দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থায় অব-উপনিবেশীকরণের কী প্রভাব লক্ষ করা যায়?

সূচনা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের (১৯৪৫ খ্রি.) কিছুকাল পর অত্যন্ত দ্রুতগতিতে অব-উপনিবেশীকরণ শুরু হয়। তখন থেকে শুরু করে ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ সব উপনিবেশ তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের অধীনতা ছিন্ন করে স্বাধীনতা লাভে সক্ষম হয়।


অব-উপনিবেশীকরণের প্রভাব

[1] সংকট: শক্তিশালী ঔপনিবেশিক প্রভুর অধীনতা ছিন্ন করে উপনিবেশগুলি স্বাধীনতা লাভ করলেও সদ্য-স্বাধীন অধিকাংশ রাষ্ট্রই নানা সংকটের বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল। এসব রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক সংকট, দারিদ্র্য, গােষ্ঠীদ্বন্দ্ব অত্যন্ত তীব্র আকার ধারণ করেছিল। তাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থাও ছিল অত্যন্ত ভঙ্গুর। ফলে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হলেও সেসব দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি।


[2] বৃহৎ শক্তিদ্বয়ের তৎপরতা: অব-উপনিবেশীকরণের ফলে বিভিন্ন উপনিবেশ থেকে ব্রিটেন, ফ্রান্স, হল্যান্ড, পাের্তুগাল প্রভৃতি ইউরােপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির আধিপত্য ধ্বংস হয়। সেই সুযােগে বিশ্বের দুই বৃহৎ শক্তি আমেরিকা ও রাশিয়া সদ্য-স্বাধীন সেসব দেশে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে এগিয়ে আসে।


[3] দিগন্তের প্রসার: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দ্রুত অব-উপনিবেশীকরণের ফলে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বহু দেশ স্বাধীনতা লাভ করলে এসব দেশের মধ্যে আর্ন্তজাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন আদানপ্রদান শুরু হয়। ফলে এই সময় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দিগন্তের ব্যাপক প্রসার ঘটে।


[4] সাম্রাজ্যবাদী নীতির সংকট: বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ব্যাপক হারে অব-উপনিবেশীকরণের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সাম্রাজ্যবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের দোসর বর্ণবৈষম্যবাদ, জাতিবিদ্বেষ প্রভৃতি নীতি সংকটের মুখে পড়ে। এসব নীতিকে সদ্য-স্বাধীন আফ্রো- এশীয় দেশগুলি ঘৃণার চোখে দেখে এর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প নেয়। এর ফলে বিশ্ব থেকে সাম্রাজ্যবাদ ও বর্ণবৈষম্য নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন আরও প্রবল হয়।


[5] ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রসার: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সদ্য-স্বাধীন দেশগুলিতে একদিকে রাশিয়া সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার প্রসার ঘটিয়ে নিজের আধিপত্য বৃদ্ধির চেষ্টা চালায়। অন্যদিকে আমেরিকা এসব দেশে পুঁজিবাদের প্রসার ঘটিয়ে সেসব দেশে নিজের আধিপত্যের প্রসার ঘটাতে চায়। বৃহত্তর শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের উদ্দেশ্যে সদ্য-স্বাধীন দেশগুলি রাশিয়া ও আমেরিকার ঠান্ডা লড়াইয়ের কেন্দ্রে পরিণত হয়।


[6] জাতিপুঞ্জের গুরুত্ব: ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত সদ্য-স্বাধীন দেশগুলি সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের কর্মকাণ্ডের প্রতি আন্তরিক সমর্থন জানিয়ে দলে দলে জাতিপুঞ্জের সদস্যপদ গ্রহণ করে। তারা জাতিপুঞ্জের সহায়তায় নিজেদের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করে। তাদের সহযােগিতায় জাতিপুঞ্জের পক্ষেও বিশ্বের উপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে সক্রিয় কর্মসূচি গ্রহণ করা সহজ হয়। এর ফলে জাতিপুঞ্জের কর্মপরিধি ও গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে জাতিপুঞ্জের মােট ১৭৯টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে অন্তত ১০০টি সদস্যই ছিল সদ্য-স্বাধীন রাষ্ট্র।


[7] নতুন আন্তর্জাতিক সংকট: ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত সদ্য-স্বাধীন রাষ্ট্রগুলিকে কেন্দ্র করে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নতুন নতুন আন্তর্জাতিক সংকট তৈরি হয়। সদ্য-স্বাধীন বিভিন্ন দেশ আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এরূপ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংকট হল কোরিয়ার যুদ্ধ (১৯৫০-৫৩ খ্রি.), ভিয়েতনামের যুদ্ধ (১৯৫৬-১৯৭৫ খ্রি.), ভারত-চিন যুদ্ধ (১৯৬২ খ্রি.), ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ (১৯৬৫, ১৯৭১ খ্রি.), আরবইজরায়েল ধারাবাহিক সংঘর্ষ, ইরাক ইরান যুদ্ধ (১৯৮০-১৯৮৮ খ্রি.) প্রভৃতি।


[8] আঞ্চলিক সহযােগিতার প্রসার: অব-উপনিবেশীকরণের ফলে সদ্য-স্বাধীন বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সহযােগিতার প্রসার ঘটে। এই উদ্দেশ্যে এসব দেশকে নিয়ে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে ওঠে। এরূপ কয়েকটি উল্লেখযােগ্য সংগঠন হল আসিয়ান (Association of South East Asian Nations বা ASEAN), (South Asian Association for Regional Cooperation SAARC), আরব লিগ (Arab League) প্রভৃতি।


উপসংহার: এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বহু উপনিবেশ দীর্ঘ সংগ্রামের দ্বারা ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত হলেও কিছুকালের মধ্যেই সদ্য স্বাধীন সেসব দেশে নয়া উপনিবেশবাদের (Neo-Colonialism) প্রসার ঘটে। পশ্চিমি শক্তিগুলি বাণিজ্যের মাধ্যমে বাজার দখল, অর্থনৈতিক সহায়তাদান প্রভৃতির মাধ্যমে সদ্যস্বাধীন রাষ্ট্রগুলির অর্থনীতির ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। এই ধরনের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ নয়া উপনিবেশবাদ নামে পরিচিত।


বিংশ শতকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে উপনিবেশবিরােধী আন্দোলনের কারণাগুলি আলােচনা করাে।


বিংশী শতকের উপনিবেশবাদের অবসানের কারণগুলি আলােচনা করাে।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে বিভিন্ন দেশের প্রধান উপনিবেশগুলির নাম লেখো। বিশ্বযুদ্ধের পর অর্থ উপনিবেশীকরণের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।