খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি:

খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক বা তার আগে থেকেই ভারতে বিজ্ঞান সাধনার উল্লেখ পাওয়া যায়। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের শেষদিকে বিজ্ঞানের নানা শাখায় ভারতীয় জ্ঞানসাধক ও গবেষকদের অবদানের স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। গুপ্ত রাজবংশের রাজত্বকাল ভারতে গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র ও ভেষজ বিজ্ঞানে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছিল বলে জানা যায়। খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে গণিতবিদ্যা ও জোতির্বিদ্যার ব্যাপক চর্চা হয়। এই দুটি বিষয়ে বহু নতুন তথ্য ও তত্ত্ব আবিষ্কার করে আর্যভট্ট ও বরাহ মিহির সারাদেশে সাড়া ফেলে দেন। চিকিৎসাবিজ্ঞান ও ভেষজশাস্ত্রে অবিস্মরণীয় অবদান রেখে যান চরক ও সুশ্ৰুত। প্রাচীন যুগে বিজ্ঞানচর্চার এই সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে পাথেয় করে আদি-মধ্যযুগের পণ্ডিতরা গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, ভেষজ শাস্ত্র, রসায়ন ইত্যাদি বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হন।


গুপ্তযুগে গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের যে গভীর অনুশীলন শুরু হয়েছিল, আদি-মধ্যযুগে তা অব্যাহত ছিল। অষ্টম শতকের বিশিষ্ট গণিতকার ছিলেন শ্রীধর। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থের নাম 'গণিতসার'। এই গ্রন্থে তিনি শূন্যের বহুমাত্রিক ব্যবহার ও তার গুরুত্ব বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানের নাম অনুসন্ধানের কাজে গণিতের প্রয়োগ সম্পর্কে তিনি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেন। নবম শতকে গণিতের ওপর একটি মূল্যবান গ্রন্থ লেখেন মহাবীর। এর নাম 'সার সংগ্রহ'। এই গ্রন্থে তিনি দ্বিঘাত সমীকরণের ত্রিমুখী সমাধান, উপবৃত্ত, ভগ্নাংশ ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করেছেন। নবম শতকের আর একজন বিশিষ্ট গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিদ হলেন মুঞ্জাল। দ্বাদশ শতকে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'লঘুমানস' প্রকাশিত হয়। আরব পর্যটক আলবেরুণী তাঁর গ্রন্থে পণ্ডিত মুঞ্জালের প্রশংসা করেছেন। আয়নবিদ্যা, আয়ন গতিবেগ ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্তগুলি পরবর্তীকালের লেখকদের গবেষণায় বিশেষ সাহায্য করে। দ্বাদশ শতকের জ্যোতির্বিজ্ঞানী আচার্য ভাস্কর আয়ন গতি আলোচনার সময় মুঞ্জালের অবদান স্বীকার করেছেন। দশম শতকে ভট্টোৎপল রচনা করেন ‘গণিতস্কন্ধ’ নামক গ্রন্থ। তাঁর সমসাময়িক গণিতজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন বিজয়নন্দী, কল্যাণবর্মন প্রমুখ। এঁরা যথাক্রমে 'করণ তিলক' ও 'সারাবলী' নামক গ্রন্থ রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। আদি-মধ্যযুগে গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যার ওপর মহামূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন আচার্য ভাস্কর (১১১৪ খ্রিঃ)। তাঁর গ্রন্থের নাম ‘সিদ্ধান্ত শিরোমণি'। দু-খণ্ডে রচিত এই গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে তিনি লীলাবতী ও বীজগণিত সম্পর্কে আলোচনা করেন। দ্বিতীয় খণ্ডের বিষয়বস্তু হল জ্যোতির্বিদ্যা। এই গ্রন্থ দুটি গণিতশাস্ত্রের এক উল্লেখযোগ্য অবদানরূপে বিবেচিত হয়। ভাস্করাচার্যের আর একটি বিখ্যাত গ্রন্থ হল ‘করণকুতূহল'।


নবম শতকের বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী ছিলেন কনৌজের বলভদ্র। জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর অবস্থান সম্পর্কে তিনি একাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। পতঞ্জলীর যোগসূত্রের ওপরেও তিনি টীকা লেখেন। সম্ভবত, দশম শতকে জ্যোতির্বিজ্ঞানী দ্বিতীয় আর্যভট্ট আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থের নাম 'আর্য সিদ্ধান্ত'।

একাদশ শতকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর 'রাজমৃগাঙ্ক’ ও ‘ভাস্বতী' নামক দুটি মূল্যবান গ্রন্থ রচিত হয়। এদের রচয়িতা ছিলেন যথাক্রমে ভোজদেব ও শতানন্দ।


গুপ্তযুগে চিকিৎসাশাস্ত্রের ওপর ব্যাপক গবেষণা হয়েছিল। ভেষজ ও শল্য চিকিৎসা সম্পর্কে রচিত হয়েছিল একাধিক মূল্যবান গ্রন্থ। আদি-মধ্যযুগের ভারতেও চিকিৎসাশাস্ত্র রচনার সেই ধারা অব্যাহত ছিল। নবম থেকে ত্রয়োদশ শতকের মধ্যবর্তীকালে ভারতে অনেকগুলি চিকিৎসা-বিষয়ক গ্রন্থ রচিত হয়। নবম শতকে মাধবকর রচনা করেন ‘রোগ বিনিশ্চয়'গ্রন্থ। এটির জনপ্রিয় নাম ছিল 'মাধব-নিদান'। এই গ্রন্থে মাধব একাধিক রোগের লক্ষণ এবং তাদের নিরাময়ের উপায় সম্পর্কে পরামর্শ দিয়েছেন। পরবর্তীকালে আবির্ভূত লেখক চক্রপাণিদত্ত তাঁর গ্রন্থে ‘মাধব-নিদান' গ্রন্থের গুরুত্ব শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেছেন। নবম শতকের আর একজন ভেষজশাস্ত্রবিদ ছিলেন দুধবল। তিনি অগ্নিবেশ রচিত 'চরক সংহিতা' গ্রন্থের বিশ্লেষণ করেন। 'মাধব-নিদান' গ্রন্থকে অনুসরণ করে দশম শতকে রচিত হয় 'বৃন্দ মাধব’ বা ‘সিদ্ধিযোগ’ নামক গ্রন্থ। এর রচয়িতা ছিলেন সম্ভবত শ্রীবৃন্দ। ভেষজ থেকে ঔষধ প্রস্তুত সংক্রান্ত একটি মূল্যবান গ্রন্থ আদি-মধ্যযুগের গোড়ার দিকে রচিত হয়। 'অমরকোষ’গ্রন্থেও এই বইটির নাম পাওয়া যায়। সম্ভবত, অষ্টম শতকে বইটির পরিবর্তিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। এই বইটির নাম 'নিঘন্টু’ এবং লেখকের নাম 'ধন্বন্তরি'। ঔষধ প্রস্তুতের উপাদানরূপে পারদের ব্যবহার সম্পর্কে একটি মূল্যবান গ্রন্থ লেখেন নাগার্জুন। এই গ্রন্থের নাম ‘রস রত্নাকর'। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতে, এই গ্রন্থের রচনাকাল অষ্টম বা নবম শতক। কিন্তু উইন্টার নিজে মনে করেন এটি দশম শতকের আগে রচিত হয়নি।


একাদশ শতকের বিখ্যাত ভেষজশাস্ত্র রচয়িতা ছিলেন বাংলার চক্রপাণিদত্ত। বিভিন্ন রোগের উপসর্গ ও উপশম এবং ভেষজ দ্রব্যের রোগনিরাময়মূলক গুণাগুণ সম্পর্কে তিনি একাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। চরক ও সুশ্রুতের ভেষজ-বিজ্ঞানের ওপর তিনি যথাক্রমে ‘আয়ুর্বেদ-দীপিকা’ ও ‘ভানুমতী' নামক দুটি টীকা লেখেন। 'চিকিৎসাসার সংগ্রহ' নামক গ্রন্থে তিনি ভারতীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের ধারা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেন। চক্রপাণির ‘শব্দচন্দ্রিকা' গ্রন্থে বিভিন্ন উদ্ভিজ্জ ও ধাতুজ দ্রব্যের গুণাগুণ আলোচিত হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের উপযুক্ত পথ্যের বিবরণ দিয়ে তিনি লিখেছেন ‘দ্রব্যগুণ সংগ্রহ' নামক একটি গ্রন্থ। ঔষধ প্রস্তুতের ক্ষেত্রে ধাতুর ব্যবহার সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দিয়েছিলেন বাগভট্ট ও মাধব। এখন চক্রপাণিদত্ত ঔষধে ধাতুর ব্যাপক প্রয়োগ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করে উন্নতমানের ঔষধ প্রস্তুতের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেন। পালরাজা ভীমপালের চিকিৎসক সুরেশ্বর (শূরপাল) চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিশেষ কৃতিত্ব দেখান। সুরেশ্বরের পিতা ও পিতামহ সুচিকিৎসক ছিলেন। সুরেশ্বর তাঁর ‘শব্দপ্রদীপ’ ও ‘বৃক্ষায়ুর্বেদ' গ্রন্থ দুটিতে উদ্ভিদের গুণাগুণ সম্পর্কে আলোচনা করেন। এ ছাড়া 'লৌহপদ্ধতি'(বা 'লৌহ-সর্বস্ব') গ্রন্থে ঔষধ প্রস্তুতের উপাদান হিসেবে লৌহের প্রয়োগ ও উপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করেন। একাদশ শতকের মধ্যভাগে বঙ্গসেন রচনা করেন ‘চিকিৎসাসার সংগ্রহ'। এই গ্রন্থে তিনি মূলত সুশ্রুত ও মাধবকরের লেখাকে অনুসরণ করেছেন। দ্বাদশ শতকে ভগভট্ট রচনা করেন ‘রসার্ণব' গ্রন্থ। ত্রয়োদশ শতকে রচিত হয় ‘রসরত্ন সমুদ্বয়' নামক আরও একটি ধাতুর গুণ বিশ্লেষণমূলক গ্রন্থ। এটির রচয়িতা সম্ভবত জনৈক অশ্বিনীকুমার বা নিত্যনাথ। ধাতুজ দ্রব্যের ব্যবহারে বার্ধক্যকে প্রতিরোধ করার বিষয়ে এতে আলোকপাত করা হয়েছে। ত্রয়োদশ শতকের গোড়ার দিকে মিল্‌হন লেখেন ‘চিকিৎসামৃত' (১২২৪ খ্রিঃ) নামক গ্রন্থটি। একই সময়ে শারঙ্গধর লেখেন 'শারঙ্গধর সংহিতা'। এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু হল ঔষধ প্রস্তুতির ক্ষেত্রে আফিং ও পারদের প্রয়োগ পদ্ধতি। আদি-মধ্যযুগে পশু-চিকিৎসা বিষয়ক একটি গ্রন্থ লেখেন ভোজ। এই গ্রন্থের নাম ‘শলিহোত্র। এতে অশ্বের বিভিন্ন রোগের উপসর্গ ও তার নিরাময়ের জন্য ভেষজ প্রয়োগের বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে।


চিকিৎসাবিদ্যায় রসায়নের গুরুত্ব অসীম। আয়ুর্বেদশাস্ত্রের ভেষজ রসের সাথে ধাতুর রাসায়নিক বিক্রিয়া দ্বারা রোগপ্রতিষেধক আবিষ্কারের দিকে আদি-মধ্যযুগের লেখকদের যে আন্তরিকতা ছিল, তার নানা প্রমাণ পাওয়া যায়। পূর্ববর্তী আলোকপাতে আমরা দেখেছি যে, নবম থেকে ত্রয়োদশ শতকে রচিত বিভিন্ন গ্রন্থে রস-রসায়ন সম্পর্কে নানা বিষয় আলোচিত হয়েছে। শারঙ্গধরের 'সংহিতা'য় শারীরবৃত্ত ও রসায়নের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা আছে। পারদ, তামা, টিন, সিসা প্রভৃতি ধাতুর রাসায়নিক যোগ এবং মানবদেহে তাদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে তিনি আলোচনা করেছেন। বাগভট্ট, বৃন্দ ও চক্রপাণিদত্তের রচনায় রাসায়নিক পদার্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। নাগার্জুনের 'রসরত্নাকর' গ্রন্থে তামা, পিতল, ইত্যাদি ধাতু থেকে স্বর্ণ পরিণত করার প্রণালী আলোচিত হয়েছে। তিনি পেষণযন্ত্র, নালিকা, অধস্পাতন, পূর্বপাতন ইত্যাদি রাসায়নিক যন্ত্রপাতির কথাও উল্লেখ করেছেন।