ক্ষমতা হস্তান্তর ও ভারতীয়দের অংশগ্রহণের ওপর আলােকপাত করাে।

ক্ষমতা হস্তান্তর ও ভারতীয়দের অংশগ্রহণ

সূচনা: দেশব্যাপী একাধিক গণ আন্দোলনের জেরে ব্রিটিশ ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রেক্ষাপটে ভারতীয়দের উদ্যোগ ও অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফুর্ত।


ওয়াভেল পরিকল্পনা ও সিমলা বৈঠকের ক্ষেত্রে


[1] ভারতীয়দের প্রতি প্রস্তাব: জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মতভেদের কারণে ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কাজ ব্যাহত হচ্ছিল। এই অচলাবস্থার অবসানের জন্য বড়ােলাট ওয়াভেল ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সঙ্গে আলােচনা করে একটি পরিকল্পনা পেশ করেন। এই পরিকল্পনায় কিছু প্রস্তাব রাখা হয়। এই প্রস্তাবগুলি আলােচনা করার জন্য বড়ােলাট ওয়াভেল সিমলাতে সর্বদলীয় নেতাদের একটি বৈঠক ডাকেন (২৫ জুন, ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ)।


[2] ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া


  • মুসলিম লিগ: মুসলিম লিগের তরফে জিন্না সিমলা প্রস্তাব সমর্থনের জন্য দুটি শর্ত আরােপ করেন।


    • প্রথমত, তিনি বলেন বড়ােলাটের শাসন পরিষদের প্রস্তাবিত পাঁচজন মুসলমান সদস্যের প্রত্যেককেই মুসলিম লিগভুক্ত হতে হবে।


    • দ্বিতীয়ত, বড়ােলাটের ভােটদানের অধিকারের মধ্যে মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।


  • কংগ্রেস: জাতীয় কংগ্রেস জিন্নার দাবি অগ্রাহ্য করে। কংগ্রেসের তরফ থেকে বলা হয়, যেহেতু কংগ্রেসে বহু জাতীয়তাবাদী মুসলমান সদস্য রয়েছে তাই বড়ােলাটের শাসন পরিষদে মুসলমান সদস্য মনােনয়ন করবে কংগ্রেস। বড়লাটের শাসন পরিষদের সদস্য কারা হবেন সে বিষয়ে কংগ্রেস বড়ে়ালাটকে এক তালিকা পাঠায়। সেই তালিকাতে ছিল দুজন হিন্দু, একজন মুসলমান, একজন পারসি ও একজন খ্রিস্টান।


  • শিখ ও সংখ্যালঘুদের পক্ষে: শিখ নেতা তারা সিং ও সংখ্যালঘু নেতা শিবরাজ কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের প্রাধান্যের বিরােধিতা করেন। তারা নিজ নিজ সদস্যদের বড়ােলাটের শাসন পরিষদে অন্তর্ভুক্তির দাবিতে সরব হন।


মন্ত্রী মিশন বা ক্যাবিনেট মিশন


[1] ক্ষমতা হস্তান্তরের উদ্যোগ: ক্যাবিনেট মিশনের সদস্যরা জাতীয় নেতৃবর্গের সঙ্গে আলােচনা চালান। মন্ত্রী মিশন তার পরিকল্পনা বেশ কিছু সুপারিশ উল্লেখ করে।


[2] প্রতিক্রিয়া


  • কংগ্রেসের: মন্ত্রী মিশনের পরিকল্পনায় অন্তর্বর্তী সরকারে কংগ্রেস ও লিগকে সমমর্যাদা দেওয়ায় কংগ্রেস ক্ষুদ্ধ হয়। এ ছাড়াও গণপরিষদের প্রকৃত ক্ষমতা কেমন হবে, তা নিয়েও কংগ্রেস সন্দেহ প্রকাশ করে।


  • মুসলিম লিগের: মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাবে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে প্রদেশগুলিকে ভাগ করার কথা বলা হয়। এই প্রাদেশিক বিভাজন নীতি পাকিস্তান গঠনের উপযােগী হবে মনে করে মুসলিম লিগ একে স্বাগত জানায়।


অন্তর্বর্তীকালীন সরকার


[1] সরকারে কংগ্রেসের অংশগ্রহণ: জওহরলালের নেতৃত্বে কেন্দ্রে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয় (১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২ সেপ্টেম্বর)। এই সরকারের উপসভাপতি বা প্রধানমন্ত্রী হন জওহরলাল নিজে। মন্ত্রীসভার ১২ জন সদস্যের মধ্যে ৬ জন ছিলেন কংগ্রেসের। ১২ জন সদস্যের মধ্যে জাতীয় কংগ্রেসভুক্ত ৬জন ছিলেন—জওহরলাল নেহরু, ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ, চক্রবর্তী রাজাগােপালাচারী, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, শরৎচন্দ্র বসু, অরুণা আসফ আলি। আর বাকি ৬ সদস্য ছিলেন—সর্দার বলদেব সিং (শিখ), ড. জন মাথাই (ভারতীয় খ্রিস্টান), স্যার সাফাৎ আহমদ খান ও সৈয়দ আলি জাহির (লিগ বহির্ভূত মুসলিম), সি. এইচ. ভাবা (পারসি) এবং ফ্রাঙ্ক অ্যান্টনি (অ্যাংলাে ইন্ডিয়ান)।


[2] মুসলিম লিগের ভূমিকা: বড়ােলাট ওয়াভেলের অনুরােধে। লিগের ৫ জন সদস্য মন্ত্রীসভায় যােগ দেয়। মন্ত্রীসভায় যােগ দিলেও লিগের মন্ত্রীরা একটি পৃথক গােষ্ঠী হিসেবে কাজ করত। মুসলিম লিগের ৫ জন সদস্য হলেন—লিয়াকৎ আলি খাঁ, ইব্রাহিম ইসমাইল চুন্দ্রীগড়, আবদুর রব নিস্তার, গজনফর আলি খাঁ, যােগেন্দ্রনাথ মণ্ডল।


মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা


[1] দেশভাগের ঘােষণা: মুসলিম লিগের প্রত্যক্ষ সংগ্রামের জেরে দেশজুড়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়। ভারতীয়দের হাতে দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে মাউন্টব্যাটেন তার পরিকল্পনায় দেশভাগের কথা ঘােষণা করেন।


[2] প্রতিক্রিয়া


  • কংগ্রেসের: মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনায় দেশবিভাগের উল্লেখ থাকায় গান্ধিজি এবং মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এর বিরােধিতা করেন।


  • মুসলিম লিগের: মুসলিম লিগ মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাবিত দেশভাগের ঘােষণাকে স্বাগত জানায়। মাউন্টব্যাটেন লিগ নেতাদের জানান অখণ্ড পাকিস্তান দেওয়া সম্ভব নয়। দ্বিখণ্ডিত বাংলা ও পাঞ্জাবকে পাকিস্তানভুক্ত করা হবে। দেশভাগের সিদ্ধান্তে খুশি হলেও তাই জিন্না মাউন্টব্যাটেন ঘােষিত পাকিস্তানকে বিকলাঙ্গ ও কীট দগ্ধ (Truncated and Motheaten) আখ্যা দেন।


  • কমিউনিস্ট দলের: কমিউনিস্ট দল ভারত ও পাকিস্তান দুই আলাদা রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরােধিতা করে।


উপসংহার: শেষপর্যন্ত ক্ষমতা হস্তান্তরের ফলে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শক্তির হাত থেকে ভারত মুক্ত হল বটে। কিন্তু অখণ্ড ভারত দু-টুকরাে হল।