রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও পরিধি [Nature and Scope of Political Science] | রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশ (Origin and Development of Political Science)

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও পরিধি


ভূমিকা

মানুষ সামাজিক জীব। এ উক্তি গ্রীক্ পণ্ডিত এ্যারিস্টটলের। তিনি বলেছেন: 'মানুষ মাত্রেই রাষ্ট্রীয় জীব। যারা রাষ্ট্রীয় আওতার বাইরে তাদের স্থান মানবসমাজের উপরে বা নীচে।' মনীষী বেকনও অনুরূপভাবে বলেছেন যে, 'নির্জনতা যারা কামনা করে, তারা হয় দেবতা না হয় পশু।' বস্তুতঃ মানুষের ধর্মই হল সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করা। আবার মানবজীবন ও মানবসমাজ গতিশীল। এর বিবর্তন ঘটেছে এবং ঘটবে। তবে মানুষ ও তার সমাজ সম্পর্কে সারকথা হল এই যে, পারস্পরিক নির্ভরশীলতার কারণে মানুষ কতকগুলি নিয়ম-কানুন মেনে চলতে বাধ্য। এই সমস্ত নিয়ম-কানুনের এক বিশেষ উন্নত প্রকাশ হল রাষ্ট্রীয় সংগঠন ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাদি। কালের নিয়মে মানবসমাজ ও সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে। সঙ্গে সঙ্গে মানুষ এক বিশেষ ধরনের সুনিয়ন্ত্রিত সমাজব্যবস্থার মধ্যে বসবাস করতে শুরু করেছে। এই সমাজব্যবস্থায় মানুষ বিশেষভাবে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এই সুনিয়ন্ত্রিত সমাজব্যবস্থার পোষাকী নাম হল রাষ্ট্র।


সমাজজীবন বিশ্লেষণের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে রাজনীতিক বিশ্লেষণ তথা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উৎপত্তি। রাষ্ট্রের অন্যতম অঙ্গ হিসাবে নাগরিকের রাজনীতিক অস্তিত্ব বর্তমান। নাগরিকের এই রাজনীতিক অস্তিত্বের পরিচয় পাওয়া যায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। মানুষের সঙ্ঘবদ্ধ জীবনের চরম অভিব্যক্তি হল রাষ্ট্রশক্তি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা। সাম্প্রতিককালে রাষ্ট্রশক্তির বিস্তার সমাজের সর্বক্ষেত্রে। বর্তমানে রাষ্ট্র-ব্যবস্থার প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অন্য যে-কোন সামাজিক বিধি-ব্যবস্থার থেকে ব্যাপক ও কার্যকরী। এই কারণে এই চরম শক্তিশালী ব্যবস্থার গতি-প্রকৃতি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ও আলোচনা-বিতর্কের শেষ নেই।


সমাজজীবনের ভিত্তিতেই মানুষের চিন্তার ইতিহাসের সৃষ্টি হয়। মানুষের সমাজজীবনই চিন্তার রসদ জোগায়। রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রেও এ কথা সমভাবে প্রযোজ্য। মানুষের রাষ্ট্রচিন্তা বা রাজনীতিক তত্ত্বের বিকাশ ঘটে মানুষের সামাজিক জীবন প্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে। মানুষের সামাজিক জীবনধারার বাইরে থেকে রাষ্ট্রচিন্তার কথা ভাবা যায় না। প্রকৃত প্রস্তাবে মানবসমাজের এক ব্যাপক প্রেক্ষাপটে রাজনীতিক তত্ত্ব ও রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। এই ব্যাপক দৃষ্টিকোণ ব্যতিরেকে রাজনীতিক তত্ত্ব ও রাষ্ট্রচিন্তার যথাযথ বিচার-বিশ্লেষণ এবং সম্যক অনুধাবন দুরূহ ব্যাপার। সামাজিক জীবনের প্রাসঙ্গিকতা রহিত রাজনীতিক তত্ত্ব হল বিমূর্ত ও অবাস্তব। কি ধরনের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি এবং ঐতিহাসিক অবস্থায় কোন একটি রাজনীতিক তত্ত্বের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে তা বিচার-বিবেচনা করা দরকার। এ হল এক ইতিহাস-চেতনা। এই চেতনার আলোকে চিন্তা ও তত্ত্বকে বাস্তব জগতের তথ্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে পর্যালোচনা করা যায়। প্রগাঢ় ইতিহাস-চেতনা বিমূর্ত তাত্ত্বিক অবস্থার সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করে এবং রাষ্ট্রচিন্তা ও রাজনীতিক তত্ত্বের বিকাশকে বুদ্ধিগ্রাহ্য করে তোলে।


রাষ্ট্রচিন্তার জগতে দ্বন্দ্বের অস্তিত্ব অনিবার্য। বিষয়টি ব্যাখ্যা করা দরকার। রাজনীতিক তাত্ত্বিকদের চিত্তার বিন্যাস তাঁদের সামাজিক অবস্থানের উপর নির্ভরশীল। রাষ্ট্র-দার্শনিকরাও সমাজের সদস্য। তাঁরা সমাজের সদস্য হিসাবে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন সামাজিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে তাত্ত্বিক রূপ দিয়ে তা প্রকাশ করেন। রাষ্ট্র-দার্শনিকদের সামাজিক অবস্থান ও অভিজ্ঞতার মধ্যে তারতম্য থাকে। তারফলে স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের চিন্তা-চেতনার জগতে তারতম্যের সৃষ্টি হয়। রাজনীতিক তাত্ত্বিকদের সামাজিক চেতনা তাঁদের সামাজিক অবস্থানের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। তাঁদের চিন্তা-চেতনা সমাজজীবনেরই ফসল। এইভাবে সামাজিক অবস্থানের ক্ষেত্রে বৈপরীত্য সামাজিক চেতনার ক্ষেত্রে বৈপরীত্যের সৃষ্টি করে। তারফলে রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তার জগতে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সৃষ্টি হয়। এবং এর পরিণতি হিসাবে রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস ক্রমান্বয়ে সমৃদ্ধ হতে থাকে।


বিভিন্ন চিন্তাবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নিজের পরিবেশ-পরিমণ্ডল ও দৃষ্টিভঙ্গী অনুসারে রাজনীতিক মতবাদ, ভাবাদর্শ, মানুষের রাজনীতিক জীবন এবং বিভিন্ন রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। ভারতবর্ষে ভীষ্মদেবের রাজনীতিক উপদেশ থেকে শুরু করে মানবেন্দ্রনাথ রায় ও পণ্ডিত নেহেরুর চিন্তা ভাবনা পর্যন্ত এবং পশ্চিমের সোফিস্ট পণ্ডিতবর্গ থেকে শুরু করে ল্যাস্কি, লাসওয়েল, ইস্টন প্রমুখ আধুনিক লেখকগণ পর্যন্ত অসংখ্য মনীষীর মনীষায় রাজনীতিক বিচার-বিশ্লেষণ সমৃদ্ধ। তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মাত্রেই তাঁর পরিবেশের প্রভাবকে কাটিয়ে উঠতে পারেননি। রাষ্ট্রদার্শনিকদের সামাজিক অবস্থানই তাঁদের চিন্তা চেতনার মূল উৎস হিসাবে কাজ করে থাকে। সমাজবিকাশের যে স্তরে একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অবস্থান করেন সমাজজীবনের অন্যতম অংশীদার হিসাবে এবং তার ভিত্তিতেই তিনি তাঁর মতামত গঠন করেন ও ব্যক্ত করেন। আবার নির্দিষ্ট একটি সমাজব্যবস্থায় চিন্তাবিদদের সামাজিক অবস্থানের মধ্যে পার্থক্য থাকে। তারফলেও তাঁদের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য এবং বিচার-বিশ্লেষণের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। মানব সমাজের রাজনীতিক জীবনের বিচার-বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র-দার্শনিকরা তাঁদের নিজেদের সামাজিক অবস্থান ও অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকেন। অর্থাৎ তাঁদের সমাজজীবনের অভিজ্ঞতা এবং আনুষঙ্গিক দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রকাশ ঘটে তাঁদের মতামত ও আলোচনার মাধ্যমে। এই কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও পরিধি সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় ঐকমত্য সুদূরপরাহত। আলোচ্য শাস্ত্রের স্বরূপ ও সীমানা সম্পর্কে সর্বজনস্বীকৃত সিদ্ধান্ত আশাতীত। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় অসংখ্য অভিমত ও তত্ত্বের জটিল বিন্যাস বর্তমান। তবে সকল রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর উপর পরিবেশ পরিমণ্ডলের প্রভাব সমান নয়। এতদ্‌সত্ত্বেও রাষ্ট্র-দার্শনিকদের সামাজিক অবস্থান বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ


বস্তুত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার প্রেক্ষাপটেই সমাজজীবনের প্রকৃত মূল্য অনুধাবন করা যায়। মানুষের রাষ্ট্রনীতিক জীবনের এই গুরুত্বের কারণেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তবে সমাজজীবন যেমন বিবর্তিত হয়েছে তেমনি রাষ্ট্র-ব্যবস্থা ও রাজনীতিক ক্রিয়াকলাপেরও পরিবর্তন ঘটেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রাথমিক পর্যায়ের আলোচনা ও বিষয়বস্তু প্লেটো-অ্যারিস্টটলের চিন্তাচেতনায় সমৃদ্ধ। সুদীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্লেটো-অ্যারিস্টটলের ধারা অনুসৃত হয়েছে। পরবর্তীকালে এই ধারার পরিবর্তন ঘটেছে। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল উপজীব্য বিষয় হল পরিবর্তনশীল রাষ্ট্র-ব্যবস্থা, শাসনতন্ত্র ও রাজনীতিক ক্রিয়াকলাপের ধারা ও ধারণার বিচার-বিশ্লেষণ। আবার একথাও অস্বীকার করা যাবে না যে, রাষ্ট্র-ব্যবস্থা ও রাজনীতির প্রশ্নটি সমাজবদ্ধ মানুষের জীবনধারার সকল স্তরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। এই কারণে রবার্ট ডাল (Robert Dahi) বলেছেন: “Politics is one of the unavoidable facts of human existence. Everyone is involved in some fashion at some time in some kind of political system."


প্রকৃত প্রস্তাবে সমাজজীবন বিশ্লেষণের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উৎপত্তি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মাধ্যমেই মানব সমাজের রাজনীতিক বিচার-বিশ্লেষণের সূত্রপাত ঘটে। মানুষের সঙ্ঘবদ্ধ জীবনের চরম অভিব্যক্তি হল রাষ্ট্রশক্তি এবং রাষ্ট্র-ব্যবস্থা। বর্তমানে রাষ্ট্রশক্তির বিস্তার সমাজের সর্বস্তরে। রাষ্ট্র-ব্যবস্থার প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অন্য যে-কোন সামাজিক বিধি-ব্যবস্থার থেকে অধিক ও কার্যকরী। এই চরম শক্তিশালী ব্যবস্থার গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে চিন্তা, বিচার-বিশ্লেষণ ও বিতর্কের শেষ নেই।


সমাজজীবনের আবশ্যিকতা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু প্রত্যেক মানুষই এক অর্থে আত্মকেন্দ্রিক। আত্মচিন্তা ও আত্মরক্ষার মৌলিক প্রবণতা কম-বেশী সকলের মধ্যেই বর্তমান। মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের সবটাই নিখাদ সহযোগিতার সম্পর্ক নয়। সহযোগিতার সঙ্গে সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতার সম্পর্কও মানবসমাজে দেখা যায়। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, ব্যক্তিতে-গোষ্ঠীতে এবং গোষ্ঠীতে-গোষ্ঠীতে অবিরাম দ্বন্দ্ব সংঘাত মানব-ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য। এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিয়ন্ত্রণের জন্য মানুষ সমাজজীবনে বিভিন্ন বিধি ব্যবস্থা একের পর এক সৃষ্টি করেছে। তার মধ্যে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও আইন-কানুনের বিস্তারই হল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্র দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিয়ন্ত্রণের সর্বোৎকৃষ্ট ও চূড়ান্ত ব্যবস্থা।


রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশ

বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল একটি বিশিষ্ট ও বিকশিত সামাজিক বিজ্ঞান। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডেভিড আপটার (David Apter)-এর অভিমত অনুযায়ী অধুনা রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল একটি বিশ্বজনীন বিদ্যা। ইউরোপ, আমেরিকা বা কোন উপদেশীয় সীমারেখার মধ্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা সীমাবদ্ধ নয়। একটি জনপ্রিয় সামাজিক বিজ্ঞান হিসাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সম্প্রসারিত। তবে সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের মধ্যে এটি নবীন। রাজনীতি সম্পর্কিত বৌদ্ধিক আলোচনা কিন্তু আজকের নয়; অনেক দিনের, প্রাচীনকালের। তবে স্বতন্ত্র সামাজিক বিজ্ঞান হিসাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের চর্চা শ'দুয়েক বছরের অধিককালের নয়।


বিভিন্ন বিষয়ে মানুষের বৌদ্ধিক চর্চার পীঠস্থান হিসাবে প্রাচীন গ্রীসের নাম সুপরিচিত। প্রাচীন গ্রীসই হল রাজনীতি বিষয়ক বৌদ্ধিক চর্চারও উৎসভূমি। প্রায় দু'হাজার বছর আগে গ্রীক দার্শনিকদের হাতে রাজনীতিক বিষয়াদির আলোচনার সূত্রপাত ঘটে। সমকালীন গ্রীসে গড়ে উঠা নগর রাষ্ট্রের (city state) নাগরিকদের জীবনধারা সম্পর্কিত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক চর্চার সূত্রপাত হয়। এ প্রসঙ্গে প্লেটো ও অ্যারিস্টটল, গ্রীক দর্শনের এই দুই প্রবাদ পুরুষের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্লেটো তাঁর ‘রিপাবলিক' (Republic) এবং অ্যারিস্টটল তাঁর 'পলিটিকস্' (Politics) শীর্ষক গ্রন্থে গ্রীক নগর রাষ্ট্রসমূহের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক আলোচনার সূত্রপাত করেন। রাজনীতির এই আলোচনা দর্শনমূলক ও সমাজতাত্ত্বিক। এই রাজনৈতিক দর্শনের আলোচনা ছিল আদর্শ রাজনৈতিক ব্যবস্থার অভিমুখী। প্লেটো-অ্যারিস্টটলের রাজনীতিক দর্শনে সমাজের সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম সংগঠন হিসাবে রাষ্ট্রের কথা বলা হয়েছে। রাষ্ট্রের মধ্যেই ব্যক্তিবর্গের পূর্ণাঙ্গ ও নৈতিক জীবনযাপন সম্ভব। এই দুই গ্রীক পণ্ডিতের রাজনীতিক দর্শনে মানুষের সমাজ-সংস্কৃতি, পরিবার, অর্থনীতি সবকিছু সংমিশ্রিত হয়ে গেছে। প্লেটো-অ্যারিস্টটল মানুষের পরিবার ব্যবস্থা, অর্থনীতিক ব্যবস্থা প্রভৃতি সামাজিক উপাদানসমূহ এবং বিভিন্ন শ্রেণী ও সামাজিক বর্গসমূহের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের সমন্বয় সাধনের ভিত্তিতে আদর্শ একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থার কথা ভেবেছেন। তাঁদের আলোচনা যতটা না রাজনীতিক তার থেকে অধিকতর সমাজতাত্ত্বিক। অ্যারিস্টটলই প্রথম মানুষকে রাজনীতিক জীব হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি মানুষের রাজনীতিক সত্তার উপর জোর দিয়েছেন। এই ভাবে প্রাচীন গ্রীসে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ও শ্রেণীভিত্তিক ক্ষমতা বণ্টনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের প্রকারভেদের সমাজতাত্ত্বিক বিচার-বিশ্লেষণের এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের সৃষ্টি হয়।


প্লেটো-অ্যারিস্টটলের দার্শনিক চিন্তার সুবাদে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার পরিধির মধ্য এসেছে আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সুনাগরিকের ধারণা; সুশাসক ও সুশাসনের মান সম্পর্কে ধারণা; রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকদের সম্পর্ক প্রভৃতি। গ্রীক দার্শনিকদের চিন্তা সূত্রে প্রাপ্ত ন্যায়বিচার, অধিকার, আনুগত্য, ক্ষমতা, শাসন প্রভৃতি ধ্যান-ধারণাও আদর্শ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাকে সমৃদ্ধ করেছে।


গ্রীকবীর পারস্য জয় করেন। গ্রীক-ম্যাসিডনিয়া সাম্রাজ্য স্থাপিত হয়। অতঃপর গ্রীক রাজনীতিক দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। আলেকজাণ্ডারের দিগ্বিজয় নগর-রাষ্ট্রের ধারণাকে ধূসর করে দেয়। রাজতন্ত্র বিরোধী গ্রীক চিন্তায় রাজতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটে। গ্রীক সমাজের পরিধি ও প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটে। সঙ্গে সঙ্গে গ্রীক রাষ্ট্রচিন্তায়ও পরিবর্তন ঘটে। আলেকজাণ্ডার মধ্যপ্রাচ্য ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে গ্রীক সংস্কৃতিকে সম্প্রসারিত করেন। এইভাবে তিনি হেলেনসিং(Hellensing) আন্দোলনের সূচনা করেন। তারফলে রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে নতুন এক ধারার সূত্রপাত হয়। গ্রীক সংস্কৃতির আওতায় বহিগ্রীসের মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করে মধ্যপ্রাচ্যে এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে গ্রীক সংস্কৃতির পরিধিকে প্রসারিত করার লক্ষ্যে গ্রীকবীর আলেকজাণ্ডার হেলেনসিং আন্দোলন আরম্ভ করেন। হেলেনিক যুগে গ্রীসের রাজনীতিক চিন্তাধারায় এপিকিউরিয়ান ও নির্বিকারবাদী (Cynics and Stoic) দর্শনের আবির্ভাব ঘটে। নির্বিকারবাদী দর্শন বিশ্বজনীন এক আদর্শকে তুলে ধরে। মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা ও স্বতন্ত্র মর্যাদাকে এপিকিউরাসের দর্শনে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই সময়ে সক্রেটিস-প্লেটো-অ্যারিস্টটলের চিন্তা-ভাবনার সুবাদে সমৃদ্ধ গ্রীক রাজনীতিক দর্শন হীনবল হতে শুরু করে; নতুন রাষ্ট্রদর্শনের আবির্ভাব ঘটে।


হেলেনিক যুগের বিশ্বজনীন ও মানবতাবাদী রাজনীতিক আদর্শ রোমে প্রভাব প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। পরবর্তীকালে ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায়ও রাষ্ট্রচিন্তার এই বিশ্বজনীন ধারণা ও আদর্শ প্রচার পায়। রাজনীতিকে রোমানরা তাত্ত্বিক দিক থেকে না দেখে, প্রায়োগিক দিক থেকে দেখেছে। শাসনতন্ত্র ও আইন প্রণয়নে রোমান রাজনীতির পরিচয় পাওয়া যায়। রোমান আইনবিদ সিসেরো মানুষের রাজনীতিক অধিকার ও সাম্যের বিষয়টির উপর জোর দেন। রোমান রাজনীতিতে শৃঙ্খলার শাসন ও আইনের সার্বভৌমত্বের ধারণার অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়।


মধ্যযুগ অস্থিরতা ও সংস্কারের যুগ হিসাবে পরিচিত। রাষ্ট্র, সমাজ বা সাধারণ মানুষের উপর রাজশক্তি ও ধর্মশক্তির মধ্যে কার প্রভাব বা কর্তৃত্ব অধিক সে বিষয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। অ্যাকুইনাস (St. Thomas Aquinas) প্রমুখ চিন্তাবিদেরা এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, ধর্মীয় সংস্থা রাষ্ট্রের থেকে শ্রেষ্ঠ। রাষ্ট্রশক্তির অংশীদার হিসাবে চার্চ তার দাবি প্রতিষ্ঠিত করল। ঈশ্বর ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের সঙ্গে সঙ্গে শাসকের আনুগত্যও দাবি করা হল। অতঃপর শুরু হল ধর্মীয় সংগঠনের সঙ্গে রাজশক্তির ক্ষমতার জন্য সংঘাত। মার্টিন লুথার বললেন রাজনীতিক জীবনধারার সঙ্গে খ্রীষ্টিয় প্রতিষ্ঠান বা পোপের সম্পর্ক থাকা সম্ভব নয়। কুসংস্কার বা ধর্মীয় বিচ্যুতির বিরুদ্ধে লুথার জনসাধারণের আন্দোলনের কথা বলেছেন। ক্যালভিন রাজার স্বৈরী ক্ষমতা ও অপশাসনের প্রতিবাদী কথা বলেছেন। তিনি ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে ব্যক্তির মুক্তি এবং অধার্মিক শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কথা বলেছেন।


মধ্যযুগের অস্থিরতা ও অরাজকতার মূল কারণ হল রাজশক্তি, চার্চ ও সামন্তপ্রভুদের ভিতরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও কর্তৃত্বে ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে বিবাদ। এই অরাজক অবস্থার অবসানের উদ্দেশ্যে মধ্যযুগের চিন্তাবিদরা রাজশক্তিকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হিসাবে প্রতিপন্ন করেন। এ প্রসঙ্গে মেকিয়াভেলি, বোঁদা ও হবসের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মেকিয়াভেলি নবজাগরণের ভাবধারায় সমৃদ্ধ ছিলেন। তিনি মধ্যযুগের কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতার ঊর্ধ্বে উঠে নতুন এক রাজনীতিক দর্শন গড়ে তোলেন। নবজাগরণের ভাবধারায় পুষ্ট বোঁদা, মেকিয়াভেলির রাষ্ট্রদর্শনকে অধিকতর অগ্রবর্তী করেন।


অনেকের অভিমত অনুসারে মেকিয়াভেলি, বোঁদা ও হবস মধ্যযুগীয় রাজনীতিক দৃষ্টিভঙ্গির গণ্ডী থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তাঁরা এক নতুন রাজনীতিক কাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। এই রাজনীতিক কাঠামো সর্বকালীন উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থের সহায়ক ছিল। এই কারণে উল্লিখিত রাষ্ট্রদার্শনিকদের তৎকালীন উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণীর মুখপাত্র হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। লক্ ও রুশো গৌরবয় বিপ্লব (১৬৮৮) এবং ফরাসী বিপ্লব (১৭৮৯)-এর তাত্ত্বিক প্রবক্তা হিসাবে পরিচিত। এই দুটি বিপ্লবের মাধ্যমে অনেকাংশে রাজকীয় স্বৈরী ক্ষমতার বিরুদ্ধে উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণীর সংগ্রামের সাফল্যকে সূচীত করেছে।


সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজনীতি অনুশীলনের ধারায় প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রচিন্তার সংকীর্ণতা ও বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটে। রাজনীতি চর্চার ক্ষেত্রে গড়ে উঠে উদারনীতিক মতবাদের এক মানসিক পরিমণ্ডল। উদারনীতিক ধ্যান-ধারণার পীঠস্থান হিসাবে ইংল্যাও, আমেরিকা ও ফ্রান্স পরিচিতি পায়। উদারনীতিক রাষ্ট্রচিত্তার সূত্রপাতের ক্ষেত্রে রুশো, ভলটেয়ার, মন্টেস্কু প্রমুখ রাষ্ট্রদার্শনিকদের সদর্থক অবদান অনস্বীকার্য। পরবর্তী কালে এঁদের উদারনীতিক চিন্তার পথে অগ্রসর হয়েছেন হেগেল, বোম, মিল, গ্রীণ, হবহাউস প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী।


প্রাচীন কালের গ্রীক দর্শনের রাজনীতিক চিন্তার ঐতিহ্য পরবর্তী কালের প্রায় দু'হাজার বছরের রাজনীতিক চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করেছে এবং ক্রমান্বয়ে বিবর্তিত হয়েছে। রাষ্ট্রচিন্তার এই ঐতিহ্য সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর রাজনীতিক চিন্তাবিদদের ধ্যান-ধারণাকে প্রভাবিত করেছে। গ্রীক রাষ্ট্রনীতিক চিন্তা ছিল দর্শনমূলক। এই দর্শনমূলক রাষ্ট্রচিন্তা মধ্যযুগ ও নবজাগরণের অধ্যায়কে অতিক্রম করেছে ও পরিবর্তিত হয়েছে। পরবর্তীকালের রাজনীতিক চিন্তাভাবনার পটভূমির পরিধি বিশেষভাবে প্রসারিত হয়েছে। রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রটি বহুমাত্রিক হয়ে পড়েছে। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে মূলত হবস্, লক্ ও রুশোর আলোচনার সুবাদে মানুষ ও সমাজের মধ্যে সম্পর্ক এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও অভিপ্রেত শাসনব্যবস্থা সম্পর্ক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সমৃদ্ধ হয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে সামাজিক বিজ্ঞানের সঙ্গে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পার্থক্যমূলক আলোচনার সূত্রপাত ঘটে। এবং এই সময় সৃষ্টি হয় বিভিন্ন সামাজিক বিজ্ঞানের। তবে অষ্টাদশ শতাব্দীতেও স্বতন্ত্র সামাজিক বিজ্ঞান হিসাবে রাজনীতির অনুশীলন আরম্ভ হয়নি।


রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার ধারা ঊনবিংশ শতাব্দীতে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রথম ধারাটি প্রভাবিত হয় ভাববাদী, হিতবাদী ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী মতাদর্শের দ্বারা। হেগেল ভাববাদী মতবাদের প্রাণপুরুষ। বেহাম হিতবাদী ধ্যান-ধারণার প্রধান প্রবক্তা হিসাবে পরিচিত। জে. এস. মিলকে বলা হয় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী মতবাদের মূল প্রবক্তা। রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনুশীলনের ক্ষেত্রে উল্লিখিত রাষ্ট্রদর্শনসমূহকে অনেকে বুর্জোয়া রাষ্ট্রদর্শন হিসাবে চিহ্নিত করার পক্ষপাতী। ঊনবিংশ শতাব্দীর রাজনীতির দ্বিতীয় ধারাটি হল মার্কসীয় দর্শন। মার্কসবাদী দর্শন হল বাস্তববাদী দর্শন। কার্লমার্কস মার্কসবাদী দর্শনের প্রধান প্রবক্তা। এই রাজনীতিক দর্শনের প্রচারক হিসাবে এঙ্গেলস ও লেনিনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।


মার্কসীয় রাষ্ট্রদর্শন রাজনীতিক অনুশীলনের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মার্কস-এঙ্গেলস মানুষ, মানব সমাজ ও জীবনকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। মার্কসবাদে বস্তুবাদী বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। মার্কসীয় দর্শনের বিকল্প ব্যাখ্যা হিসাবে আধুনিককালের রাজনীতিক চিন্তাজগতে গণতান্ত্রিক সমাজবাদের উপর জোর দেওয়া হয়। মার্কসবাদের এই বিকল্প ব্যাখ্যা গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানী প্রভৃতি উন্নতশীল বহু দেশে স্বীকৃত ও সমর্থিত হয়েছে।


ঊনবিংশ শতাব্দীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বতন্ত্র শাস্ত্র হিসাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাকে গড়ে তোলার ব্যাপারে উদ্যোগ আয়োজন শুরু হয়। ১৮৫৩ সালে ফ্রান্সিস লাইবার প্রণীত Civil Liberty and Self Government শীর্ষক গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থটির সুবাদে স্বতন্ত্র শাস্ত্র হিসাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিচয় প্রকাশ পায়। লাইবার ১৮৫৭ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের শিক্ষক হিসাবে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। জন বার্গেস ঊনবিংশ শতাব্দীর আশির দশকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনুশীলনের উদ্দেশ্যে কলম্বিয়া কলেজে পৃথক একটি বিভাগ গড়ে তোলেন। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে পৃথক পাঠ্য বিষয় হিসাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হয়। মার্কিন মুলুকে ১৯০৪ সালে American Political Science Association গড়ে তোলা হয়। অতঃপর স্বতন্ত্র শাস্ত্র হিসাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের চর্চা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাড়তে থাকে।


রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনুশীলনের সূত্রপাত ঘটে সংবিধান সম্পর্কিত আলোচনাকে নিয়ে। মার্কিন সংবিধান একটি আইনমূলক কাঠামো প্রবর্তনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন গোষ্ঠীর ও শ্রেণীর আর্থনীতিক প্রতিযোগিতার পরিমণ্ডল প্রস্তুত করে। 'আমেরিকান পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন' সকল দেশের মানুষের জন্য সম্পূর্ণ একটি সাংবিধানিক কাঠামোর নীতিসমূহ নির্ধারণের উপর জোর দেয়। মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত আইনগত এবং তুলনামূলক ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও রাজনীতিক সমস্যাদির আলোচনা করেছেন। এই আলোচনার পটভূমিতে ছিল ঐতিহাসিক প্রগতির ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের রাজনীতিক ক্রমবিবর্তন। ইউরোপের ঐতিহাসিক, রাজনীতিক, আইনমূলক ও সমাজতাত্ত্বিক ধ্যান-ধারণার প্রভাব মার্কিন রাজনীতিক চিন্তাবিদদের উপর পড়েছে। রাজনীতি বলতে মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সর্বজনীন, স্বতঃসিদ্ধ ও যুক্তিগ্রাহ্য নীতিসমূহকে চিহ্নিত করেছেন।


বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকেই রাজনীতিক বিষয়াদির অনুশীলনের ক্ষেত্রে আরম্ভ হয় নতুন নীতির অনুসন্ধান। আগেকার আলোচনার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আইনগত ও আনুষ্ঠানিক। তারফলে রাজনীতিক জীবনধারার বাস্তব বিচার-বিশ্লেষণ ছিল অধরা। কারণ শ্রেণীগত ও আর্থ-সামাজিক উপাদানসমূহকে আগেকার দৃষ্টিভঙ্গিতে উপেক্ষা করা হয়েছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় সমাজব্যবস্থার আপেক্ষিক স্থিতি ইতিমধ্যে অতীত হয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় জীবনকে প্রভাবিত করেছে সামাজিক ক্রিয়াকর্ম। তখন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের সমাজ-নির্ভরতা স্পষ্টত প্রতিপন্ন হচ্ছে। সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য সাধনে বাধ্য হচ্ছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ। সামাজিক গোষ্ঠীসমূহের স্বার্থের সংঘাত, সমকালীন শিল্পোন্নত সমাজের শ্রেণীদ্বন্দ্ব রাষ্ট্রীয় জীবনে নতুন মাত্রার সৃষ্টি করেছে। এরকম অবস্থায় রাষ্ট্র-ব্যবস্থা, সরকারের কাঠামো, নির্বাচন ব্যবস্থা, রাজনীতিক নেতৃত্ব প্রভৃতি রাজনীতিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রসমূহের সংস্কার সাধন এবং সংশ্লিষ্ট নীতিসমূহের নির্ধারণ অপরিহার্য প্রতিপন্ন হয়। এরকম এক পরিস্থিতি পরিমণ্ডলের মধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ইউরোপের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ধ্যান ধারণার প্রভাব থেকে সরে আসতে শুরু করেন। এই সময় মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গি আকৃষ্ট হয় বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থা, রাজনীতিক কাঠামো, আনুষ্ঠানিকতাবর্জিত রাজনীতিক কার্যকলাপ প্রভৃতির প্রতি। শাসনতন্ত্র বহির্ভূত বিভিন্ন সংঘ-সমিতি, সামাজিক শক্তিসমূহ, স্বার্থগোষ্ঠীসমূহ, রাজনীতিক দল, জনমত প্রভৃতি বিষয়াদির বাস্তববাদী রাজনীতিক বিচার-বিশ্লেষণের উপর গুরুত্ব আরোপের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়।


প্রসঙ্গত উল্লেখ করা আবশ্যক যে সমকালীন ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা বিশেষভাবে বিকশিত হয়। কার্ল মার্কস এবং মার্কস-এঙ্গেলসের কালজয়ী রচনাসমূহ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বিকাশ ও বিস্তারে বিশেষভাবে সাহায্য করে। অতঃপর মার্কসীয় দর্শন রাষ্ট্রনীতিক চিন্তাজগৎকে ব্যাপক ও বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। মার্কসবাদী ধ্যান-ধারণা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনুশীলনের ক্ষেত্রে নতুন এক চিন্তাধারার জন্ম দেয়। রাজনীতিক বিষয়াদির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি হয়।


মার্কিন মুলুকের বাস্তববাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সংবিধান বহির্ভূত বিষয়াদির অনুশীলনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। সমকালীন বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বেন্টলী (Arthur Bentley), উইলসন (W. Wilson), লাওয়েল (Lowell), ফোর্ড (Henry Jones Ford), হার্ট (Albert Hart), বিয়ার্ড (Charles Beard) প্রমুখ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাস্তবানুগ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মেরিয়াম (Charles Merriam), ওয়ালাস ( Graham Wallas), লিপম্যান (Walter Lippman) প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ওয়ালাসের Human Nature in Politics গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯০৮ সালে এবং লিপম্যানের Public Opinion শীর্ষক গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালে। উল্লিখিত গ্রন্থ দুটি রাষ্ট্রনীতিক বিষয়াদির আলোচনার ক্ষেত্রে আলোড়নের সৃষ্টি করে। অতঃপর মেরিয়াম (Charles Merriam) নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাজনীতিক বিষয়াদির বিচার-বিশ্লেষণের উপর জোর দেন। তিনি মানুষের রাজনীতিক আচার-আচরণ বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে কঠোরভাবে বিজ্ঞানসম্মত পন্থা-পদ্ধতি ও সংখ্যাতত্ত্বের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ব্যবহারিক গুরুত্ব বৃদ্ধির ব্যাপারে যত্নবান হন। সামাজিক বিজ্ঞান হিসাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রয়োগমূলক পরিচয়টিকে জনপ্রিয় করে তোলার ব্যাপারে এই শ্রেণীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সচেষ্ট ও সক্রিয় হন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আচরণবাদী প্রবক্তারা রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে স্বতন্ত্র একটি বিজ্ঞানসম্মত শাস্ত্র হিসাবে প্রতিপন্ন করার জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনুশীলন পদ্ধতির কতকগুলি প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এই বৈশিষ্ট্যগুলি হল:

  • (ক) সুনির্দিষ্ট অনুমান গড়ে তোলা ও অনুমানসমূহের সত্যতা নির্ধারণ, 

  • (খ) তথ্যাদি সংগ্রহের জন্য অভিজ্ঞতামূলক সমীক্ষা সম্পাদন; 

  • (গ) সংগৃহীত তথ্যাদির সুসংবদ্ধকরণ ও পরিসংখ্যায়ন; এবং 

  • (ঘ) বিজ্ঞানসুলভ নিরপেক্ষতা।


আগে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক আলোচনাটি ছিল রাষ্ট্রকেন্দ্রিক। এই আলোচনা ছিল আদর্শমূলক ও কল্পনাশ্রয়ী। এ ধরনের আলোচনা ক্রমান্বয়ে প্রাসঙ্গিকতা হারাতে থাকে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার বিষয়সমূহ কল্পনাভিত্তিক পটভূমির পরিবর্তে ধীরে ধীরে কাঠামো বা প্রাতিষ্ঠানিক পটভূমি ও আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে ভিত্তি করে অগ্রসর হতে থাকে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার এক্তিয়ারের মধ্যে আসতে থাকে নতুন নতুন বিষয়। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে রাজনীতিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব, রাজনীতিক সংস্কৃতি, রাজনীতিক সামাজিকীকরণ, জনমত, আচরণ, জনপ্রতিনিধিত্ব প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকে বৈজ্ঞানিক আচরণবাদের আবির্ভাব ঘটে। এই আচরণবাদে বিদ্যমান অবস্থারই বিচার-বিশ্লেষণের উপর জোর দেওয়া হয়। মূল্যবোধকে বাদ দিয়ে ক্ষমতা ও রাজনীতির বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এই আলোচনা অনুশীলন অভিজ্ঞতাবাদী ও গবেষণামূলক। স্বভাবতই আচরণবাদীরা তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিকে বৈজ্ঞানিক বলে দাবি করেন।


রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যকলাপের বিকাশ ও বিস্তার এবং সামাজিক স্তরের উপর তার প্রতিফলন পর্যালোচনার দিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের আগ্রহ আকৃষ্ট হয়েছে। জনসাধারণের রাজনীতিক মনস্তত্ত্ব অনুধাবনের ক্ষেত্রে আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সংখ্যায়ন ও সামাজিক বিজ্ঞানের অন্যান্য পদ্ধতি অনুসরণের উপর জোর দিয়েছেন। প্রাতিষ্ঠানিক বা প্রায়োগিক ভিত্তিতে রাজনীতিক তত্ত্বের সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ব্যক্তি-নিরপেক্ষ রাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং তার কল্পনাভিত্তিক ও বর্ণনামূলক আলোচনা থেকে সরে এসেছে। সমাজসংশ্লিষ্ট রাজনীতিক জীবনের অনুশীলনে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা আগ্রহী হয়ে উঠেন। রাজনীতির আচরণবাদী তাত্ত্বিকরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে মূল্যমান-নিরপেক্ষ অভিজ্ঞতাবাদী স্বতন্ত্র ও স্বাধীন বিজ্ঞান হিসাবে গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। এর পিছনে কারণও ছিল। তারা বুঝতে পারছিলেন যে, সামাজিক শক্তিসমূহ গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিক ক্রিয়াকর্মকে প্রভাবিত করে। আর্থ-সামাজিক স্বার্থসমূহ সরকারের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। এই সময় সামাজিক ও আর্থনীতিক উপাদানসমূহ এবং আনুষ্ঠানিকতা বর্জিত রাজনীতি সম্পর্ক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। এই সচেতনতা বৃদ্ধির পিছনে মার্কসীয় দর্শন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের ঘটনার অবদান অনস্বীকার্য। এই সময় জার্মানী ও ইতালির যথাক্রমে নাৎসীবাদী ও ফ্যাসীবাদী অভিজ্ঞতা, ‘বৃহৎ মন্দা (Great Depression)-র ধাক্কা, মার্কসবাদী ব্যাখ্যা, সোভিয়েত ইউনিয়নের অভিজ্ঞতা প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে ধনতন্ত্র ও উদারনীতিক গণতন্ত্র প্রবল প্রতিকূলতার মুখোমুখী হয়। এরকম পরিস্থিতি পরিমণ্ডলের মধ্যে নতুন প্রজন্মের রাষ্ট্র দার্শনিকরা ধনতন্ত্র ও উদারনীতিক গণতন্ত্রের স্থায়িত্বকে নিরাপদ করার উদ্দেশ্যে উদ্যোগী হন। তাঁরা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানসমূহের ধাঁচে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি তাত্ত্বিক কাঠামো গড়ে তোলার ব্যাপারে আত্মনিয়োগ করেন। এই শ্রেণীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সামাজিক ও মনোবিজ্ঞানমূলক দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতির আচরণবাদী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের উপর জোর দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী কালে ইউরোপের দেশগুলিতে স্বতন্ত্র শাস্ত্র হিসাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিকাশ ঘটে। ইউরোপে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনুশীলন অনেকাংশে অগ্রসর হয় মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অনুসৃত পথে।


রাজনীতিক বিষয়াদির বিচার-বিশ্লেষণের বিকাশ এবং স্বতন্ত্র সামাজিক বিজ্ঞান হিসাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মর্যাদা লাভের ক্ষেত্রে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের আর্থনীতিক ও সামাজিক পরিষদ (Economic and Social Council) এবং সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (UNESCO – United Nations Educational Scientific and Cultural Organisation)-র সদর্থক ভূমিকা অনস্বীকার্য। ইউনেস্কো-র উদ্যোগে ১৯৪৮ সালে প্যারিসে সমকালীন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়বস্তু নির্ধারণের উদ্দেশ্যে এই সম্মেলনে আলোচনা ও মত বিনিময় হয়। কিন্তু এ বিষয়ে কোন নবগঠিত স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হয় নি। তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল আলোচ্য বিষয় হিসাবে ‘রাষ্ট্র ও ক্ষমতা’-র উপর জোর দেওয়া হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ, রাজনীতিক দল ও স্বার্থগোষ্ঠীসমূহের ভূমিকা, রাজনীতিক ক্রিয়াকর্মে নাগরিকদের অংশগ্রহণ, আন্তর্জাতিক সংগঠন, আন্তর্জাতিক আইন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রভৃতির গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়।


বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনুশীলনের ক্ষেত্রে এক নতুন পর্যায়ের সূত্রপাত পরিলক্ষিত হয়। এই সময় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার মুখ্য বিষয় হিসাবে ক্ষমতার ধারণা গুরুত্ব লাভ করে। অতঃপর রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চায় কাঠামোগত দৃষ্টিভঙ্গির প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। ক্ষমতা ও রাজনীতিক আচরণ সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা অভিজ্ঞতামূলক অনুসন্ধানের পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ তত্ত্ব গড়ে তোলার ব্যাপারে অধিকতর আগ্রহী হন। এইভাবে গড়ে ওঠা সাধারণ তত্ত্বের ভিত্তিতে তারা বিদ্যমান রাজনীতিক প্রক্রিয়ার সাধারণ প্রকৃতি পর্যালোচনার ব্যাপারে সক্রিয় হন।


এই সময় রাজনীতিক বিষয়াদির অনুশীলনের ক্ষেত্রে 'রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কিত ধারণা একটি একেবারে নতুন দিক উন্মুক্ত করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার মুখ্য বিষয় হিসাবে সমাজের স্বার্থে কর্তৃত্বমূলক সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ার অনুশীলনের উপর জোর দেওয়া হয়। রাজনীতিক ব্যবস্থার অন্তর্গত ব্যক্তিবর্গ ও গোষ্ঠীসমূহের পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়া (interaction)-র মাধ্যমে এই কর্তৃত্বমূলক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। রাজনীতিক ব্যবস্থা হল একটি ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে সংঘটিত হয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের দ্বারা ‘মূল্যের কর্তৃত্বসম্পন্ন বরাদ্দ। মূল্যের কর্তৃত্বমূলক বরাদ্দের ধারণা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে এক অগ্রবর্তী অবস্থান।


আধুনিক কালে রাজনীতির অনুশীলনে ক্ষমতা ও রাজনীতি সম্পর্কে সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনস্বীকার্য। সাম্প্রতিককালে ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনুশীলনের অনেকটা এলাকা জুড়ে বর্তমান।

বর্তমান বিশ্বের পরিস্থিতি পরিমণ্ডলের পরিবর্তন ঘটেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা অধুনা কেবলমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও চরিত্রসমূহের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আন্তর্জাতিক সংগঠন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়াদিও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়াদির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।


আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় তুলনামূলক রাজনীতির অনুশীলন গুরুত্ব অর্জন করেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ও বিভিন্ন রাজনীতিক জীবনধারার তুলনামূলক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বর্তমানে বিশেষভাবে জনপ্রিয়। রাজনীতির তুলনামূলক আলোচনার আলোকে বিশ্বব্যাপী মানবজাতির রাজনীতিক জীবনধারা সম্পর্কে এক সামগ্রিক ও সাধারণ ধারণা লাভ করা যায়।


রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাম্প্রতিককালের আলোচনায় রাজনীতিক সমাজতত্ত্ব একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে নিয়েছে। বর্তমানে সামাজিক জীবনধারা রাজনীতিক কার্যকলাপ বা রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। তখন নতুন এক আলোচনাক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়। নতুন এই আলোচনা ক্ষেত্রটি সর্বাংশে সামাজিক বা সর্বাংশে রাজনীতিক নয়। সামাজিক ও রাজনীতিক জীবনধারার সংযোজনের ভিত্তিতে সৃষ্টি হয় নতুন এই আলোচনা ক্ষেত্রটির। এই আলোচনা ক্ষেত্রটির নাম হল রাজনীতিক সমাজতত্ত্ব। রাজনীতিক সমাজতত্ত্ব আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।


‘আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান সংস্থা' (International Political Science Association)-র একাদশ বিশ্ব কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৯ সালে মস্কো শহরে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই বিশ্ব কংগ্রেসে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার প্রকৃতি ও পরিধির পরিবর্তন প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়। আলোচ্য বিষয়াদির সাম্প্রতিককালের গতি প্রকৃতি ও প্রবণতার উপর জোর দেওয়া হয়। (ক) মার্কসবাদের ব্যাপারে পশ্চিমী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের আগ্রহ; মার্কসীয় ধ্যান-ধারণার আধুনিকীকরণ এবং উদারনীতিক ও অ-মার্কসীয় ধ্যান-ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্য সাধন। (খ) জ্ঞান ও নৈতিক মূল্যায়নের মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টির উপর গুরুত্ব আরোপ এবং দর্শনমূলক (অ-বৈজ্ঞানিক) ও অভিজ্ঞতামূলক (বৈজ্ঞানিক) জ্ঞানের মধ্যে বিতর্ক হ্রাস। (গ) অপরাপর বিজ্ঞান শাস্ত্র থেকে বিবিধ ধারণা ও পদ্ধতিসমূহ আহরণ। (ঘ) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় হিসাবে আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের এবং আইনপ্রণয়ন ও শাসন বিষয়ক প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বীকৃতি। (ঙ) ঐতিহাসিক পদ্ধতির ব্যাপারে ক্রমবর্ধমান আগ্রহ এবং রাজনীতিক মতবাদসমূহের নতুন ব্যাখ্যা ও ইতিহাস।


রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল একটি গতিশীল বিজ্ঞান। দেশ-কাল ও সমাজভেদে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনুশীলনের ধারায় পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। রাজনীতিক বিষয়াদির বিচার-বিশ্লেষণে নতুন নতুন ধ্যান-ধারণার আবির্ভাব ও পন্থা-পদ্ধতির প্রয়োগ পরিলক্ষিত হচ্ছে। এতদসত্ত্বেও রাষ্ট্রবিজ্ঞান তার ঐতিহ্য ও সনাতন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সম্পূর্ণ সরে আসেনি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন ধ্যান-ধারণার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বাঞ্ছনীয়। সাম্প্রতিককালের আচরণবাদোত্তর রাজনীতি (Post Behavioural Politics) চর্চার ক্ষেত্রে এই প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়।