ঔপনিবেশিক ইতিহাস চর্চায় ভারতের অতীতসমাজ ও সভ্যতার বিবরণ দাও।

সূচনা: দেওয়ানি লাভের (১৭৬৫ খ্রি.) পর তৎকালীন ভারতীয় সমাজব্যবস্থা ও ভারতবাসীর জীবনযাত্রার বিভিন্ন দিকগুলি সম্পর্কে ধারণা লাভ করা ইংরেজদের কাছে জরুরি হয়ে ওঠে। ওয়ারেন হেস্টিংসের আমল থেকে শুরু হয় এদেশে ইংরেজদের ভারতীয় ইতিহাস চর্চা।


ঔপনিবেশিক ইতিহাস নির্মাণ বা চর্চা


বিভিন্ন রূপ


  • প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাভিত্তিক: ঔপনিবেশিক শাসনের গােড়ার দিকে ভারতে নিয়ােজিত ব্রিটিশ প্রশাসক ও উচ্চপদস্থ কর্মচারীগণ ভারত ইতিহাস চর্চা শুরু করেন। ওয়াটস, বােল্টস, স্ক্র্যাফটন, ওরমে ভেরেলস্ট ও শাের নিজেদের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে ভারত ইতিহাস লেখেন।


  • মানবতাবাদী ভাবনাভিত্তিক: উইলিয়াম জোন্স, উইলসনের মতাে মানবতাবাদী পণ্ডিতগণ তাদের লেখার মধ্যে দিয়ে প্রাচীন হিন্দু সভ্যতার স্বরূপ উন্মােচন করেন। এরা সকলেই প্রাচীন হিন্দু সভ্যতা সম্পর্কে উচ্চধারণা পােষণ করতেন।


  • সাম্প্রদায়িক ভাবনাভিত্তিক: সাম্প্রদায়িক ভাবনায় প্রভাবিত হয়ে জেমস মিল তিন খণ্ডে বিভক্ত 'হিস্ট্রি অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া নামে ভারতের ইতিহাস রচনা করেন। এটিই ছিল ভারত প্রসঙ্গে লিখিত পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। এই গ্রন্থে মিল সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ভারত ইতিহাস কালকে হিন্দু যুগ, মুসলিম যুগ ও ব্রিটিশ যুগ এই তিন পর্বে ভাগ করেন। এ ছাড়া আলেকজান্ডার ডাফ, বিশপ হেবার প্রমুখ ব্রিটিশ লেখকগণ ভারতে হিন্দু-মুসলিম সভ্যতাকে পৃথক হিসেবে তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা চালান।


  • ধর্মভিত্তিক: কোলব্রুক তাঁর লেখার মধ্যে দিয়ে প্রাচীনতম হিন্দু গ্রন্থ বেদের সঙ্গে ইউরােপীয়দের পরিচয় করিয়ে দেন। বার্নুফ ঋগবেদ ও জেন্দ আবেস্তার মধ্যে মিলগুলি উল্লেখ করেন ও আর্যজাতির ইতিহাসে সংস্কৃতের গুরুত্বগুলি বর্ণনা করেন। ম্যাক্সমুলার সেক্রেড বুকস অব দ্য ইস্ট গ্রন্থ রচনা দ্বারা সংস্কৃত সহ অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় লেখা ধর্মনির্ভর সাহিত্যগুলির সঙ্গে ইউরােপীয়দের পরিচয় করান।


  • সাম্রাজ্যবাদকেন্দ্রিক: উনিশ শতকে ইতিহাস চর্চায় আলফ্রেড লয়াল, হেনরি জেইন, উইলিয়াম হান্টার প্রমুখ ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গৌরবােজ্জ্বল দিকগুলির ওপর আলােকপাত করেন। এক্ষেত্রে তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দোষ-ত্রূটিগুলি এড়িয়ে যান।


নানা উদ্যোগ


  • এশিয়াটিক সােসাইটি: ওয়ারেন হেস্টিংসের সহযােগিতায় উইলিয়াম জোন্স কলকাতায় এশিয়াটিক সােসাইটি' প্রতিষ্ঠা করেন। মূলত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ইতিহাস ও সাহিত্যের মধ্যে যােগসূত্র স্থাপনের লক্ষ্যেই এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে গবেষণা শুরু হয় এবং বেশকিছু গবেষণামূলক পত্রিকাও প্রকাশিত হয় ও ভারতীয় ভাষায় লেখা বেশকিছু প্রাচীন গ্রন্থ ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করা হয়।


  • খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্যোগ ও কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ কলেজ: খ্রিস্টান মিশনারিরা খ্রিস্টানধর্ম প্রচারের পাশাপাশি ভারতের বিভিন্ন ভাষা ও ইতিহাস চর্চায় হাত দেন। শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন ও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের প্রচেষ্টায় বেশকিছু সাহিত্যধর্মী ইতিহাস রচিত হয়। উইলিয়াম কেরি রচনা করেন ইতিহাসমালা', রামরাম বসু রচনা করেন 'রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত’, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার রচনা করেন রাজাবলি’, তারিণীচরণ মিত্র রচনা করেন ওরিয়েন্টাল ফেবুলিস্ট প্রভৃতি গ্রন্থ।


উল্লেখযোগ্য ইতিহাস


  • উনিশ শতকের ইতিহাস কীর্তি: উনিশ শতকে লেখা ইতিহাস গ্রন্থগুলির মধ্যে জেমস মিলের 'হিস্ট্রি অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, ম্যাক্সমুলারের সেক্রেড বুকস অব দ্য ইস্ট', মেকলের এসেস অন ওয়ারেন হেস্টিংস’, জন ম্যালকমের পলিটিক্যাল হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া', উইলিয়াম হান্টারের অ্যানালস অব রুরাল বেঙ্গল’ প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য।


  • বিংশ শতকের ইতিহাস কীর্তি: বিংশ শতকে ভারতের ওপর লেখা কয়েকটি উল্লেখযােগ্য গ্রন্থ হল ভিনসেন্ট স্মিথ রচিত আর্লি হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া এবং 'অক্সফোর্ড হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া' (১৯১৯ খ্রি.), পি. ই. রবার্টস রচিত 'হিস্ট্রি অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া টু দ্য এন্ড অব দ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (১৯২১ খ্রি.), ডডওয়েল রচিত কেমব্রিজ হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া (১৯২৯ খ্রি.), কিথ রচিত কনস্টিটিউশনাল হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া' (১৯৩৬ খ্রি.) প্রভৃতি।


উপসংহার: ঐতিহ্যের ধারা মেনে আজও ভারতীয় ঔপনিবেশিক ইতিহাস চর্চা অব্যাহত রয়েছে।