মাও-সে-তুই-এর নেতৃত্বে গণপ্রজাতন্ত্রী ছিলো উপান কীভাবে ঘটেছিল?

সূচনা: গণপ্রজাতন্ত্রী চিনে ৪ মে (১৯১৯ খ্রি.) আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটেছিল তার ফলেই ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১ অক্টোবর গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।


গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের উত্থান

[1] কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা: পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবী গােষ্ঠীর প্রচেষ্টায় চিনে (১৯২১ খ্রি., ১ জুলাই) সাংহাই প্রদেশের ফরাসি অধিকৃত একটি গার্লস স্কুলে গােপনে চিনা কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে উঠেছিল। পিকিং, চাঙসা, ক্যান্টন প্রভৃতি জায়গায় এই কমিউনিস্ট পার্টির শাখা গড়ে ওঠে। এই চিনা কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন চেন-তু-শিউ। চিনা কমিউনিস্ট পার্টির মূল প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মাও-সে-তুঙ, লিওশাও-চি, চৌ-এন-লাই, চু-তে প্রমুখ।


[2] লং মার্চ: রাষ্ট্রপতি চিয়াংকাই-শেক ছিলেন প্রচণ্ড কমিউনিস্ট বিদ্বেষী। চিনা কমিউনিস্টদের দমন করার জন্য তিনি তাদের প্রধান ঘাঁটি কিয়াং-সি অভিমুখে সেনাবাহিনী পাঠান (১৯৩৪ খ্রি.)। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই প্রায় এক লক্ষ চিনা কমিউনিস্ট তাদের পরিবার পরিজন সহ কিয়াংসি ত্যাগ করে উত্তর চিনে পীত নদীর বাঁকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ শেনসি প্রদেশ অভিমুখে দীর্ঘ পদযাত্রা শুরু করে। দীর্ঘ এই পদযাত্রায় কমিউনিস্টরা ৬০০০ মাইল পথ অতিক্রম করেছিল। তারা এসময় সাধারণ মানুষের আন্তরিক সহানুভূতি ও সাহায্য লাভ করে।


[3] সিয়াং-ফু ঘটনা: মাও-সে-তুঙের নেতৃত্বে চিনা কমিউনিস্টরা উত্তর চিনের শেনসি প্রদেশে একটি প্রায় স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল, যার রাজধানী ছিল সিয়াং-ফু। কমিউনিস্টদের দমনের জন্য প্রজাতন্ত্রী চিনের রাষ্ট্রপতি চিয়াং-কাই-শেক সেখানে একদল সেনা পাঠান (১৯৩৫ খ্রি.)। ওইসব চিনা সৈন্য কমিউনিস্টদের দমনের পরিবর্তে সমর্থন করতে শুরু করে। এই সংবাদে বিচলিত চিয়াং নিজে সিয়াং-ফুতে উপস্থিত হন। তখন তাঁরই এক সেনাপতি চ্যাং-শিউ-সিয়াং হঠাৎ চিয়াংকে বন্দি করে (১২ ডিসেম্বর, ১৯৩৬ খ্রি.) এক অজ্ঞাত স্থানে লুকিয়ে রাখে। প্রায় দু সপ্তাহ বন্দি থাকার পর সােভিয়েত হস্তক্ষেপে এবং চৌ-এন-লাই-এর মধ্যস্থতায় চিয়াং ২৫ ডিসেম্বর মুক্তি পান।


[4] কমিউনিস্ট শক্তিবৃদ্ধি: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত জাপান ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে আত্মসমর্পণ করে। এরপর কুয়ােমিনতাং ও চিনা কমিউনিস্টদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আবার চরমে ওঠে। কিন্তু নানা কারণে কুয়ােমিনতাং দলের সামরিক শক্তি তখন ক্রমহ্রাসমান। পক্ষান্তরে কমিউনিস্টরা ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে চিনের কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির সমর্থন লাভ করে।


[5] কমিউনিস্ট দ্বারা প্রজাতন্ত্র গঠন: ক্রমবর্ধমান ও সামরিক শক্তির সহায়তায় মাও-এর নেতৃত্বে চিনা কমিউনিস্টরা একের পর এক চিনের বিভিন্ন ভূখণ্ড দখল করতে থাকে। শেষপর্যন্ত চিয়াং সরকারকে যুদ্ধে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করে কমিউনিস্টরা পিকিং দখল করে। মূল ভূখণ্ড থেকে উচ্ছেদ হয়ে চিয়াং কাই-শেক ফরমােজা (তাইওয়ান) দ্বীপে আশ্রয় নেন। সেখানে কুয়ােমিনতাংরা জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করে। আর চিনের মূল ভূখণ্ডে মাও-সে-তুঙের নেতৃত্বে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হয় জনগণের প্রজাতন্ত্র’ যা 'গণপ্রজাতন্ত্রী চিন’ নামে খ্যাত। মাও-সে-তুঙ হন এর প্রথম সভাপতি বা চেয়ারম্যান এবং প্রধানমন্ত্রী হন চৌ-এন-লাই।


[6] কমিউনিস্টদের সাফল্যের কারণ


  • মাও-সে-তুঙের নেতৃত্ব: মাও-সে-তুঙের অসামান্য নেতৃত্বে চিনে। কমিউনিস্ট দলের প্রতিষ্ঠা ও প্রসার ঘটেছিল। নেতারূপে তার দক্ষতা, সংগঠকরূপে তাঁর সাংগঠনিক বুদ্ধি ও শক্তি, সেনাপতিরূপে তাঁর রণকৌশল কমিউনিস্ট দলকে অপ্রতিরােধ্য করে তুলেছিল।


  • জনসমর্থন: মাও-এর ডাকে সাড়া দিয়ে চিনবাসী যে-কোনাে আত্মত্যাগে তৈরি ছিল। কৃষক, শ্রমিক-সহ সাধারণ মানুষের অকুষ্ঠ সমর্থন পেয়েছিল মাও-এর কমিউনিস্ট দল।


  • রাশিয়ার সাহায্য: সাম্যবাদের আঁতুড়ঘর রাশিয়া প্রথম থেকেই চাইত যে বিশ্বে সাম্যবাদী ভাবধারার প্রসার ঘটুক। সােভিয়েত নেতাদের ধারণা ছিল পুঁজিবাদের প্রসার রােধ করতে সাম্যবাদের বিস্তার প্রয়ােজন। তাই চিনের সাংহাই নগরীতে যখন মাও-সে- তুঙের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হল (১৯২১ খ্রি.) তখন সবার আগে রাশিয়া এই দলকে সমর্থন করেছিল।


উপসংহার: মাও-সে-তুঙ-এর নেতৃত্বে গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের উত্থান বিশ্বের সাম্যবাদী ভিতকে আরও মজবুত করে।