আদি-মধ্যযুগের সংস্কৃতি (সাহিত্য, শিল্প, দর্শন ও বিজ্ঞান)

আদি-মধ্যযুগের আঞ্চলিক ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ:

আদি-মধ্যযুগের ভারতের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য ছিল কেন্দ্রীকরণের অভাব ও আঞ্চলিক রাজনীতির বিকাশ। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর যে রাজনৈতিক খণ্ডীকরণ শুরু হয়, তার প্রভাব সভ্যতা-সংস্কৃতির ওপরেও পড়ে। লক্ষণীয় যে, সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতকে ভারতে কোনো শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার অস্তিত্ব না থাকলেও সংস্কৃতিচর্চার গতি প্রায় অব্যাহতই ছিল। উত্তর, উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের রাজবংশগুলি ভূখণ্ডগত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও শিল্প-সাহিত্যচর্চার কার্পণ্য করেনি। রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা কিংবা রাজকীয় সহনশীলতার মাধ্যমে আঞ্চলিক শাসকেরা সহনশীলতাকে সচল রাখতে সহায়তা করেছিলেন। এই পর্বে আঞ্চলিক স্তরে সংস্কৃত, তামিল, তেলেগু, কানাড়া, বাংলা ইত্যাদি ভাষায় সাহিত্যের ব্যাপক চর্চা লক্ষ্য করা যায়। আদি-মধ্যকালীন ভারতের আর একটি বৈশিষ্ট্য হল—নতুন ধর্মমতের উদ্ভব ও বিকাশ এবং প্রচলিত ধর্মের গণমুখী সংস্কারসাধনের প্রয়াস। শৈব, বৈষ্ণব, শাক্ত, তান্ত্রিক বৌদ্ধ ইত্যাদি নতুন নতুন ধর্মমতের দর্শনতত্ত্বের ভিত্তি হিসেবে বহু পুঁথি, গাথা ও শাস্ত্র রচিত হয়। এগুলিও আদি-মধ্যকালীন ভারতেরই ভাষা ও সাহিত্য বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে খ্রিস্টীয় ৭০০-১২০০ অব্দের মধ্যবর্তীকালে এদেশের সংস্কৃতির ধারা ক্রমশ এক একটি নির্দিষ্ট ভাষাভাষী মানুষের দ্বারা অধ্যুষিত পৃথক জনপদভিত্তিক হয়ে পড়েছিল। এই পর্বে এক অঞ্চলের সংস্কৃতি অন্য অঞ্চলের সংস্কৃতি থেকে স্বাতন্ত্র্য গড়ে তোলার সঙ্গে সঙ্গে সেই স্বাতন্ত্র্যতা বজায় রাখতেও বিশেষ তৎপর ছিল। অবশ্য ভারতীয় জীবনধারার চিরাচরিত ঐতিহ্য অনুসারে আদি মধ্যযুগের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা, ধর্ম, দর্শন ইত্যাদি ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের’ শাশ্বত উপাদানগুলিকেও সযত্নে লালিত করেছিল।


আদি-মধ্যযুগের সংস্কৃত সাহিত্য :

পালযুগে (৮ম-১২ শতক) পূর্ব ভারতে সাহিত্যচর্চার প্রধান মাধ্যম ছিল সংস্কৃত ভাষা। সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় সংস্কৃত ভাষার ব্যাপক অনুশীলন হত। পালরাজাদের বিভিন্ন তাম্রশাসনে ব্যবহৃত সংস্কৃত শ্লোকের বহুল প্রয়োগ থেকে অনুমান করা যায় যে, সেকালে সংস্কৃত ভাষায় কাব্যচর্চা পূর্বাপেক্ষা বেশি প্রসারলাভ করেছিল। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, সংস্কৃত সাহিত্যের ওপর বাঙালিদের বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল। দর্ভপাণি চতুর্বেদে পারদর্শী ছিলেন, কেদার মিশ্র বেদ, আগমশাস্ত্র, জ্যোতিষশাস্ত্র ইত্যাদিতে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। চতুর্ভুজ -এর ‘হরিচরিত' কাব্য থেকে জানা যায় যে, বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ শ্রেণি শ্রুতি, স্মৃতি, পুরাণ, ব্যাকরণ প্রভৃতিতে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। হরিবর্মদেবের মন্ত্রী ভট্টভবদেব দর্শন, মীমাংসা, আয়ুর্বেদ, তন্ত্রসার, গণিত ইত্যাদিতে পারদর্শী ছিলেন। তিনি ‘হোরাশাস্ত্র' গ্রন্থ রচনা করে 'দ্বিতীয় বরাহ' উপাধি পান। নবম শতকে অভিনন্দ নামক জনৈক বাঙালি কবি আবির্ভূত হন। তিনি 'গৌড়-অভিনন্দ' নামে পরিচিত ছিলেন। সম্ভবত, 'কাদম্বরী কথাসার' কাব্যগ্রন্থের প্রণেতা ছিলেন গৌড় অভিনন্দ। মদনপালের রাজত্বকালে কবি সন্ধ্যাকর নন্দী বিরচিত ‘রামচরিত'একটি অতি জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ। এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু দ্ব্যর্থবোধক। এক বিচারে এটি রামায়ণের রামচন্দ্রের গুণকীর্তন, অন্যদিকে এই গ্রন্থ পালরাজা রামপালের কীর্তিগাথা হিসেবে চিহ্নিত হয়। শ্লেষাত্মক শ্লোকবিশিষ্ট এই গ্রন্থে ইতিহাসের আখ্যান বর্ণনা করায় এতে কাব্যসুষমা সর্বত্র পরিস্ফুট হয়নি। তবে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে এর গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। বাঙালি লেখক শ্রীধর ভট্ট দশম শতকের গোড়ায় ‘ন্যায়কন্দলী' রচনা করেন। এই টীকাভাষ্যে তিনি ন্যায় বৈশেষিক মতের ওপর আস্তিক্যবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়া 'তত্ত্বপ্রবোধ', 'তত্ত্বসংবাদিনী', 'সংগ্রহটিকা’ইত্যাদি বেদান্ত ও মীমাংসা-বিষয়ক টীকাভাষ্য তিনি রচনা করেন।


ভেষজবিদ্যা-সংক্রান্ত কয়েকটি গ্রন্থ এ যুগের বাঙালি লেখকরা রচনা করেছিলেন। 'রোগ বিনিশ্চয়' বা 'নিদান গ্রন্থের প্রণেতা মাধব সম্ভবত বাঙালি ছিলেন। 'চরক’ ও ‘সুশ্রুত এর টীকাকার চক্রপাণি দত্ত এ যুগেই আবির্ভূত হন। তিনি চরকের ওপর ‘চিকিৎসা সংগ্রহ' ও 'আয়ুর্বেদ দীপিকা' নামক টীকাভাষ্য রচনা করেন। চরকের ওপরে লেখেন 'ভানুমতী' নামক টীকা। তাঁর অন্য দুটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হল 'শব্দচন্দ্রিকা' ও ‘দ্রব্যগুণ সংগ্রহ'। সম্ভবত, ‘রত্নপ্রভা' নামক টীকাভাষ্যের লেখক নিশ্চলকর একজন বাঙালি এবং তিনি রামপালের সমসাময়িক ছিলেন। সুরেশ্বর বা সুরপাল নামক বৈদ্যক দ্বাদশ শতকে ‘শব্দ-প্রদীপ'ও ‘বৃক্ষায়ুর্বেদ' নামে দুটি গ্রন্থ লেখেন। এগুলিতে তিনি বিভিন্ন উদ্ভিদের ভেষজ গুণ ব্যাখ্যা করেন। এ ছাড়া লোহার ব্যবহার সম্পর্কে তিনি লেখেন 'লোহ-সর্বস্ব' নামক একটি গ্রন্থ।


সংস্কৃত ভাষায় বৈদিক সাহিত্যের চর্চার কাজেও আদি-মধ্যযুগের অবদান স্মরণীয়। মীমাংসার ওপর টীকা লেখেন ভবদেব ভট্ট। এই গ্রন্থের নাম ‘তৌতালিক-মত-তিলক'। উত্তর রাঢ় অঞ্চলের লেখক নারায়ণ বৈদিক ধর্মানুষ্ঠান বিষয়ে ‘প্রকাশ' নামক টীকা লেখেন। ভবদেব ভট্টও দশকর্মপদ্ধতি বিষয়ে লেখেন 'ছান্দোগ্য কর্মানুষ্ঠান পদ্ধতি' গ্রন্থ। দ্বাদশ শতকে আবির্ভূত বিশিষ্ট বাঙালি সাহিত্যকার ছিলেন জীমূতবাহন। হিন্দুসমাজ ও পরিবারের পালনীয় আচার-অনুষ্ঠান এবং ভূসম্পত্তির অধিকার ও বণ্টন সম্পর্কে তিনি মহামূল্যবান গ্রন্থ লেখেন। 'কালবিবেক' গ্রন্থে তিনি হিন্দু আচারের অন্তর্গত অনুষ্ঠানের কাল ও তিথি সম্পর্কে আলোচনা করেন। তবে তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় গ্রন্থের নাম 'দায়ভাগ'। এই গ্রন্থে তিনি বাংলাদেশের ভূসম্পত্তির বণ্টন, উত্তরাধিকার, স্ত্রীধন ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মবিধি সংকলিত করেন। বর্তমান উত্তরাধিকার আইন প্রবর্তনের আগে পর্যন্ত বাংলায় জীমূতবাহনের আইন অনুসারেই সম্পত্তির বণ্টন চলত। ভারতের অবশিষ্ট অঞ্চলে প্রচলিত ছিল ‘মিতাক্ষরা’ আইন। জীমূতবাহনের আর একটি বিশিষ্ট গ্রন্থ ‘কালবিবেক'।


পালযুগে বৌদ্ধধর্ম হিন্দুতন্ত্রবাদের সংস্পর্শে এসে রূপান্তরিত হয় এবং 'সহজযান' বা 'সহজিয়া ধর্ম নামে প্রচারিত হয়। ‘সহজিয়া’ বৌদ্ধধর্মের ওপর অসংখ্য গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এদের অনেকগুলির রচয়িতা বাঙালি ছিলেন। তিব্বতীয় ভাষায় এই সকল সংস্কৃত সাহিত্যের অনুবাদ পাওয়া যায়। এই সাহিত্যসৃষ্টির কেন্দ্র ছিল নালন্দা, বিক্রমশীলা, সোমপুরী প্রভৃতি বৌদ্ধবিহার। বিশিষ্ট বাঙালি লেখকদের মধ্যে ছিলেন শীলভদ্র, শান্তিদেব, জেতারি, জ্ঞানমিশ্র প্রমুখ। জ্ঞানমিশ্র ন্যায়দর্শনের ওপর ‘কার্যকারণ ভাব-সিদ্ধ' নামক গ্রন্থ লেখেন। বিশিষ্ট পণ্ডিত দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান বৌদ্ধ দর্শনের ওপর প্রায় ১৬৮টি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। শীলভদ্রের গ্রন্থ 'আর্য বুদ্ধভূমি-ব্যাখ্যান'তিব্বতীয় ভাষায় অনূদিত হয়ে সংরক্ষিত আছে।


সেনযুগে (একাদশ-দ্বাদশ শতক) সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের পুনরুজ্জীবন ঘটেছিল। পালযুগের শেষদিকে অপভ্রংশ ও বাংলা ভাষায় সহজিয়া সাহিত্যের যে জনপ্রিয়তা দেখা গিয়েছিল, সেনদের আমলে তাতে ভাটা পড়ে এবং পুনরায় সংস্কৃত সাহিত্যে নবজীবন ঘটে। বৌদ্ধ পালরাজাদের আনুকূল্যে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের দাপটে হিন্দুধর্মও আবার বাংলায় অনেকটাই নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছিল। তাই সেনরাজাদের আনুকূল্যে একাধিক সংস্কৃত সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে হিন্দুধর্মাচরণ পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করার প্রয়াস দেখা যায়। অশৌচ, শ্রাদ্ধ, সন্ধ্যা তর্পণ প্রভৃতি বিষয়ে হিন্দু-নিত্যকর্মের উল্লেখ করে অনিরুদ্ধ ভট্ট রচনা করেন 'হারলতা’ ও ‘পিতৃদয়িতা’ নামক গ্রন্থ। প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রের উদ্ধৃতি সংকলন করে রাজা বল্লালসেন স্বয়ং রচনা করেন 'দান-সাগর', 'অদ্ভুত-সাগর' 'প্রতিষ্ঠা-সাগর', 'ব্রত-সাগর’ ও ‘আচার-সাগর' নামক পাঁচটি গ্রন্থ। তবে কেবল প্রথম দুটি গ্রন্থ পাওয়া গেছে। হিন্দুর ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, দানকর্মাদি এবং মঙ্গল-অমঙ্গলের লক্ষণ ইত্যাদি এইসব গ্রন্থের আলোচ্য বিষয়। সাহিত্যিক হলায়ুধ রচনা করেন বৈদিক মন্ত্রের তাৎপর্য ও হিন্দুর আহ্নিক অনুষ্ঠান সম্পর্কিত গ্রন্থ 'ব্রাহ্মণ-সর্বস্ব'। এ ছাড়া শৈব-সর্বস্ব', 'মীমাংসা-সর্বস্ব’, ‘বৈষ্ণব-সর্বস্ব' ইত্যাদি একাধিক গ্রন্থ তিনি রচনা করেছিলেন। তবে এগুলি পাওয়া যায়নি। ভাষাতত্ত্বের ওপরেও এ সময় সংস্কৃত সাহিত্য রচিত হয়। ১১৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দে সর্বানন্দ রচনা করেন অমরকোষ গ্রন্থের ওপর বিশ্লেষণমূলক টীকা সর্বস্ব'। পুরুষোত্তম লেখেন 'ভাষাবৃত্তি’, ‘ত্রিকাণ্ড শেষ', 'হারাবলী', 'বর্ণদেশনা' প্রভৃতি গ্রন্থ। আদি মধ্যযুগের একেবারে শেষ পর্বে কবি ধোয়ী 'মেঘদূত' কাব্যের অনুকরণে লেখেন ‘পবনদুত’ কাব্য। জয়দেব ধোয়ীকে ‘কবিশ্বাপতি' (কবি-রাজ) ও 'শ্রুতিধর' বলে প্রশংসা করেছেন। লক্ষ্মণসেনের আমলের শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন জয়দেব। তাঁর অমর ও সর্বজনপ্রিয় গ্রন্থ 'গীতগোবিন্দ'। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, “আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যাবাদ দিলেও কেবলমাত্র ভাব ও রসের বিচারে এই গ্রন্থ সংস্কৃত সাহিত্যের একটি উৎকৃষ্ট কাব্য হিসেবে মর্যাদা পাবে।”


দাক্ষিণাত্যে রাষ্ট্রকূটদের আমলে (৮ম-১০ম শতক) এবং দক্ষিণ ভারতে চোলদের আমলে (৯ম ১৩ শতক) স্থানীয় কানাড়া ও তামিল ভাষার পাশাপাশি সংস্কৃত ভাষাতেও সাহিত্যচর্চা চলত। রাষ্ট্রকুট দরবারের বহু পণ্ডিত সুবন্ধু বা বাণভট্টের মতোই কাব্যচর্চা করতে পারতেন। আবার চোলযুগের বৈষ্ণবধর্ম-বিষয়ক গ্রন্থকারেরা সংস্কৃত ঘেঁষা তামিল ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করেন। এমনই একটি বৈষ্ণব সাহিত্য হল রামানুজের শিষ্য পিল্লন রচিত 'অরয়িরপ্পদি'। দ্বিতীয় রাজরাজ সংস্কৃত ও অভিধান রচনার জন্য কেশবস্বামিকে নিযুক্ত করেছিলেন। প্রথম পরন্তকের পৃষ্ঠপোষকতায় মাধব সংস্কৃত ভাষায় ঋগ্‌গ্বেদের ভাষায় রচনা করেন 'হরিদত্তাচার্য।


আদি-মধ্যযুগের তামিল সাহিত্য :

দক্ষিণ ভারতে তামিল, তেলেগু, কন্নড় ইত্যাদি আঞ্চলিক ভাষায় কাব্য ও সাহিত্যচর্চায় নতুন ধর্ম সম্প্রদায়গুলির বিশেষ অবদান ছিল। মূলত ধর্মদর্শন ও আচারকে কেন্দ্র করে স্থানীয় ভাষাসাহিত্যগুলি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। শৈব-নায়নার সাধকরা তামিল সাহিত্যে ভক্তিবাদের প্রচলন করেন। নম্বি আন্ডার-নম্বি শৈব রচনাগুলিতে এগারোটি তিরুমুরাই এ সংগ্রহ করেন। প্রথম সাতটির সংকলন ‘তেবারম’নামে পরিচিত। অষ্টমটির নাম ‘তিরুবাচকম্'।দশম তিরুমুরাই-এর লেখক তিরুমূল। ‘পেরিয়া পুরানম' নামক তামিল গ্রন্থের লেখক শেঙ্কিতার এখানে ৬৩ জন শৈব সাধকের জীবনী বর্ণনা করেন। এই নায়নার সাধকদের অনুসরণে কালক্রমে দক্ষিণ ভারতে ‘শৈব সিদ্ধান্ত’ নামক নতুন ধর্মমতের সৃষ্টি হয়েছিল। বিশিষ্ট শিবাচার্য উমাপতি এবং অরুনন্দি যথাক্রমে 'শিবজ্ঞান সিদ্ধিয়ার' এবং 'শিব প্রকাশম গ্রন্থে এই ধর্মসম্প্রদায়ের দর্শনতত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন। ত্রয়োদশ শতকের গোড়ায় মেইকন্দর রচনা করেন ‘শিব-ননবোদম্'।


ধর্মনিরপেক্ষ তামিল সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হল চোল রাজাদের প্রশস্তিগুলি। প্রথম রাজরাজকে কেন্দ্র করে 'রাজরাজেশ্বর নাটকম্' নামক একটি নাটক রচিত হয়। তাঁকে উপলক্ষ্য করে রচিত হয় ‘রাজরাজ বিজয়ম্' নামক একটি জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ। জৈন কবি তিরুত্তরুদেব দশম শতকের প্রথম দিকে ‘জীবক চিত্তামণি' নামে একটি কাব্য রচনা করেন। এটি তামিল সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য হিসেবে গণ্য হয়। তামিল সাহিত্যের বিশেষ জনপ্রিয় একটি গ্রন্থ হল কবি কঙ্গুবেলির 'বৃহৎকথা'র তামিল সংস্করণ। এ সময়েই কল্লদনর রচনা করেন 'কল্পদম' নামক শিবস্তোত্র। তামিল কাব্যের 'ত্রিরত্ন' রূপে অভিহিত হন কম্বন, কুট্টন ও উগলেন্দি। কবি কম্বন তামিল ভাষায় 'রামায়ণ' রচনা করেন। এটি 'কম্ব-রামায়ণ' নামে পরিচিত। কম্বনের আরও দুটি জনপ্রিয় রচনা হল ‘সদকোপার' অনথাথি' এবং 'এরুলুপাথু’। কবি কুট্টন রাজা বিক্রম চোল, দ্বিতীয় কুলোতুঙ্গ এবং দ্বিতীয় রাজরাজের সভা অলংকৃত করেছিলেন। তিনি রাজকাহিনিকে বিষয়বস্তু করে কাব্য রচনা করেন। যুদ্ধ ও শান্তি বিষয়ে তাঁর কাব্যগ্রন্থ হল ‘পরনিস' ও ‘উলাস'। কুট্রনের সমসাময়িক ছিলেন উগলেন্দি। নল-দময়ন্তীর উপাখ্যানকে অবলম্বন করে তিনি তামিল ভাষায় রচনা করেন 'নল-বেম্ব' কাব্য। তাঁর অন্য কয়েকটি বিশিষ্ট রচনা হল ‘পভলাকোড্ডি', ‘কলাম্বকম’, ‘অগ্নি-অরাসনি' প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ। প্রথম কুলোতুঙ্গের রাজত্বকালের শেষদিকে তাঁর সভাকবি জয়গোন্দর কলিঙ্গ যুদ্ধের কাহিনি নিয়ে রচনা করেন ‘কলিঙ্গত্তু-প্ররনী' কাব্য।


চোলযুগে তামিল ভাষায় অভিধান, ব্যাকরণ, ছন্দ ইত্যাদি য়েও বহু সাহিত্য রচিত ।। তৃতীয় কুলোতুঙ্গের আমলে 'নরুল' নামে একটি তামিল ব্যাকরণ লেখেন পবননন্দী। ছন্দের প্রয়োগ ও বৈচিত্র্য সম্পর্কে ‘ইয়প্পরুঙ্গলম্' নামক গ্রন্থ লেখেন জৈন সন্ন্যাসী অমিত সাগর। আনুমানিক দশম শতকের শেষদিকে এটি রচিত হয়েছিল। বীর রাজেন্দ্রর শাসনকালে বুদ্ধমিত্র রচনা করেন অলংকার-বিষয়ক গ্রন্থ ‘বীরসোলিয়ম্'। জনৈক অজ্ঞাতনামা লেখক দণ্ডীর কাব্য অনুসরণে লেখেন ‘দণ্ডীয় মঙ্গলম্' কাব্য। দশম শতকে আভাই (Avvai) নামক একজন মহিলা কবির রচনা পাওয়া গেছে। তাঁর প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির নাম 'নাসুরকোভাই', কালভিয়াল্লুকম্', 'অনন্ত মিলমলাই' ইত্যাদি। তাঁর রচনার বিষয়বস্তু ছিল সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, বিরহ-ভালোবাসা, দ্বেষ-হিংসা ইত্যাদি মানবিক আবেগ ও অনুভূতি। এ কারণে তিনি ‘তামিল কাব্যের জননী' নামে অভিহিত হন।


আদি-মধ্যযুগের কানাড়া সাহিত্য :

তামিল সাহিত্যের পরেই দক্ষিণ ভারতের প্রাচীনতম ভাষা-সাহিত্য হিসেবে কানাড়া (কন্নড়/Kannada) ভাষার নাম উচ্চারিত হয়। আদি-মধ্যযুগের সূচনার আগেই কানাড়া ভাষায় সমৃদ্ধ সাহিত্যচর্চা ঘটেছিল বলে মনে করা হয়। জৈন, বীর শৈব ও শ্রীবৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সাধকরা তাঁদের মতাদর্শ প্রচারের কাজে কানাড়া ভাষাকে বেছে নিয়েছিলেন। তাঁদের রচনাবলি কানাড়া ভাষা ও সাহিত্যকে গণমুখী হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। রাষ্ট্রকূটরাজ প্রথম অমোঘবর্ষ (নৃপতুঙ্গ) রচিত 'কবি রাজমার্গ (৮৫০ খ্রিঃ) ছিল কানাড়ি ভাষায় রচিত আদি অলংকার শাস্ত্র-বিষয়ক গ্রন্থ। এই গ্রন্থের ভাষ্য অনুসারে কাবেরী নদী থেকে গোদাবরী পর্যন্ত এই ভাষার জনপ্রিয়তা ছিল। অর্থাৎ মারাঠিভাষী অঞ্চলের অনেকটার ওপরেও এই ভাষার প্রসার ঘটেছিল। তবে কানাড়া ভাষার প্রথম উচ্চ গুণমানসম্পন্ন সাহিত্য সৃষ্টি করেন শিবকোটি (৯০০ খ্রিঃ)। 'ভদ্দারাধনা' গ্রন্থে তিনি গদ্যাকারে জৈন সাধকদের জীবনী তুলে ধরেন। রাষ্ট্রকুটরাজ তৃতীয় কৃষ্ণের অধীনস্থ সামন্ত দ্বিতীয় অরিকেশরীর সভাসদ পম্প ছিলেন দশম শতকের বিখ্যাত কানাড়া কবি। মাত্র ঊনচল্লিশ বছর বয়সে তিনি ‘আদি পুরাণ' ও বিক্রমার্জ্জন বিজয়’ নামক দুটি কাব্য সম্পূর্ণ করেন। প্রথমটিতে আদি জৈন তীর্থংকরের জীবন ইতিহাস ব্যাখ্যা করেন এবং দ্বিতীয় কাব্যের বিষয়বস্তু মহাভারত। এখানে তিনি প্রভু অরিকেশরীকে অর্জুনের প্রতিরূপ হিসেবে তুলে ধরেন। পম্প'র শিষ্য পোন্ন ১৬ জন তীর্থংকরের জীবনী নিয়ে রচনা করেন 'শাস্তিপুরাণ'। সংস্কৃত ও কানাড়া ভাষায় গভীর ব্যুৎপত্তির জন্য তৃতীয় কৃষ্ণ পোন্নকে 'উভয়কবি চক্রবর্তী' (Supreme poet in two languages) অভিধায় ভূষিত করেন। দশম শতকের আর একজন প্রখ্যাত কানাড়া কবি ছিলেন রন্ন। রন্ন, পম্প ও পোন্ন ছিলেন কানাড়া সাহিত্যের 'তিন রত্ন' (The Three Gems)। রন্ন এক সামান্য চুড়িবিক্রেতার গৃহে জন্মগ্রহণ করেও, নিজ সাহিত্য প্রতিভার বলে চালুক্যরাজ দ্বিতীয় তৈল ও তাঁর পরবর্তী শাসকদের সভাকবি পদে বৃত হন এবং 'কবিচক্রবর্তী' উপাধিতে ভূষিত হন। দ্বিতীয় তীর্থংকরের জীবনীকে ভিত্তি করে তিনি ‘অজিত পুরাণ' রচনা করেন (৯৯৩ খ্রিঃ)। মহাভারতে ভীম ও দুর্যোধনের যুদ্ধকে ভিত্তি করে লেখেন 'সাহস-ভীম' কাব্য। তাঁর অন্য কয়েকটি জনপ্রিয় কাব্যসৃষ্টি হল 'পরশুরাম চরিত', 'চক্রেশ্বর চরিত', 'রন্নকাণ্ড’, ‘কবিরত্ন' ইত্যাদি। জনৈক চবুন্দরায় ২৪ জন জৈন তীর্থংকরের ঐতিহ্যকে অবলম্বন করে ৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে রচনা করেন ‘চবুন্দ রায় পুরাণ’। এটি গদ্যে রচিত ছিল। দশম শতকের বিশিষ্ট কানাড়ি লেখক ছিলেন নাগবর্ম। তিনি ‘চন্দকবোধি’ ও ‘কর্ণাটক-কাদম্বরী' নামক গ্রন্থ রচনা করেন। একাদশ শতকে কানাড়া সাহিত্যের বিশিষ্ট প্রতিনিধি ছিলেন দুর্গার্সিংহ। তিনি গুণধ্যায়ের ‘বৃহৎকথা' অবলম্বনে রচনা করেন ‘পঞ্চতন্ত্র'। তাঁরই সমসাময়িক লেখক ছিলেন চন্দ্ররাজ। ‘মদন-তিলক’গ্রন্থে তিনি কথোপকথনের ছলে কাহিনি উপস্থাপন করেছেন। এই গ্রন্থে তিনি আধুনিক কন্নড় ভাষা (পোসা-কানাড়া) ব্যবহার করেছেন বলে দাবি করা হয়। ১০২৫ খ্রিস্টাব্দে শৈবসাধক চাবুন্দ রায় রচনা করেন 'লোকপকার’গ্রন্থ। এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু ছিল জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতিষ, ভাস্কর্য, স্থাপত্য, অসুখ ও তার প্রতিকার ইত্যাদি দৈনন্দিন জীবন সম্পর্কে পথনির্দেশিকা উপদেশ। জৈন ব্রাহ্মণ শ্রীধরাচার্য কানাড়া ভাষায় সর্বপ্রথম জ্যোতির্বিদ্যা-বিষয়ক গ্রন্থ 'ফাটক-তিলক’ রচনা করেন ১০৪৯ খ্রিস্টাব্দে। জনৈক সামন্ত-সঙ্গ উদয়াদিত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় একাদশ শতকের সত্তরের দশকে নাগবর্মাচার্য 'চন্দ্রচূড়ামণি শতক’গ্রন্থ রচনা করেন। দ্বাদশ শতকের গোড়ায় জৈন সাধক নাগচন্দ্র রচনা করেন ‘মল্লিনাথ পুরাণ'। তবে তাঁর অধিক জনপ্রিয় কাব্যটির নাম 'রামচন্দ্র চরিত পুরাণ’। এখানে জৈন তীর্থংকররূপে রামচন্দ্রকে ব্যাখ্যা করা হয়। এই গ্রন্থের কাব্যসুষমার বিচারে নাগচন্দ্রকে ‘অভিনব-পম্প’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। জৈন কবি ব্রহ্মশিব ‘সময় পরীক্ষা'গ্রন্থ প্রকাশ করে অন্যান্য ধর্মসম্প্রদায়ের ওপরে জৈনধর্মকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। একই সময় কীতিবর্মা রচনা করেন পশুচিকিৎসা বিষয়ক গ্রন্থ ‘গোবৈদ্য'। ১১৪৫ খ্রিস্টাব্দে কর্ণপারয় লেখেন বাইশতম তীর্থংকরের জীবনভিত্তিক গ্রন্থ ‘নেমিনাথপুরাণ’। প্রায় একই সময়ে দ্বিতীয় নাগবর্মা কানাড়া ব্যাকরণ ও অলংকার শাস্ত্রের ওপর রচনা করেন 'কাব্যাবলোকন' গ্রন্থ। কানাড়া ভাষার ওপরে তাঁর আর একটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হল 'কর্ণটিক ভাষা ভূষণ'। চোলবংশীয় যুবরাজ উদয়াদিত্য ১১৫০ খ্রিস্টাব্দে কাব্যশৈলী সম্পর্কে আলোচনামূলক গ্রন্থ ‘উদয়াদিত্যলংকার’ রচনা করেন।


আদি-মধ্যযুগের তেলেগু সাহিত্য :

দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্র অঞ্চলের ভাষা তেলেও। প্রাথমিক পর্বে তেলেগু ভাষা কানাড়া ভাষার পাশাপাশি থেকে পথচলা শুরু করে এবং একে অপরের পরিপূরক হিসেবে টিকে থাকে। কানাড়া ভাষার দুই দিকপাল লেখক পম্প ও পোন্ন তেলেগু দেশের সন্তান ছিলেন। আবার বিখ্যাত তেলেগু কবি নিজেকে কানাড়া ভাষার কবি বলেই দাবি করতেন। আদি তেলেগু ভাষার চর্চা শিলালিপিতেই শুরু হয়েছিল। নবম শতকের মাঝামাঝি সময়ে পাণ্ডুরঙ্গের দানপত্রে উন্মত্ত তেলেগু ভাষার প্রয়োগ দেখা যায়। ড. নীলকণ্ঠ শাস্ত্রীর মতে, অলিখিত অবস্থায় অবশ্যই তখন নিত্যজীবনের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, আনন্দ, ভালোবাসা-বিষয়ক বহু কবিতা সৃষ্টি হয়েছিল। দেশি ও কথ্য ভাষায় রচিত এই সকল কবিতা নিশ্চয়ই খুব জনপ্রিয় ছিল। যেমন—দোলনার গান 'লালিমাতালু' প্রত্যুষের গান 'সেলুকোলু পুলু' উৎসবের গান 'মঙ্গলহরতুলু' উপাসনার গান 'কীর্তনলু' শয্যের গান 'উর্দুপু-পাতালু ইত্যাদি।


‘মার্গ' ধারায় তেলেগু ভাষাচর্চার দৃষ্টান্ত একাদশ শতকের আগে পাওয়া যায়নি। সংস্কৃত ভাষা প্রভাবিত মার্গ তেলেগু সাহিত্যের আদি পর্বের কোনো সাহিত্য উদ্ধার করা যায়নি। বর্তমান তেলেগু ভাষায় সাহিত্যচর্চার প্রথম উদাহরণ হল নান্নয়া-কৃত মহাভারতের অনুবাদ। চোলরাজার উদ্যোগে নান্নয়া একাদশ শতকে এই কাজে হাত দেন। তাঁর প্রধান সহযোগী ছিলেন কবি নারায়ণ ভট্ট। তবে নান্নায় মহাভারতের আদি ও সভাপর্ব সম্পূর্ণ করতে পারেন। বন পর্বের আংশিক তিনি অনুবাদ করেন। অবশ্য এই কাব্যে তিনি হুবহু মহাভারত অনুসরণ না করে তাঁর নিজের কল্পনা ও বিশ্বাসকে প্রকাশ করেন। নান্নয়া রচিত তেলেও ব্যাকরণের নাম ‘অন্ধ্র-শব্দ-চিন্তামণি'। এই গ্রন্থে তিনি তেলেগু শব্দে চয়ন ও তার শৃঙ্খলাবদ্ধ প্রয়োগের দিক নির্দেশ করেন। এইজন্য তিনি ‘ভাগানুশাসন' (Law-giver of the language) উপাধি পান। নান্নয়ার সমসাময়িক ছিলেন ভীমকবি। তাঁর জীবনী ও কর্মধারা সম্পর্কে নানা অলৌকিক কাহিনি প্রচলিত আছে। তিনি ব্যাকরণগ্রন্থ 'কবিজনশ্চর্য’ ও ভীমেশ্বর দেবকে কেন্দ্র করে 'ভীমেশ্বর পুরাণ' রচনা করেন। রামায়ণ ও মহাভারত অনুসরণে তিনি লেখেন 'রাঘব-পাণ্ডবীয়' কাব্য। দ্বাদশ শতকে তেলেগু দেশে বীর শৈবধর্মের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। এই সম তেলেগু কবিরা অধিকাংশই বীর শৈবধর্মমত প্রচারের উদ্দেশ্যে কাব্যচর্চা করেন। মল্লিকার্জুন পণ্ডিত তাঁর ‘শিব-তত্ত্ব স্মরম' গ্রন্থে শৈবধর্ম ব্যাখ্যা করেন। তাঁর শিষ্য নানচোড় রচনা করেন 'কুমারসম্ভব’মহাকাব্য। নানচোড় তাঁর কবিতায় কানাড়া ও তামিল শব্দের সম্মিলিত প্রয়োগ ঘটান।


আদি-মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য :

সংস্কৃত ভাষা থেকে স্বাভাবিক বিবর্তনের মাধ্যমে পালি, প্রাকৃত, অপভ্রংশ শৌরসেনী ও অন্যান্য দেশীয় ভাষার উৎপত্তি হয়েছে। স্বভাবতই বাংলা ভাষার জঠরও সংস্কৃত ভাষা। তবে বাংলা ভাষার সৃষ্টির নির্দিষ্ট সময় সম্পর্কে এখনো গবেষণা অব্যাহত আছে। সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, আদি মধ্যযুগে বাংলা ভাষার প্রথম সূচনা হয়। বাংলা ভাষার প্রথম প্রয়োগ দেখা যায় চর্যাপদে। পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালে ‘বৌদ্ধচর্যাপদ’ বা ‘চর্যাগীতি'র সংকলন আবিষ্কার করে সেগুলিকে 'চর্যাচর্য বিনিশ্চয়' নামে পুনঃপ্রকাশ করেন। এগুলিকেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন বলে মনে করা হয়। ড. শহীদুল্লার মতে, চর্যাপদগুলি সপ্তম শতকে রচিত হয়েছিল। কিন্তু ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন যে, এগুলির রচনাকাল দশম শতক। এ সময় বাংলা ও বাংলার বাইরে শৌরসেনী অপভ্রংশ ভাষার ব্যাপক প্রয়োগ ছিল। এর পাশাপাশি প্রাচীন বাংলা ভাষার ব্যবহারও চলছিল। ধীরে ধীরে বাংলা ভাষা পরিশীলিত হয়ে সাহিত্যের উপযোগী হয়ে উঠে। একই লেখকের সৃষ্টিতে একই সময়ে শৌরসেনী অপভ্রংশও বাংলা ভাষার কাব্যচর্চার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা দোঁহা ও চর্যাপদগুলির রচয়িতা। মোট ৫০টি প্রাচীন বাংলায় লেখা চর্যাপদের সন্ধান পাওয়া যায়। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা অপভ্রংশ ভাষার চর্যাপদ রচনা করে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের গুহ্য নীতিগুলি জনগণের মধ্যে প্রচার করেন। ড. মজুমদার লিখেছেন : “চর্যাপদগুলিকে বাংলা সাহিত্যের আদিম উৎস বলা যেতে পারে। এর প্রভাবেই পরবর্তী যুগের বাংলায় সহজিয়া গান, বৈষ্ণব পদাবলী, শক্তি ও বাউল গানের সৃষ্টি হয়েছে।” চর্যাপদগুলি নিছক সাহিত্য হিসেবে উচ্চমানের অবশ্যই নয়। জটিল ও দুর্বোধ্য দর্শনতত্ত্বের চাপে এর সাহিত্যগত সৌন্দর্য বিকাশের সুযোগ পায়নি। তবে এদের মধ্যে মাঝে মাঝে প্রকৃতি কবিত্ব, আবেগ, অনুভূতির যুগ্ম প্রকাশ ইত্যাদি লক্ষ্য করা যায়।


চর্যাপদ ছাড়াও সমকালীন বাংলা ভাষায় রচিত কিছু গ্রন্থের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। চালুক্যরাজ তৃতীয় সোমেশ্বরের আমলে (১১২৭-১১৩৮ খ্রিঃ) রচিত ‘মানসোল্লাস' গ্রন্থের ‘গীত-বিনোদ’ অধ্যায়ে বিভিন্ন দেশীয় ভাষায় রচিত কিছু গীত সন্নিবিষ্ট আছে। এখানে শ্রীকৃষ্ণের লীলা-বিষয়ক কিছু গীত আছে, যা বাংলা ভাষায় রচিত। কবি জয়দেবের গীত গোবিন্দ' কাব্যের কবিতাগুলিতে প্রাচীন বাংলা ও শৌরসেনী অপভ্রংশ বা মাগধী অপভ্রংশের ভাষার অনুরূপ ভাষার ব্যবহার দেখা যায়। বস্তুত, আদি মধ্যযুগের কাল সীমায় অর্থাৎ দ্বাদশ শতকের পূর্ববর্তীকালে সহজিয়া চর্যাপদগুলি ছাড়া প্রাচীন বাংলা ভাষার কোনো সাহিত্যের নিদর্শন পাওয়া যায় না। পরবর্তীকালে (১৩ ও ১৪ শতকে) এই মাগধী অপভ্রংশ ভাষাকে পরিশীলিত রূপদানের মাধ্যমেই উন্নত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সৃষ্টি হয়।


আদি-মধ্যযুগের মারাঠি সাহিত্য :

বাংলা ভাষার মতো মারাঠি ভাষা ও সাহিত্যচর্চার আদি নিদর্শন পাওয়া যায় ‘লেখ’-সমূহ থেকে। এ ছাড়া অষ্টম ও দ্বাদশ শতকের মধ্যবর্তীকালে মহারাষ্ট্রে জনপ্রিয় নতুন ধর্মসম্প্রদায়ের তত্ত্ব ও দর্শন ব্যাখ্যাকে কেন্দ্র করে বহু সাহিত্য রচনা করা হয়েছিল। দশম শতকে শ্রবণবেলগোলা (৯৮৩ খ্রিঃ) লেখটি মারাঠি ভাষায় খোদিত হয়। নাথ ধর্মসম্প্রদায়ের জনপ্রিয় আচার্য গোরক্ষনাথের জীবন ও দর্শনকে বিষয়বস্তু করে অনেকগুলি পুঁথি মারাঠা ভাষায় রচিত হয়েছিল। গোরক্ষনাথের মহিমাভিত্তিক মারাঠি ভাষার একটি গান পাওয়া যায়। মারাঠি গদ্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হল 'গোরক্ষনাথ সংবাদ 'নামক গ্রন্থটি। সেকালের প্রখ্যাত ব্যাখ্যাকার ছিলেন জ্ঞানদেব। তিনি মারাঠি ভাষায় বেদ, গীতা ইত্যাদি প্রাচীন শাস্ত্রের ব্যাখ্যা করেন। 'ভগবদগীতা'র ব্যাখ্যা করে লেখা তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থটি হল ‘জ্ঞানেশ্বরী'। উপনিষদের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে তিনি রচনা করেন ‘অমৃতানুভব’ গ্রন্থ। দ্বাদশ শতকে মারাঠি সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য লেখক ছিলেন মুকুন্দরাজ। তিনি ছিলেন সংস্কারক শংকরাচার্যের অনুগামী ও সুপণ্ডিত। তাঁর সর্বাধিক জনপ্রিয় গ্রন্থ ‘বিবেক সিন্ধু' দ্বাদশ শতকের শেষদিকে (আনুঃ ১১৯০ খ্রিঃ) রচনা করেন। দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের ওপর তিনি মারাঠি ভাষায় আরও কিছু গ্রন্থ লেখেন। আদি-মধ্যযুগের শেষ পর্বে এবং ত্রয়োদশ শতক ও পরবর্তী দুই শতকে মহারাষ্ট্রে তথা পশ্চিম ভারতে ধর্মসম্প্রদায়গুলির দর্শনতত্ত্বকে বিষয়বস্তু করে মারাঠা ভাষায় বহু গ্রন্থ রচিত হয়।


আদি-মধ্যযুগের আদি-মধ্যযুগের শিল্পচর্চা :

প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে শিল্পচর্চার ঐতিহ্য অব্যাহত আছে। কালের করালগ্রাসে প্রাচীন ও আদি-মধ্যযুগের প্রায় অধিকাংশ শিল্পকর্ম হারিয়ে গেছে। অতীতের সাক্ষী হয়ে পড়ে আছে কিছু জঙ্গলাকীর্ণ ধ্বংসাবশেষ। পূর্ব ভারতের স্তূপ, বিহার ইত্যাদি এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের মন্দির স্থাপত্যের কিছু কিছু ক্ষীয়মান নিদর্শন থেকে ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিকরা ভারতীয় শিল্প-ঐতিহ্যের ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। প্রাচীন যুগ ও আদি-মধ্যযুগের সংযোগকালে ভারত পরিভ্রমণরত চৈনিক পর্যটক ফা-হিয়েন, হিউয়েন সাঙ প্রমুখ ভারতের শিল্পধারার যে বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন, তাতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, তখন ভারতে এবং বিশেষভাবে পূর্ব ভারতে বহু বিচিত্র ও কারুকার্যখচিত স্তূপ, বিহার, প্রাসাদ, মন্দির ইত্যাদি নির্মিত হয়েছিল। রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, "প্রাচীন প্রশস্তিকারের উচ্ছ্বসিত ভাষায় যে সকল বিশাল গগনস্পর্শী মন্দির 'ভূ-ভূষণ', 'কুল-পর্বত-সদৃশ' বা ‘সূর্যের গতিরোধকারী' বলে বর্ণনা করেছেন, আজ তাদের চিহ্নমাত্র নেই।”