উপনিবেশবাদের রাজনৈতিক ভিত্তি সম্পর্কে আলোচনা করাে | উপনিবেশবাদের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ক নির্ধারণ করাে।

উপনিবেশবাদের রাজনৈতিক ভিত্তি

উপনিবেশবাদের পশ্চতে রাজনৈতিক কারণকে অস্বীকার করা যায় না। অধ্যাপক জেমস জোল মনে করেন যে, সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণের কারণ ব্যাখ্যার জন্য সম্ভবত কোনাে একটি অভিমত যথেষ্ট নয়। এর জন্য বিভিন্ন কারণকেই দায়ী করা যায়। তবে বিভিন্ন কারণের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযােগ্য হল রাজনৈতিক কারণ। ঐতিহাসিক ডেভিড থমসনের মতে "ইউরােপের ক্ষেত্রে নগ্ন রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব উপনিবেশের ক্ষেত্রে প্রসারিত হয়।"


[1] রাজনৈতিক একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা: কোনাে দেশের যাবতীয় ক্ষমতা দখলের মূল ভিত্তি হল রাজনৈতিক ক্ষমতা। উপনিবেশ বিস্তারকারী দেশগুলির লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা। বিভিন্ন দুর্বল দেশে রাজনৈতিক একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তারা সেই সকল দেশের অর্থনৈতিক, সামরিক, সামাজিক, ধর্মীয় প্রভৃতি ক্ষেত্রে সহজেই আধিপত্য বিস্তার করতে পারত।


[2] ক্ষমতার লােভ: ইউরােপের বিভিন্ন দেশ যেমন, ইটালি, জার্মানি, ফ্রান্স, রাশিয়া জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজেদের মানসম্মান, প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে উপনিবেশ বিস্তারে মন দেয়। কারণ তারা মনে করত যে, যার ঔপনিবেশিক এলাকা যত বেশি, সেই রাষ্ট্রের মর্যাদা ও ক্ষমতা তত বেশি। ফ্রান্স ও বেলজিয়ামের মতাে কিছু দেশ শিল্পের জন্য বাজার দখলের প্রয়ােজনীয়তা না থাকলেও শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতা বিস্তারের লােভে উপনিবেশ স্থাপনে এগিয়ে আসে।


[3] অর্থসম্পদের লােভ: ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির অন্যতম লক্ষ্য থাকে কোনাে দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে তাকে উপনিবেশে পরিণত করে সেখানকার অর্থসম্পদকে শােষণ করা। বাণিজ্যিক আধিপত্য স্থাপন, ভূমিরাজস্বসহ বিভিন্ন ধরনের কর আদায় ইত্যাদির উদ্দেশ্যে তারা উপনিবেশ বিস্তার করে এবং এতে তারা রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কাজে লাগায়।


[4] সামরিক ঘাঁটি দখল: উপনিবেশবাদের আর-একটি অন্যতম কারণ হল বিশ্বের বিভিন্ন জলপথের ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন এবং নৌ শক্তির ওপর আধিপত্য স্থাপনের জন্য সামরিক ঘাঁটি দখল করা। কারণ এই সামরিক ঘাঁটিগুলির সাহায্যে রাজনৈতিক আধিপত্য সুরক্ষিত করা যায়।


[5] উগ্র জাতীয়তাবাদ: ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকালে ইউরােপের বিভিন্ন দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদীরা মাথাচারা দেয়। নিজ দেশকে শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে তারা অপর দেশের ওপর আধিপত্য চালায়। এই বিকৃত রাজনৈতিক ভাবাদর্শ দ্বারা পরিচালিত হয়ে ইউরােপীয় দেশগুলি এশিয়া ও আফ্রিকার অনুন্নত দেশগুলিকে উপনিবেশে পরিণত করতে থাকে।


উপনিবেশবাদের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ক


উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ হল আধুনিক বিশ্ব ইতিহাসের দুটি উল্লেখযােগ্য রাজনৈতিক ধারণা। সাম্রাজ্যবাদের সাফল্য শেষপর্যন্ত ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে। তাই অনেক সময় এই দুটি বিষয়কে একই অর্থে ব্যবহার করা হলেও আসলে উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য দুইই লক্ষ করা যায়ㅡ


সাদৃশ্য: উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য সাদৃশ্যগুলি হল


  • উভয়েরই লক্ষ্য শক্তিশালী রাষ্ট্রের দ্বারা দুর্বল রাষ্ট্রের ওপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য স্থাপন করা।

  • কোনাে শক্তিশালী দেশের সাম্রাজ্যবাদী নীতি বাস্তবায়নের অন্যতম একটি উপায় হল উপনিবেশবাদ।

  • উপনিবেশবাদ একপ্রকার দুর্বল সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন।

  • উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ উভয়েরই লক্ষ্য হল অন্য রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে আগ্রাসন চালানাে।


বৈসাদৃশ্য: উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে অনেকগুলি বৈসাদৃশ্য লক্ষ করা যায়


  • অর্থগত: উপনিবেশবাদ বলতে বাঝায় দেশের সীমান্তের বাইরে কোনাে রাষ্ট্রে বসতি স্থাপন অথবা রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন কোনাে একটি ভূখণ্ড উক্ত রাষ্ট্রের কাছে নির্দিষ্টভাবে আনুগত্য প্রকাশ করে। অন্যদিকে, সাম্রাজ্যবাদ বলতে বােঝায় যখন কোনাে দেশ তার সীমানার বাইরে অন্য দেশের ওপর জোরপূর্বক নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে এবং সেই দেশটিকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে।


  • প্রকৃতিগত: ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র যেখানে উপনিবেশ স্থাপন করে সেখানে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র থেকে বহু মানুষ এসে বসবাস করে এবং এদের আনুগত্য থাকে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রটির প্রতি। কিন্তু, সাম্রাজ্যবাদের ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের জনগণ নতুন দখলিকৃত রাষ্ট্রে বসবাস নাও করতে পারে। এখানে নতুন অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব কেড়ে নেওয়া হয় এবং সেখানে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের আধিপত্য স্থাপিত হয়।


  • কৌশলগত: উপনিবেশবাদের ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের বিপুল সংখ্যক জনগণ নতুন এলাকায় উপনিবেশ স্থাপন করে সেই উপনিবেশবাসীরাই সেখানে নিয়ন্ত্রণ চালিয়ে সেখানকার রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব কায়েম করে। যেমন আমেরিকায় ইংল্যান্ডের উপনিবেশ। অপরদিকে, সাম্রাজ্যবাদের কৌশল হল সামরিক অভিযানের মাধ্যমে অন্য কোনাে স্থান নিজ দখলে এনে সেখানে প্রত্যক্ষ শাসন প্রতিষ্ঠা করা।


  • প্রাচীনত্নের দিক থেকে: মােটামুটিভাবে খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকের পর থেকে উপনিবেশবাদের প্রসার শুরু। এই সময় উন্নত নৌশক্তিধর রাষ্ট্রগুলি বাণিজ্যের প্রসার ঘটানাের উদ্দেশ্যে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠায় মন দেয়। তাই উপনিবেশবাদ হল অপেক্ষাকৃত নতুন ভাবধারা। অন্যদিকে, সাম্রাজ্যবাদী ভাবধারা অনেক বেশি প্রাচীন। প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন শক্তিশালী রাষ্ট্র তাদের সাম্রাজ্যবাদী কার্যকলাপ চালিয়ে আসছে।


উপসংহার: আসলে উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ পরস্পরের পরিপূরক ধারণা। তাই দুটি ধারণা সংযুক্ত হয়ে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ ধারণাটির প্রচলন ঘটেছে।