকশাে বছর লেগে যায় এবং ভারী ব্যাসল্টের ওপর মৃত্তিকার গঠন হতে আরও অনেক বেশি সময় লাগে।


  • মূল উপকরণ থেকে মৃত্তিকা সৃষ্টি হতে দীর্ঘ সময় লাগে। 2 থেকে 2.5 সেমি মৃত্তিকা সৃষ্টি হতে কয়েকশাে বছর লেগে যায়। মৃত্তিকা গঠনের জন্য যে দীর্ঘ সময় লাগে, তা নির্ভর করে আবহাওয়ার বিভিন্ন উপাদান, ভূসংস্থান (Landform), আণুবীক্ষণিক জীব প্রভৃতি কতকগুলি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বিষয়ের ওপর।


  • মৃত্তিকা সৃষ্টির প্রথম পর্যায়ে অপরিণত মৃত্তিকাতে মূল উপাদানের চরিত্র প্রকট হয়। অপরিণত মৃত্তিকাতে স্তরায়ণ (Horizon) সুস্পষ্ট নয়।


  • মাটি দীর্ঘ সময় ধরে গঠিত হলে পরিণত অবস্থায় আসে। অনুকূল পরিবেশে মৃত্তিকা পরিণত অবস্থায় পৌঁছাতে সময় লাগে কয়েকশাে বছর। কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশে মৃত্তিকার পরিণত অবস্থায় পৌঁছাতে সময় লাগে কয়েক হাজার বছর। পরিণত মৃত্তিকাতে স্তর সুস্পষ্টভাবে লক্ষ করা যায়।


  • কালক্রমে নবীন মৃত্তিকা পরিণত মৃত্তিকাতে রূপান্তরিত হয় এবং পরিণত মৃত্তিকা ক্ষয়ের কবলে পড়ে।