ইন্দোচিন কীভাবে ঠান্ডা লড়াইয়ের কেন্দ্রে পরিণত হয় | ভিয়েতনাম যুদ্ধের পটভূমি লেখাে।

ইন্দোচিনের ঠান্ডা লড়াইয়ের কেন্দ্রে রূপান্তর


প্রথম পর্যায়ে

  • ফরাসি উপনিবেশবাদের বিরােধিতার সূত্রে: ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপােলিয়ান আন্নামের সম্রাটের সঙ্গে এক চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ইন্দোচিনের ওপর ঔপনিবেশিক আধিপত্য কায়েম করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন মিত্রশক্তি জোটের সদস্যরাষ্ট্রগুলির ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের ভিত আলগা হতে শুরু করে। ইন্দোচিনে ফরাসি কর্তৃত্বের বিরােধিতা শুরু হয়। ফরাসি উপনিবেশবাদের এই বিরােধিতা ইন্দোচিনকে ঠান্ডা লড়াইয়ের আবর্তে জড়িয়ে দেয়।


  • জাপানি সাম্রাজ্যবাদের বিরােধিতার সুবাদে: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বাহিনীর হাতে বিধ্বস্ত হয়ে ফ্রান্স ইন্দোচিন ত্যাগ করলে, জাপান সেখানে কর্তৃত্ব স্থাপন করে। জাপান ইন্দোচিনে পূর্বতন আন্নামের সম্রাট বাওদাইয়ের নেতৃত্বে এক তাঁবেদারি সরকার প্রতিষ্ঠা করে। এর বিরুদ্ধে হাে-চি-মিনের নেতৃত্বে পরিচালিত ইন্দোচিনের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে সােভিয়েত সাম্যবাদী শক্তি সমর্থন জানালে ইন্দোচিন ঠান্ডা লড়াইয়ের কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়।


  • মার্কিন হস্তক্ষেপের সূত্রে: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্তিমলগ্নে অক্ষশক্তি জোটের পরাজয় সুনিশ্চিত হলে, সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপানি সাম্রাজ্যবাদের পতন ঘনিয়ে আসে। হাে-চি-মিনের নেতৃত্বে ভিয়েতনামি মুক্তি ফৌজ আরও তীব্রভাবে মুক্তি আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়। এরকম পরিস্থিতিতে ফ্রান্স ব্রিটিশ ও মার্কিন মদতে ভিয়েতনামে ফরাসি ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠায় উদ্যত হলে ইন্দোচিন ঠান্ডা লড়াইয়ের কেন্দ্রে পরিণত হয়।


দ্বিতীয় পর্যায়ে: দিয়েন-বিয়েন-ফু ঘটনা ও জেনেভা সম্মেলনের মাধ্যমে ফ্রান্স ভিয়েতনাম থেকে সরে গেলে ইন্দোচিনে সাময়িক শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু জেনেভা সম্মেলনের সিদ্ধান্ত রূপায়ণের পথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ালে ভিয়েতনাম সংকটের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়। ইন্দোচিনসহ সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাম্যবাদের প্রসার রােধের জন্য বেষ্টনী নীতিকে বলবৎ করতে উদ্যোগ নেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ ভিয়েতনামে ন-দিন-দিয়েম (Ngo-Dinh-Diem)-কে রাষ্ট্রপতি নিয়ােগ করে ক্ষমতায় বসালে তার বিরুদ্ধে চিন ও সােভিয়েত মদতে ভিয়েতমিনরা যুদ্ধ শুরু করে। এই যুদ্ধ ক্রমশ ঠান্ডা লড়াইয়ের পরিবেশ তৈরি করে।


ভিয়েতনাম যুদ্ধের পটভূমি

হাে-চি-মিনের নেতৃত্বে ভিয়েতনামবাসীরা সুদীর্ঘকাল (১৯৫৬-৭৫ খ্রি.) ধরে যে যুদ্ধ চালিয়েছিল তা ভিয়েতনাম যুদ্ধ নামে পরিচিত। বিশ্বজুড়ে সােভিয়েত সাম্যবাদের প্রসার রােধের জন্য মার্কিন আগ্রাসনের নগ্ন রূপ ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধ। প্রথমদিকে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদ ও পরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ভিয়েতনামে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে, চিন ও সােভিয়েত সাহায্যপুষ্ট ভিয়েতনামবাসী রুখে দাঁড়ায়। শুরু হয় দীর্ঘস্থায়ী ভিয়েতনাম যুদ্ধ। এই যুদ্ধের পটভূমি বিশ্লেষণে দেখা যায়—


[1] উপনিবেশ-বিরােধী সংগ্রাম: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্তর্গত মালয়, শ্যাম (থাইল্যান্ড), ব্রহ্মদেশ (মায়ানমার) ইত্যাদি দেশে উপনিবেশ-বিরােধী সংগ্রাম চরমে পৌছেছিল। এইসমস্ত উপনিবেশ-বিরােধী সংগ্রামে প্রভাবিত হয়ে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ইন্দোচিন (টংকিং, আন্নাম, কোচিন-চিন, লাওস, কম্বােডিয়া) তথা ভিয়েতনামে হাে-চি-মিন-এর নেতৃত্বে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল।


[2] রুশ-জাপান যুদ্ধের ফলাফল: রুশ-জাপান যুদ্ধের ফলাফল জাপানের অনুকূলে যাওয়ায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবাসীর মন থেকে শ্বেতাঙ্গভীতি দূর হয়। রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ ভিয়েতনামবাসী প্রথমে ফরাসি ও পরে জাপানি উপনিবেশ বিস্তারে বাধা দিলে ভিয়েতনাম যুদ্ধ বাধে।


[3] চিনের প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লব: সান ইয়াৎ-সেনের নেতৃত্বে শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণির সক্রিয় সহযােগিতায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে চিনে। গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে চিনের এই প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবের ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ভিয়েতনামিরা ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেয়।


[4] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথমদিকে ভিয়েতনাম সংকটে হস্তক্ষেপ না করে নিরপেক্ষ থাকে। কিন্তু মাও-সে- তুঙ-এর নেতৃত্বে চিনে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠিত (১৯৪৯ খ্রি.) হলে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে সােভিয়েত মদতে সাম্যবাদের প্রসার ঘটতে শুরু করলে আমেরিকা চুপ করে থাকতে পারেনি। জেনেভা সম্মেলনের পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরােক্ষভাবে দক্ষিণ ভিয়েতনামে নদিন দিয়েম (Ngo-Dinh-Diem) সরকারকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতে শুরু করলে ভিয়েতনাম যুদ্ধ চরমে পৌছােয়।


[5] পটসভাম সম্মেলনের সিদ্ধান্ত: পটল্ডাম সম্মেলনে (জুলাই, ১৯৪৫ খ্রি.) সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, জাপান ইন্দোচিন থেকে সরে এলে ইন্দোচিনের ১৭° উত্তর অক্ষরেখা বরাবর উত্তরে কুয়ােমিনতাং চিন এবং দক্ষিণে ব্রিটেন দায়িত্ব নেবে। কিন্তু ফ্রান্স ইন্দোচিনে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে ব্রিটেন দক্ষিণ ইন্দোচিন থেকে সরে যায় এবং কুয়ােমিনতাং চিনও উত্তর ইন্দোচিন হাে-চি-মিনের হাতে তুলে দেয়।