আদি-মধ্যযুগে ভারতের ধর্মতত্ত্ব ও ধর্মসম্প্রদায়

আদি-মধ্যযুগে ভারতের ধর্মতত্ত্ব ও ধর্মসম্প্রদায়:

আদি-মধ্যযুগে ভারতের ধর্মভাবনা ও ধর্মাচারের ব্যাপক সংস্কার ও পরিবর্তন ঘটলেও; সার্বিক ধর্মসহিষ্ণুতা ও ধর্মীয় সহাবস্থানের বৈশিষ্ট্য অব্যাহত থাকে। সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতকের শেষ পর্যন্ত সময়কালে শৈব, বৈষ্ণব, বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের রূপান্তর ও উত্থান-পতন লক্ষ্য করা যায়। এই পর্বে হিন্দুধর্মের প্রতীক হিসেবে শিব ও বিষ্ণুর জনপ্রিয়তা যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনি বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের ক্রমাবনতি ঘটতে থাকে। অবশ্য খ্রিস্টীয় দশম শতক পর্যন্ত দক্ষিণ ভারতে জৈনধর্মের প্রসার অক্ষুণ্ণ থাকে। কিন্তু বৌদ্ধধর্ম প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং শেষ মুহূর্তে হিন্দুধর্মের নানা বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করে কোনোক্রমে বিহার ও বাংলাদেশে টিকে থাকে। কিন্তু সেন রাজবংশের শাসনকালে বাংলায় ব্রাহ্মণ্যধর্ম বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে বৈদিক ধর্ম ও পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্ম দুই-ই ছিল। তবে পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্মের অন্তর্ভুক্ত শৈবধর্ম ও বৈষ্ণবধর্মের ব্যাপক জনপ্রিয়তা বৈদিক ধর্ম ও দেবদেবীকে আড়াল করে দেয়। শিব ও কৃষ্ণ সামনের সারিতে অধিষ্ঠিত হন। এঁদের পাশাপাশি শাক্ত দেবতা, শৈব দেবদেবী যেমন দুর্গা, কার্তিক, গণেশ, বৈদিক দেবতা বৃহস্পতি, গঙ্গা, যমুনা, কুবের, অগ্নি প্রমুখের আরাধনাও চলত। শক্তিপূজার ভিত্তি হল সৃষ্টির কারণ হিসেবে নারীশক্তির আরাধনা। শক্তিপূজার প্রভাব বৌদ্ধ মহাযানবাদের ওপরেও দেখা যায়। সেখানে প্রাচীন বুদ্ধদেবের সঙ্গিনী হিসেবে তারাদেবীর উপাসনা শুরু হয়। হিন্দুধর্মে শক্তিদেবী স্বরূপিণী রূপে দুর্গা, সরস্বতী, কালীদেবীর আরাধনা শুরু হয়।


খ্রিস্টীয় অষ্টম ও নবম শতকে বৌদ্ধধর্ম কেবলমাত্র পূর্ব ভারতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। বাংলার পাল রাজারা ছিলেন বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক। অষ্টম শতকে পূর্ব ভারতে বৌদ্ধধর্মের বিপুল জনপ্রিয়তাকে বৌদ্ধধর্মানুরাগী পাল রাজবংশের উত্থান ও প্রতিষ্ঠার অন্যতম উপাদান রূপেও গ্রহণ করা হয়। একইভাবে দশম শতকে পাল রাজবংশের অবসানের ফলে বৌদ্ধধর্মের সামাজিক ভিত্তিও দুর্বল হয়। বৌদ্ধধর্মের শাখা হিসেবে হীনযান ও মহাযানবাদের উদ্ভব ঘটেছিল খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে। গুপ্তযুগে মায়াবিদ্যা ও যৌন অতীন্দ্রিয়বাদের আদিম তত্ত্ব বৌদ্ধ দর্শনকে প্রভাবিত করেছিল। বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বদের পত্নী তারাগণের আরাধনা এই সময় জনপ্রিয় হয়েছিল। এখন আদি-মধ্যযুগের সূচনায় খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে মহাযানবাদের সাথে মোহিনী অতিন্দ্রীয়বাদের ধারণার সংযোগ ঘটলে বৌদ্ধধর্ম জটিলতর হয়ে ওঠে। এখন বৌদ্ধরা বিশ্বাস করেন যে, মোহিনী শক্তি আয়ত্ত করে যোগাভ্যাস দ্বারা কাম্যবস্তু লাভ করা সম্ভব। এই শক্তিকে বলা হত 'বজ্র'। তাই বৌদ্ধধর্মের নতুন শাখা হিসেবে 'বজ্রযানের' আবির্ভাব হয়। বজ্রযানের আচারগত স্বাতন্ত্র্য থেকে 'সহজযান'ও 'কালচক্রযান'-এর উদ্ভব হয়। সেন রাজবংশের শাসনকালে বাংলায় ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনরাভ্যুদয় ঘটে। ফলে ভারতে বৌদ্ধধর্মের শেষ আশ্রয় বিহার ও বাংলাদেশ থেকেও বৌদ্ধধর্মের অপসারণ ঘটে। দ্বাদশ শতকের পরবর্তীকালে শাক্তধর্মের সাথে বৌদ্ধ রহস্যবাদের মিশ্রণের ফলে নাথ, অবধূত, বাউল ইত্যাদি লোকায়ত ধর্মের মাঝে বৌদ্ধধর্ম কোনোক্রমে বেঁচে থাকে। ক্রমে এই গুহ্য বৌদ্ধ মতবাদ তার পৃথক অস্তিত্ব হারিয়ে তান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্যধর্মের সাথে একাকার হয়ে চলতে থাকে। খ্রিস্টীয় অষ্টম-নবম শতকে যথাক্রমে কুমারিল ভট্ট (৭০০ খ্রিঃ) এবং শংকরাচার্য (৭৮৮-৮২০ খ্রিঃ) হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবন ঘটান। সুসংস্কৃত হিন্দুধর্মের দার্শনিক আবেদনের কাছে পথভ্রষ্ট বৌদ্ধধর্ম গুরুত্বহীন প্রতিভাত হতে থাকে। মহাযান বৌদ্ধ মতবাদে মূর্তিপূজা, বহুদেববাদে বিশ্বাস ইত্যাদিকে গ্রহণ করার ফলে হিন্দুধর্মের সাথে বৌদ্ধ মহাযানবাদের মৌল পার্থক্য অনেকটাই কমে যায়। অন্যদিকে ব্রাহ্মণ্যধর্মে বৌদ্ধধর্মের মূলনীতিগুলি এ সময় গৃহীত হয়েছিল। অহিংসা, আত্মনিবেদন, সত্যাচার ইত্যাদি ব্রাহ্মণ্যধর্মে প্রাধান্য পেয়ে বৌদ্ধধর্মের আকর্ষণ শিথিল হয়ে যায়। হিন্দু ‘দশাবতারতত্ত্বে' বুদ্ধকে অন্যতম অবতাররূপে গ্রহণ করার ফলে উভয় মতবাদের মূলগত প্রভেদ হ্রাস পায়। এইভাবে হিন্দুধর্মের মধ্যে বৌদ্ধধর্মের আত্মীকরণ ঘটে।


আদি-মধ্যযুগে উত্তর ও পশ্চিম ভারতে জৈনধর্মও ক্রমিক-অবক্ষয়ের শিকার হয়েছিল। পশ্চিম ভারতে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে জৈনধর্ম তখনও টিকেছিল। গুজরাটের চালুক্যবংশ জৈনধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এই সময়ে রাজপুতানায় আবু পাহাড়ে দিলওয়ারা জৈনমন্দির নির্মিত হয়। প্রতিহার ও পরমার রাজারাও জৈনধর্মের অনুগামী ছিলেন। মালবে পরমার রাজাদের উদ্যোগে মহাবীর ও অন্যান্য জৈন তীর্থংকরদের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়। নবম ও দশম শতকে জৈনধর্মের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। দক্ষিণের একাধিক রাজবংশ জৈনধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। রাষ্ট্রকূট রাজা প্রথম অমোঘবর্ষ নৃপতুঙ্গ সম্ভবত জৈনধর্মের অনুরাগী ছিলেন। কর্ণাটকের গঙ্গরাজারা জৈনধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তাঁদের উদ্যোগে দক্ষিণ ভারতের নানাস্থানে বহু জৈন মন্দির (বদি) ও স্তম্ভ নির্মিত হয়। জৈনতীর্থরূপে খ্যাত শ্রবণবেলগোলায় বিশাল জৈন মূর্তিটি আদি-মধ্যযুগেই স্থাপিত হয়। জৈনধর্মের সর্বপ্রাণীবাদ, জিনের প্রতি অবিচল আনুগত্য সাধারণ মানুষের আবেগকে আপ্লুত করে। জৈনধর্মের চারটি দান বিদ্যা, খাদ্য, আশ্রয় ও ঔষধ জৈনধর্মকে জনপ্রিয় করে তোলে। হরিভদ্র, বপ্পভট্টি, শোভন, ধনপাল প্রমুখ জৈন লেখক জৈনধর্মের কল্যাণকামী আদর্শাবলি প্রচার করেন। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে শৈব ও বৈষ্ণবধর্মের জনপ্রিয়তা জৈনধর্মের ভিত্তি শিথিল করে দেয়। পরবর্তী চালুক্যদের আমলে জৈনধর্মের প্রসার প্রায় স্তব্ধ হয়ে থাকে। শৈবধর্মের পৃষ্ঠপোষক চোল ও পাণ্ড্যরা জৈনদের ওপর পীড়ন চালাতেও দ্বিধা করেননি। মাদুরাই মন্দিরের দেওয়াল চিত্রে জৈনদের ওপর দমন-পীড়নের ছবি পাওয়া যায়। অনুচিত হয় যে, পাণ্ড্যরাজা সুন্দর পাণ্ড্য আট হাজার জৈনকে হত্যা করেছিলেন। সর্বোপরি ছিল হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান। হিন্দুধর্মের আত্মীকরণের প্রভাব জৈনধর্মকেও স্পর্শ করেছিল। তবে বৌদ্ধধর্মের তুলনায় অন্তত ভারতের অভ্যন্তরে জৈনধর্মের অবস্থা কিছুটা ভালো। কয়েকটি ভারতীয় জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে জৈনধর্মের প্রভাব আজও বিদ্যমান।


বৈদিক ব্রাহ্মণ্যধর্মের সূচনা ও প্রসারের পথিকৃৎ ছিল উত্তর ভারত। কিন্তু বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের দাপটে ব্রাহ্মণ্যধর্ম যখন শক্তিহীন হয়ে পড়ে, তখন নবম-দশম শতকে ব্রাহ্মণ্য হিন্দুধর্মের পুনরুত্থানে নেতৃত্ব দেয় দক্ষিণ ভারত। সতীশ চন্দ্র লিখেছেন, "উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে দুটি ধারায় হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবন ও প্রসার ঘটে। একদল বেদ ও বৈদিক পূজাপদ্ধতির ওপর নতুন করে জোর দেন। অন্যদল উত্তর ভারতে তন্ত্রসাধনা ও দক্ষিণ ভারতে ভক্তিবাদের কথা বলেন। প্রথম দলের আন্দোলন ছিল জ্ঞানভিত্তিক। হিন্দুধর্মের দর্শনতত্ত্ব বিশ্লেষণ ও প্রচার করে মানুষকে ধর্মমুখী করতে সচেষ্ট হন।" শংকরাচার্য, রামানুজ প্রমুখ যুক্তি-তর্ক, টীকাভাষ্য রচনা ইত্যাদির মাধ্যমে ধর্মীয় ঐতিহ্যের পুনঃপ্রকাশ ঘটান। এঁদের আন্দোলন ছিল পুঁথিগত, দর্শনভিত্তিক ও জ্ঞাননির্ভর। অন্যদিকে ভক্তিবাদী সাধকেরা দর্শনতত্ত্বের জটিলতা বর্জন করে মানুষের হৃদয়ের সাথে ঈশ্বরের যোগসাধনের কথা প্রচার করেন।


দক্ষিণ ভারতে ভক্তি আন্দোলনের সূচনা করেন বৈষ্ণব আলবার (আড়বার) ও শৈব নায়নার সাধকরা। তাঁরা প্রচার করেন যে, ধর্ম নিছক আচারসর্বস্ব প্রাণহীন আনুষ্ঠানিক পূজাৰ্চনা নয়। ধর্ম হল এক গভীর সুখানুভূতি, যে অনুভূতি ঈশ্বর ও ভক্তের মধ্যে প্রাণময় প্রেমের বন্ধন সৃষ্টি করে। আলবার ও নায়নার সাধকরা সহজ, সরল কথ্যভাষায় তাঁদের মত প্রচার করেন। তেলেগু ও তামিল ভাষায় তাঁরা ভক্তিগীতি রচনা করেন এবং নানা স্থান পরিভ্রমণ করে প্রেম ও ভক্তির বাণী প্রচার করেন। তাঁরা জাতিভেদ মানতেন না। তাঁরা দৃঢ়তার সাথে প্রচার করেন যে, ঈশ্বর কোনো বিশেষ জাতি বা বর্ণের নয় ; ঈশ্বর সকল মানুষের। তাই জাতিধর্মনির্বিশেষে সকল মানুষই আন্তরিক প্রেম ও ভক্তি দ্বারা ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করতে সক্ষম। অবশ্য ভক্তিবাদীরা সরাসরি জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা করেননি। ভক্তি সাধকদের মধ্যে ব্রাহ্মণরা যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন নিম্নবর্ণের মানুষেরাও। বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের বহু অনুগামী ভক্তিবাদের আশ্রয় নেন। কোনো ধর্মীয় সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত নয় এমন উপজাতিভুক্ত বহু মানুষও ভক্তিবাদের অনুগামীতে পরিণত হন। এঁরা ইতিপূর্বে পশু, প্রকৃতি ইত্যাদি উপজাতীয় দেবদেবীর পূজা করেন। এখন এই সকল দেবদেবী শিব ও বিষ্ণুর সঙ্গিনী রূপে গৃহীত হন। ভক্তিধর্মের সর্বজনীন আদর্শ বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের বিলুপ্তি ত্বরান্বিত করে।


বৈষ্ণব আলবারদের উদ্যোগে দক্ষিণ ভারতে বৈষ্ণব ভক্তিবাদ সপ্তম থেকে নবম শতকের মধ্যে বহুল জনপ্রিয়তা পায়। ঐতিহ্য অনুসারে তামিল অঞ্চলে বারোজন আলবার সাধক জন্মেছিলেন। এঁরা হলেন পোইগই বা সরযোগী, ভূতাত্তা বা ভূতযোগী, যোই বা মহদযোগী, তিরুমঢ়িশাই বা ভক্তিসার, নন্মাঢ় বা শকটকোপ, কুলশেখর, মধুরকবি, পেরিয়াঢ়বার বা বিষ্ণুচিত্ত, আণ্ডাল বা গোদা। ইনি ছিলেন বিষ্ণুচিত্তের কন্যা। তিনি নিজেকে গোপীরূপে কল্পনা করে প্রেমিক হিসেবে বিষ্ণু রঙ্গনাথের ভজনা করতেন। অবশিষ্ট আলবার সাধকরা ছিলেন তোগুরডিপ্পোরি, তিরুপ্পন বা যোগীবাহন। শেষ আলবার সাধকের নাম তিরুমঙ্গই বা পরকাল। এঁদের মধ্যে প্রথম চারজন পল্লব রাজ্যে জন্মেছিলেন। শেষের তিনজন জন্মেছিলেন চোলরাজ্যে। বাকি সবাই ছিলেন পাণ্ড্যরাজের সন্তান। তবে আলবার সাধকদের প্রায় সবাই সমাজের নিম্নশ্রেণি থেকে উঠে এসেছিলেন।


আলবার সাধকরা গীত রচনা ও জনগণের মধ্যে তা প্রচার করে বৈষ্ণবধর্ম প্রচার করতেন। 'প্রবন্ধম্' নামক প্রাচীন তামিল সাহিত্য সংকলন থেকে আলবার সাধকদের সংগীতচর্চার বিবরণ জানা যায়। এই সংকলনে আলবার সাধকদের রচিত ৪ হাজারেরও বেশি সংগীত স্থান পেয়েছে। সর্বশেষ আলবার সাধক তিরুমঙ্গই একাই রচনা করেছিলেন ১৩৬১টি সংগীত। একাদশতম সাধক তিরুপ্পন লিখেছেন মাত্র ১০টি সংগীত। পঞ্চম আলবার নম্মাঢ় ১৩০০-র বেশি গীত রচনা করেছেন। এঁদের সংগীতে লীলাকীর্তন স্থান পেয়েছে।


বৈষ্ণব আলবারদের অনুরূপ দক্ষিণ ভারতে ভক্তিবাদী শৈবধর্মের প্রচার করে শৈব-নায়নার সাধকবৃন্দ। এঁরা তামিল ভাষায় ভক্তিগীতি রচনা করে শৈবধর্মকে আধ্যাত্মিকতাবিশিষ্ট ধর্মভাবনা হিসেবে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। ঐতিহ্য অনুসারে নায়নার সাধকের সংখ্যা ৬৩ জন। এঁদের মধ্যে সর্বাধিক খ্যাতিমান ছিলেন সাধক তিরুমুলর। ষষ্ঠ শতকে আবির্ভূত এই নায়নার সাধক ৩ হাজারেরও বেশি শ্লোক রচনা করেছেন। তাঁর 'তিরুমন্দিরম্' গ্রন্থে 'পতি-পশুনাথ' নামক শৈব-সিদ্ধান্ত মতবাদের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তাঁর মতে, শৈব গ্রন্থ 'আগম-সিদ্ধান্ত 'বেদের মতোই ঈশ্বরের বাণী। অন্যান্য সাধকদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন অপ্পর (৬০০-৮১ খ্রিঃ), সম্বন্দর (৬৪৪-'৬০ খ্রিঃ), মাণিক্যবাচকর (৬৬০-৯২ খ্রিঃ), সুন্দরর (৭১০-৩৫ খ্রিঃ) প্রমুখ। অপ্পর বিরচিত মোট ৩১৩টি পদের পরিচয় পাওয়া গেছে। সম্বন্দর বেঁচেছিলেন মাত্র ১৬ বছর। অথচ এই অল্প সময়ে তিনি ১০ হাজারের বেশি পদ রচনা করে আপন প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। তবে এদের অধিকাংশই পাওয়া যায়নি। মাত্র ৩৮৫টি পদ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। মাণিক্যবাচকর জীবন শুরু করেছিলেন পাণ্ড্যরাজ্যের মন্ত্রী হিসেবে। শেষ পর্যন্ত মন্ত্রিত্ব ও রাজনীতি । করে সাধকের জীবন বেছে নেন। তিন শৈব-সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করে বহু পদ রচনা করেছেন। সুন্দরর রচিত ভক্তিগীতিগুলি খুবই জনপ্রিয়তা পায়। মন্দিরের প্রার্থনা সংগীত হিসের তাঁর পদাবলি আজও গীত হয়। তামিল শৈব সাহিত্য ‘পেরিয়াপুরম' গ্রন্থে ৬৩ জন শৈবসাধকের জীবনী ও কীর্তি লিপিবদ্ধ করা আছে। এঁদের মধ্যে উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ যেমন আছেন, তেমনি আছেন অস্পৃশ্য ব্যাধজাতির মানুষও। শৈব-নায়নার সাধক পদে তাঁতি, জেলে, ধোপা, তেলি ইত্যাদি নিম্নবর্ণের মানুষের অধিষ্ঠান ভারতের জাতিবর্ণভিত্তিক সমাজব্যবস্থার ভাঙনের নিদর্শন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।


ভক্তিবাদের পাশাপাশি দ্বাদশ শতকে দক্ষিণ ভারতে ‘লিঙ্গায়েত আন্দোলন' জনপ্রিয়তা অর্জন করে। লিঙ্গায়েত আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন শ্রীবাসব ও তাঁর ভাগিনেয় চম্নবাসব। তাঁরা কর্ণাটকের কলচুরি রাজসভায় ছিলেন। জৈনদের সাথে মতবিরোধের পর তাঁরা এই নতুন মতবাদ প্রচার করেন। লিঙ্গায়েতরা আদতে ছিলেন শিবের উপাসক এবং শিবের প্রতীক হিসেবে শিবলিঙ্গের উপাসনা করতেন। এরাও জাতিভেদ প্রথাকে অস্বীকার করেন এবং উপবাস, তীর্থযাত্রা, পশুবলি ইত্যাদি বর্জন করেন। সামাজিক সংস্কারের দিকেও তাঁরা নজর দেন। বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ ইত্যাদি প্রথার বিরোধিতা এবং বিধবাবিবাহের সমর্থনে লিঙ্গায়েতরা জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা চালান। ভক্তি আন্দোলনের মতো ব্যাপকতা না-পেলেও লিঙ্গায়েত সম্প্রদায় মধ্যযুগের ধর্মসংস্কারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন বলে স্বীকার করা হয়।


আলবার (আড়বার) ও নায়নার সাধকদের প্রয়াসে শিব ও বিষ্ণুর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেলে প্রায় নিষ্প্রভ হিন্দুধর্মের পুনরুত্থানের সম্ভাবনা তৈরি হয়। ভক্তিবাদীদের সহজ-সরল ধর্মমতের জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করে হিন্দু সংস্কারকদের মধ্যেও আলোড়ন সৃষ্টি হয়। হিন্দু ধর্মদর্শনের জটিলতত্ত্ব যে তার অ-জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ এই সত্য স্পষ্ট হয়। এই অবস্থায় শংকরাচার্য, রামানুজ, মাধ্ব প্রমুখ হিন্দু দর্শনের সকল অস্পষ্টতা দূর করে বৈদিক দর্শনকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করেন। একদিকে আলবার ও নায়নার সাধকদের ভক্তিবাদ, অন্যদিকে বৈদিক দর্শনের সরল ব্যাখ্যা বৈদিক হিন্দুধর্মকে শক্তিশালী করে। তানুমানিক অষ্টম শতকের শেষে বা নবম শতকের গোড়ায় কেরলে শংকরাচার্যের জন্ম হয়। তাঁর জীবনী সম্পর্কে বহু লোককাহিনি প্রচলিত আছে। কথিত আছে, জৈনদের অত্যাচারে তিনি মাদুরাই থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এরপর উত্তর ভারতে গিয়ে তিনি বিভিন্ন ধর্মপণ্ডিতকে তর্কযুদ্ধে পরাজিত করেন। সারাদেশে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এরপর তিনি পুনরায় মাদুরাইতে ফিরে আসেন এবং সহজ-সরল ভাষায় বৈদিক দর্শন ব্যাখ্যা করেন। তিনি বৈদিক ধর্মতত্ত্বের অস্পষ্টতা ও অসংগতি দূর করে তার নতুন ও সর্বজনগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দেন। শংকরাচার্যের দর্শন ‘অদ্বৈতবাদ’ বা ‘দ্বিতীয় রহিত মতবাদ’ নামে পরিচিত। শংকরাচার্যের মতে, ঈশ্বর ও তাঁর সৃষ্ট জগৎ অভিন্ন। বাহ্যত যে পার্থক্য প্রতীয়মান হয়, তার মূলে আছে মানুষের অজ্ঞানতা। ব্রহ্ম (আত্মা অচৈতন্য) একমাত্র সত্য, জগৎ মিথ্যা। অজ্ঞানতাবশত জীব তার স্বরূপ বিস্মৃত হয়। জ্ঞানের উদয় হলে জীব ব্রহ্মের সাথে তার অভিন্নতা পলব্ধি করতে সক্ষম হয়। তিনি বলেন, বেদই সত্য জ্ঞানের চরম উৎস। অদ্বৈতবাদের উৎস বেদান্ত বা উপনিষদ। অদ্বৈতবাদের বিরুদ্ধে জৈন সাধুরা নিরন্তর প্রচার চালান। শংকরাচার্য ভারতের সর্বত্র পরিভ্রমণ করে অদ্বৈতবাদ প্রচার করেন। 'ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্য', 'গীতাভাষ্য’, ‘বিবেক চূড়ামনি'প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করে তিনি জীব ও আত্মার অভিন্নতার মৌলিক তত্ত্ব প্রচার করেন। দেশের চারপ্রান্তে চারটি মঠ প্রতিষ্ঠা করে তিনি অদ্বৈতবাদ প্রচারের দায়িত্ব দেন। এই মঠগুলি হল— উত্তরে হিমালয়ের কোলে যোশী মঠ, দক্ষিণে শৃঙ্গেরী মঠ, পূর্বে নীলাচলে জ্যোতি মঠ এবং পশ্চিমে দ্বারকায় সারদা মঠ। এই মঠগুলি বৈদিক হিন্দুধর্ম প্রচারের কাজে রত আছে। শংকরাচার্য প্রধানত জ্ঞানযোগের গুরুত্ব দেন। জ্ঞানার্জনকে ঈশ্বরলাভের পথ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু জ্ঞানযোগের গভীর তত্ত্ব সাধারণ মানুষকে তেমনভাবে আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয়। অতঃপর রামানুজ ভক্তিবাদের সাথে হিন্দু দর্শনের যোগসাধন ঘটান। তিনি দর্শনতত্ত্বে জ্ঞানের পরিবর্তে অন্তরের ভক্তিকেই ঈশ্বরলাভের উপায় হিসেবে তুলে ধরেন।


আলবার সম্প্রদায় প্রচারিত ভক্তিবাদকে অবলম্বন করে তামিল দেশে বৈষ্ণবধর্ম জনপ্রিয় হয়েছিল। নাথমুনি ও রঙ্গনাথাচার্য শ্রীবৈষ্ণব সম্প্রদায়ের প্রবক্তা ছিলেন। নাথমুনির পৌত্র যামুনাচার্য শ্রীবৈষ্ণব সম্প্রদায়ের তাত্ত্বিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর রচিত ‘সিন্ধিত্রয়’, ‘আগম প্রামাণ্য', 'গীতার্থ সংগ্রহ, ‘মহাপুরুষ নির্ণয়’ ও ‘স্তোত্ররত্ন’ গ্রন্থে শ্রীবৈষ্ণব ধর্মের দর্শন আলোচিত হয়। দ্বাদশ শতকে রামানুজ (১০১৬-১১৩৭ খ্রিঃ) ‘বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ’ প্রচার করেন। তিনি 'গীতাভাষ্য', 'বেদান্তসার', 'বেদান্তসংগ্রহ' ইত্যাদি গ্রন্থ রচনা করেন। এই মত অনুসারে চিৎ ও অচিৎ সর্ববস্তুর উৎস হলেন ব্রহ্ম। ব্রহ্ম সর্বভূতে বিরাজমান। তিনি এক ও অদ্বিতীয়। তবে ব্রহ্মের তিন প্রকার রূপভেদ আছে—ভোক্তা, ভোগ্য ও প্রেরিতা। এই তিন নিত্য সত্তা হল ‘চিৎ' (জীবাত্মা), ‘অচিৎ' (জড়জগৎ) ও ‘ঈশ্বর'। দ্বাদশ শতকে অন্ধ্রপ্রদেশের তেলেগু ব্রাহ্মণ নিম্বার্ক ‘সনকাদি সম্প্রদায়' প্রতিষ্ঠা করেন। এই সম্প্রদায়ের দর্শনতত্ত্ব ‘দ্বৈতাদ্বৈতবাদ' নামে পরিচিত। এই মতানুসারে ঈশ্বর, জীব ও জড় জগৎ একই সময়ে পরস্পর থেকে অভিন্ন ও ভিন্ন। শ্রীবৈষ্ণব সম্প্রদায়ের উপাস্য দেবতা বিষ্ণু এবং সনকাদি সম্প্রদায়ের প্রধান দেবতা হলেন গোপী-জন বল্লভ গোপালকৃষ্ণ। আদি-মধ্যযুগের শেষের দিকে মাধ্ব দক্ষিণ ভারতে 'ব্রহ্ম সম্প্রদায়’ প্রতিষ্ঠা করেন। এঁরা দ্বৈতবাদে বিশ্বাসী। এঁদের মতে জীবাত্মা ও জড়জগৎ নিজে থেকে কিছু ঘটাতে পারে না। তাই এরা পরতন্ত্রী, এই শক্তি আছে একমাত্র ব্রহ্মের। তাই তিনি ‘স্বতন্ত্র'। মাধ্বপন্থীদের উপাস্য দেবতা বিষ্ণু ও তাঁর শক্তি লক্ষ্মী।


আদি-মধ্যযুগের বহু আঞ্চলিক ভারতীয় শাসক শৈবধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বাংলার সেনবংশীয় লক্ষ্মণ সেন, গাহড়বাল রাজা গোবিন্দচন্দ্র চালুক্যরাজ, মূলরাজ প্রমুখ শৈব ছিলেন। বৈষ্ণবধর্মের মতো শৈবধর্মও একেশ্বরবাদী। উভয় ধর্মই ভক্তিবাদী। আদি-মধ্যযুগে উভয় ধর্মের ক্ষেত্রেই বেদান্তের ‘দ্বৈত’ ও ‘অদ্বৈত’-বাদী দর্শন গুরুত্ব পেয়েছিল। হরপ্পা-সংস্কৃতির আমল থেকেই বহু ও বিচিত্র ধারার সমন্বয়ে শৈবধর্ম আদি-মধ্যযুগ ও মধ্যযুগে রূপ পরিগ্রহ করেছে। মহাভারতের ভাষ্য অনুযায়ী উমাপতি শিব শ্রীকণ্ঠ পাশুপত ধর্মের প্রবর্তক। ষষ্ঠ শতকের বহু রাজা ও রাজবংশ যেমন যশোবর্মন, মিহিরকুল, বকাটক বংশ, বলভীর মৈত্রকবংশ, গুপ্তরাজা দেবগুপ্ত, বিষ্ণুগুপ্ত প্রমুখ পাশুপত ধর্মের উপাসক ছিলেন। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে উত্তর ভারত, পশ্চিম ভারত ও পূর্ব ভারতের উড়িষ্যায় পাশুপত ধর্মের যথেষ্ট জনপ্রিয়তা ছিল। হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণ এই বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণ করে। ৯৪৩ ও ১১০৩ খ্রিস্টাব্দের দুটি লেখ থেকে কর্ণাটকে পাশুপত ধর্মের জনপ্রিয়তার কথা জানা যায়। সপ্তম শতকে চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর একটি তাম্রশাসন থেকে নাসিক অঞ্চলে 'কালামুখাদি' সম্প্রদায়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। পাঞ্জাবের কাংড়া জেলার সমকালীন যার একটি লেখ থেকে জানা যায় যে, 'নির্মন্ধ' নামক স্থানে কপালেশ্বর শিবের একটি মন্দির ছিল এবং সেখানে অথর্ববেদী শৈব ব্রাহ্মণরা বসবাস করতেন। অধ্যাপক নীলকণ্ঠ শাস্ত্রীর মতে, খ্রিস্টীয় নবম, দশম ও একাদশ শতকে দক্ষিণ ভারতের বহু স্থানে ‘কালামুখ' সম্প্রদায়ের বিশেষ প্রতিপত্তি ছিল। দশম-একাদশ শতকে মধ্য ভারতের ত্রিপুরি এলাকায় ‘মত্তময়ূর' নামক একটি শৈব সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল। মহাভারতে উল্লিখিত ‘মত্তময়ূর' নামক উপজাতির নামানুসারে এই সম্প্রদায়ের নামকরণ হয়েছে বলে অনুমান করা হয়। এই সম্প্রদায়ের ঈশান শিব বিরচিত (একাদশ শতক) 'ঈশান শিব গুরুদেব পদ্ধতি' গ্রন্থ থেকে ‘মত্তময়ূর' সম্প্রদায়ের দর্শনতত্ত্ব জানা যায়। সম্ভবত, এঁরা যোগসাধনায় বিশ্বাসী ছিলেন। ড. নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতে, এঁরা নানারকম জনসেবামূলক কাজকে ধর্মের অংশ হিসেবে বিবেচনা করতেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, আদি-মধ্যযুগে দক্ষিণ ভারতে শৈব-নায়নার সাধকদের আবির্ভাব ঘটেছিল। তিরুমুলর, অপ্পর, সম্বন্দর, মাণিক্যবাচক (৬৬০-৬৯২ খ্রিঃ), সুন্দরর (৭১০-৭৩৫ খ্রিঃ) প্রমুখ সাধককবি এই ভক্তিবাদকে জনমুখী করে তোলেন। এই নায়নার সাধকদের রচনাবলির ওপর ভিত্তি করে দক্ষিণ ভারতে ‘শৈব সিদ্ধান্ত' নামে আর একটি মতবাদ গড়ে ওঠে। মোকণ্ডদেব, অরুনন্দি, উমাপতি প্রমুখ ছিলেন এই মতের প্রধান প্রবক্তা। অরুনন্দি রচিত ‘শিবজ্ঞান সিদ্ধিয়ার’ এবং উমাপতির ‘শিবপ্রকাশম্' গ্রন্থে এই নতুন মতবাদের তাত্ত্বিক দিকটি আলোচিত হয়েছে। এই মতে, ঈশ্বর স্বয়ং শিব যিনি স্বেচ্ছায় জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহার করেন। তিনি সকল পরিণামের উৎস, কিন্তু তিনি নিজে পরিণামের অধীন নন। জগৎ সৃষ্টির প্রধান উপকরণ হল ‘মায়া'। শিব তাঁর চিৎ-শক্তির মাধ্যমে মায়ার ওপর ক্রিয়া করেন। ধর্মাচরণের দিক থেকে শৈব সিদ্ধান্তিকরা ভক্তিবাদী। তাঁদের মতে, চর্যা, ক্রিয়া, যোগ ও জ্ঞানের দ্বারা আত্মার মুক্তি হয়। এই চারটি মার্গ অতিক্রম করলে ‘শিবত্ব' উপলব্ধি হয়। এই শিবত্বই হল 'মুক্তি' বা 'মোক্ষ'। মুক্তি অর্জনের চারটি স্তর হল— 'সালোক্য' 'সামীপ্য’, ‘সারূপ্য এবং 'সাযুজ্য'।


একাদশ-দ্বাদশ শতক থেকে দক্ষিণ ভারতে ‘আগমান্ত শৈবধর্ম' নামে আর একটি মতবাদের উদ্ভব ঘটে। চোলরাজারা আগমাস্ত শৈবদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এই মতের সাধকরা 'তন্ত্র' দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। এঁরা জাতিপ্রথার বিরোধিতা করেন। গুরুকরণ ও দীক্ষা এঁদের ধর্মাচারের আবশ্যিক কর্ম বিবেচিত হত। এঁরাও 'পতি' (শিব) 'পশু' (জীব), ও 'পাশ' (বন্ধন)—এই ত্ৰিতত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। নবম শতকে কাশ্মীরে শৈববাদের উদ্ভব হয়। ‘শিবসূত্র' গ্রন্থের প্রণেতা বসুগুপ্ত কাশ্মীর শৈববাদের প্রবক্তা ছিলেন। ত্রিতত্ত্বের দিকে ঝোঁক আছে বলে এটি 'ত্রিক' নামে অভিহিত হয়। এই ত্রিতত্ত্ব হল পতি (শিব), পাশ (শক্তি) ও পশু (অনু)। কাশ্মীর শৈববাদে শিব হলেন বিশুদ্ধ চৈতন্য, চরম অভিজ্ঞতা ও পরমেশ্বর। তিনি সকল জীবনের আত্মাস্বরূপ, অপরিবর্তনীয় ও পূর্ণ। শিব তাঁর শক্তির মধ্য দিয়ে বিশ্বজগতের প্রকাশ ঘটান। এই শক্তি পাঁচ প্রকার— চিৎ, আনন্দ, ইচ্ছা, জ্ঞান ও ক্রিয়া।


আদি-মধ্যযুগে ভারতে ধর্মচিস্তার দুটি বিশিষ্ট দিক ছিল শাক্ত ধর্ম ও তন্ত্রবাদের প্রসার। বস্তুত, সুপ্রাচীনকাল থেকেই ভারতে এই দুটি ধারার অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। শাক্তধর্মের উৎস আদিম যুগে মাতৃকাদেবীর পূজা ও আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে পাওয়া যায়। ড. নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য লিখেছেন যে, শাক্তধর্ম ও তন্ত্র'কে অভিন্ন ভাবা সঠিক নয়। অবশ্য তন্ত্র অতি প্রাচীন হলেও অধিকাংশ তান্ত্রিক গ্রন্থ মধ্যযুগে রচিত হয়েছে। শাক্তধর্মে সর্বোচ্চ দেবতা একজন নারী। তিনি নানা নামে ও নানা রূপে কল্পিত হন। প্রাচীন যুগে কাত্যায়নী, কন্যাকুমারী—শক্তির আধার রূপে বন্দিত হতেন। তেমনি গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর ভারতে দুর্গা, উমা, গৌরী, কালী—শাক্ত দেবীরূপে প্রচার পেয়েছেন। উড়িষ্যার জগন্নাথ উপাসনায় 'সুভদ্রা'; বৈদান্তিক বৈষ্ণবদের বিচারে ‘বৈষ্ণবী’ বা ‘লক্ষ্মী’, নিম্বার্ক ; শ্রীচৈতন্য সম্প্রদায়ের কাছে 'রাধা' এই শক্তির প্রতীক হিসেবে পূজিতা হন। ঈশ্বর ও শাক্তধর্মের মূলতত্ত্ব একই। প্রভেদ একটিই। শৈবধর্মে পুরুষের প্রাধান্য এবং শাক্তধর্মে প্রকৃতির প্রাধান্য। বীর শৈবধর্মে শক্তির প্রাধান্য এত বেশি যে, দার্শনিকরা এটিকে ‘শক্তি বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ' বলে বর্ণনা করেন।


রোমিলা থাপারের মতে, তন্ত্রবাদের জন্ম ষষ্ঠ শতকে, তবে তান্ত্রিক পদ্ধতির প্রচলন শুরু হয় অষ্টম শতকে। অনেকের মতে, তন্ত্রবাদ হল বৈদিক মতবাদের সরল সংস্করণ। উত্তর-পূর্ব ভারতে তন্ত্রবাদের প্রভাব বেশি লক্ষ্য করা যায়। তীব্বতীয় পূজা-পদ্ধতি ভারতীয় তন্ত্রবাদকে অনেকটাই প্রভাবিত করেছে। তান্ত্রিক পূজা-পদ্ধতির বিশেষ অঙ্গ হল উপাসনা, রহস্যময় মন্ত্র, যাদুকরী প্রতীক এবং কোনো বিশেষ দেবতার আরাধনা। সকল বর্ণের মানুষ এবং নারী তন্ত্রবাদের চর্চা করার অধিকারী। তান্ত্রিক সাধনার তিনটি ধারা হল— পশু, বীর ও দিব্য। পশু হল সেই সকল জীবাত্মা যারা ষড় রিপুর অধীন। নৈতিক প্রচেষ্টা দ্বারা পশুর ‘বীর’ ভাব অর্জিত হয়। আর দিব্যস্তরে জীব সকল কলুষতামুক্ত হয়। পশুভাবের মানুষকে দিব্যভাবে উন্নীত করাই তন্ত্রের লক্ষ্য। এজন্য সাতটি আচার অনুশীলন করতে হয়। এগুলি হল— বৈষ্ণব, শৈব, দক্ষিণ, বাম, সিদ্ধান্ত ও কৌল। এগুলি শুচিতা, ভক্তি, জ্ঞান, উপলব্ধি ও মোক্ষের পর্যায়ে উন্নীত হতে সাহায্য করে। তন্ত্রে ‘গুরু’র প্রয়োজন সর্বাধিক। গুরু শিষ্যকে তার ‘কুল’ অনুসারে সঠিক পথের নির্দেশ দেন। নারীও গুরু হতে পারেন। শিষ্যের যোগ্যতা ও মানসিকতা অনুসারে তার দীক্ষা হয়, যেমন— ক্রিয়াদীক্ষা, বোধদীক্ষা, তত্ত্বদীক্ষা, শক্তিদীক্ষা, নামদীক্ষা ইত্যাদি। তন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল ‘মন্ত্র'। মন্ত্রশক্তি দু প্রকার—'বাচক’ ও ‘বাচ্য'। বাচক আসলে বাচ্যের স্বরূপ প্রকাশ করে। অর্থাৎ প্রথমটি জানার পদ্ধতি এবং দ্বিতীয়টি জানার বিষয়। তান্ত্রিক পূজা-পদ্ধতিতে দু-রকম রহস্যের অনুকরণ করা হয় – (১) পঞ্চ ম-কার সাধনা বা ‘পঞ্চতত্ত্ব' এবং (২) ‘ষটচক্রভেদ'। পঞ্চ ‘ম’-কার হল মুদ্রা, মৎস্য, মাংস, মদ্য ও মৈথুন। মুদ্রা ও মাংস যথাক্রমে শস্য ও প্রজননের প্রতীক। মাংস ও মদ্য সৃষ্টি উপাদান কারণের প্রতীক অর্থাৎ জীবনীশক্তি। ষট্ চক্রভেদ হল শক্তির নিজস্ব উৎসে প্রত্যাবর্তন। কায়-সাধনার দ্বারা কুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগ্রত করে নিম্নতর চক্রগুলির মধ্য দিয়ে 'সহস্রারে' অর্থাৎ শক্তির উৎসে তাকে পৌঁছে দেওয়া হয়। কেবল বামাচারী, সিদ্ধান্তচারী ও কৌলাচারীরা পঞ্চ ‘ম’-কার সাধনার অধিকারী হন। ড. রোমিলা থাপারের মতে, “তন্ত্রবাদের জন্ম হয়েছিল গোঁড়া হিন্দু পূজা-পদ্ধতি ও ব্রাহ্মণ শাসিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য।” তা ছাড়া তন্ত্রবাদে যাদুবিদ্যার প্রতি আগ্রহ থেকে নানা ধাতু ও রাসায়নিক বস্তু নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু হয় এবং তার ফলে কিছু কিছু আবিষ্কার সম্ভব হয়। তিনি মনে করেন যে, ত্রয়োদশ শতকে নিকৃষ্ট ধাতুকে সোনায় পরিণত করার যেসব পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছিল, তন্ত্রবাদ তা নিয়েও চর্চা করে।