১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের 'ভারত ছাড়াে' আন্দোলন সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লেখাে।

সূচনা: সর্ববৃহৎ জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ভারত ছাড়াে বা আগস্ট আন্দোলন। এই আন্দোলন নিঃসন্দেহে ভারতবাসীর স্বাধীনতা লাভকে ত্বরান্বিত করে।


১৯৪২-এর 'ভারত ছাড়াে' আগস্ট আন্দোলন

[1] পটভূমি: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায় ক্রিপস মিশনের আগমন ও প্রস্থান, ভারতবাসীর তীব্র স্বাধীনতা-আকাঙ্ক্ষা, মূল্যবৃদ্ধি, জাপানি আক্রমণের ভয়, ব্রিটিশ সেনাদের অত্যাচার সবকিছু মিলেমিশে এক ভবিষ্যৎ গণ আন্দোলনের পটভূমি রচনা করে।


[2] 'ভারত ছাড়াে' আন্দোলনের সূচনা: বােম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ আগস্ট) নিখিল ভারত কংগ্রেস সমিতির বিপুল ভােটে গান্ধিজির ভারত ছাড়াে প্রস্তাব পাস হয়। ঘােষণা করা হয় ৯ আগস্ট থেকে ভারত ছাড়াে আন্দোলন শুরু হবে এবং ইংরেজ ভারত না ছাড়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে। গান্ধিজি জাতির উদ্দেশ্যে ঘােষণা করেন- "ভারত স্বাধীন করব, অথবা মৃত্যুবরণ করব—'Do or Die (করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে)।" নিখিল ভারত কংগ্রেস সমিতির অধিবেশন, শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বােম্বাই রেলস্টেশন থেকে গভীর রাতে গান্ধিজি, জওহরলাল, প্যাটেল, আজাদ ও জে. বি. কৃপালনি-সহ শীর্ষ নেতাদের ব্রিটিশ গ্রেফতার করে। পরের দিন সকালে এই খবর প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভারত ছাড়াে বা আগস্ট আন্দোলন বিদ্যুৎ গতিতে ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।


[3] 'ভারত ছাড়াে' বিস্তার


  • বাংলায়: বাংলায় আগস্ট আন্দোলনের মূলকেন্দ্র ছিল কলকাতা, ঢাকা, মেদিনীপুর, হুগলি-সহ বিভিন্ন জায়গায়। কলকাতা কার্যত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। মেদিনীপুর জেলার তমলুক ও কাথি মহকুমায় এই আন্দোলন সবথেকে তীব্র আকার ধারণ করে। তমলুকে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার গড়ে ওঠে।


  • বিহার ও যুক্তপ্রদেশে: বিহারের মুঙ্গের, ভাগলপুর, মুজাফফরপুর, পূর্ণিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে, যুক্তপ্রদেশের বালিয়া, আজমগড়, সুলতানপুর, জৌনপুর, গােরক্ষপুর প্রভৃতি জেলায় গান্ধিজির 'করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গেগ' ধ্বনি জনগণকে স্বাধীনতালাভে ব্যাকুল করে।


  • অন্যান্য অঞ্চলে: বােম্বাই, আমেদাবাদ, পুনা, নাগপুর, কানপুর-সহ বিভিন্ন অঞ্চলে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। বেনারস, পাটনা, কটক প্রভৃতি স্থানে আন্দোলনকারীরা যােগাযােগ ব্যবস্থাকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। রাজস্থানের যােধপুর, উদয়পুর, জয়পুরে সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। পাঞ্জাব, সিন্ধু ও সীমান্ত প্রদেশে আন্দোলনকারীরা জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে।


[4] নেতৃবৃন্দ: গান্ধিজির ডাকে ভারত ছাড়াে আন্দোলনে যাঁরা দক্ষতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে জয়প্রকাশ নারায়ণ, অরুণা আসফ আলি, সুচেতা কৃপালনি, রামমনােহর লােহিয়া, অচ্যুৎ পট্টবর্ধন, অজয় মুখার্জি, যােগেশ চ্যাটার্জি, সুশীল ধাড়া, সরযূ পান্ডে, নানা পাতিল এবং আসামের ১৩ বছরের স্কুলছাত্রী কনকলতা বড়ুয়া ও মেদিনীপুরের তমলুকের ৭৩ বছরের বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা ছিলেন উল্লেখযােগ্য।


[5] ব্রিটিশের দমননীতি: আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে গুলিচালনা, গ্রেফতার, জরিমানা, লাঠিচালনা, বেতের আঘাত এমনকি বিমান থেকে গােলাবর্ষণও করা হয়। সারা দেশে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর তাণ্ডব শুরু হয়।


[6] 'ভারত ছাড়াে' ব্যর্থতার কারণ


  • শীর্ষ নেতৃত্বের অভাব: গান্ধিজি-সহ শীর্ষ নেতৃবৃন্দ কারারুদ্ধ থাকায় এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতাে উপযুক্ত নেতা ছিল না।


  • ঐক্যের অভাব: মুসলিম লিগ, কমিউনিস্ট পার্টি, হিন্দু মহাসভা, কেউই আন্দোলন সফল করার জন্য কংগ্রেসকে সমর্থন করেনি। এই দলগত ঐকোর অভাব আন্দোলনকে ব্যর্থ করে।


  • ব্রিটিশের পীড়ন নীতি: ব্রিটিশের তীব্র দমননীতি আন্দোলনকে সফল হতে দেয়নি। দৈহিক নির্যাতন, গ্রেফতার, ঘর পুড়িয়ে দেওয়া, ধর্ষণ, এমনকি গুলি চালিয়ে ব্রিটিশ সরকার এই আন্দোলনকে স্তন্ধ করে দেয়।


  • অসময়ে সূচনা: ভুল সময়ে এই আন্দোলন শুরু হওয়ায় আন্দোলন সফল হয়নি বলে মনে করা হয়। সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি থাকাকালীন এই আন্দোলনের সূচনা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গান্ধি অনুগামীরা তখন তা অনুমােদন করেননি।


[7] 'ভারত ছাড়াে' আন্দোলনের গুরুত্ব


  • কংগ্রেসের মর্যাদাবৃদ্ধি: ভারত ছাড়াে আন্দোলনের পর কংগ্রেসের মর্যাদা ও প্রভাব বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।


  • সাম্প্রদায়িক ঐক্য: এই আন্দোলন সাম্প্রদায়িক ঐক্যকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করে।


উপসংহার: ১৯৪২-এর আন্দোলন যেভাবে জাতীয় জাগরণ ঘটিয়েছিল ইতিপূর্বে তা আর দেখা যায়নি।