আচরণবাদের সমালোচনা

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় আচরণবাদের সমালোচনা


বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনুশীলনে আচরণবাদী আলোচনার জনপ্রিয়তা ক্রমবর্ধমান। এতদসত্ত্বেও মতবাদটি বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। কারণ আচরণবাদ মোটেই ত্রুটিমুক্ত নয়। বিভিন্ন দিক থেকে এই দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করা হয়।


(১) মূল্যবোধকে অস্বীকার: সমালোচকদের মতে আচরণবাদ মানবতা-বিরোধী। এই মতবাদে মূল্যবোধকে অগ্রাহ্য করা হয়। আচরণবাদে সংখ্যাতত্ত্ব ও অভিজ্ঞতাবাদী অন্যান্য কলাকৌশলের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। আচরণবাদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অন্ধভাবে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পদ্ধতিকে প্রয়োগ করতে চায়। অর্থাৎ মানবসমাজকে একটি কৃত্রিম গবেষণাগার হিসাবে গণ্য করা হয়। কিন্তু কেবলমাত্র তথ্য সংগ্রহ, তালিকা প্রণয়ন, রেখাচিত্র অঙ্কন প্রভৃতির মাধ্যমে রাজনীতিক জীবন ও কার্যাবলীর যথাযথ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অসম্ভব। মূল্যবোধকে বাদ দিয়ে রাজনীতিক-সামাজিক ঘটনার আলোচনা অসম্ভব। রাজনীতিক তত্ত্বের আলোচনার ভিত্তিতে মূল্যবোধের বিবেচনা বর্তমান। মূল্যবোধহীন আলোচনা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আগেও সম্ভব হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। লিও স্ট্রাউস মন্তব্য করেছেন: “It is impossible to study social phenomena... without making value-judgement."


বস্তুত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যথার্থ আলোচনার স্বার্থে মূল্যমান-নিরপেক্ষ ভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মূল্যবোধের ধারণাযুক্ত আদর্শবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়সাধন দরকার। ইস্টন-এর মতে আচরণবাদীরাও এই প্রয়োজনীয়তা পরবর্তীকালে অনুধাবন করেছেন। তিনি বলেছেন: “Moral views may be logically separable from factually oriented knowledge, in actual research our moral frame of reference plays an influential and inextricable part in conditioning our observations." বাস্তবধর্মী দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে নৈতিক মূল্যমানের সমন্বয় সাধনের ভিত্তিতে রাজনীতিক জীবনের বিভিন্ন সমস্যার পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।


প্রকৃত প্রস্তাবে আচরণবাদীরাই মূল্যবোধের প্রভাব থেকে মুক্ত নন। আচরণবাদীদের কাছে আদর্শ রাজনীতিক ব্যবস্থা হল উদারনীতিক গণতন্ত্র। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাজনীতিক ঘটনার বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে উদারনীতিক গণতন্ত্রের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত অঙ্গীকার পরিলক্ষিত হয়। বস্তুত মূল্যবোধকে বাতিল করার পরিবর্তে আচরণবাদে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধকে দৃঢ়ভিত্তিক করার ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।


(২) সংখ্যাতত্ত্বের নামান্তর: বিরুদ্ধবাদীরা শ্লেষাত্মকভাবে আচরণবাদকে ‘সংখ্যাতত্ত্বের’ নামান্তর হিসাবে অভিহিত করেন। আচরণবাদী আলোচনায় সংখ্যায়ন (quantification), রেখাচিত্র (graphs or diagrams) প্রভৃতি অভিজ্ঞতাবাদী পদ্ধতির উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়। তার ফলে আচরণবাদী আলোচনা কিছু জাঁকজমকপূর্ণ কলা-কৌশলের সমষ্টি হিসাবে গণ্য হয়। সমালোচকদের মতে এইভাবে মানুষের রাজনীতিক জীবনের সঠিক অবস্থার যথাযথ পরিচয় পাওয়া মুশকিল। বল বলেছেন: “They are tools of analysis that can only be usefully employed in certain fields, and their findings have to be treated with care." অ্যানড্রেস্কি (Stanislav Andreski) তাঁর Social Science as Sorcery গ্রন্থে আচরণবাদ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে বলেছেন: “...full of stream-lined sorceres clad in the latest parapharnelia of science.” তিনি আরও বলেছেন: “...people now a days talk about methodology they usually mean not the basic principles of inductive inference, but the specific methods of collecting and analysing statistical data."


(৩) রক্ষণশীলতা: রক্ষণশীলতার প্রতি আচরণবাদে পক্ষপাতিত্ব প্রকট। এই মতবাদ সমাজের গুণগত বৈশিষ্ট্য ও বিভিন্ন ধরনের আর্থ-সামাজিক সম্পর্ককে অগ্রাহ্য করে। আচরণবাদ কেবল স্থিতাবস্থার ব্যাপারেই অধিক আগ্রহ দেখায়। তাই আচরণবাদকে বলা হয় স্থিতাবস্থা (status-quo) বজায় রাখার তত্ত্ব। আচরণবাদ সমাজ পরিবর্তনের কারণসমূহ বা সমাজবিপ্লবের নীতি এবং সামাজিক অর্থনৈতিক সম্পর্কের বিচার বিশ্লেষণ করেনি। সমালোচকদের মতে আচরণবাদের মূল উদ্দেশ্য হল বুর্জোয়া সমাজের স্থিতাবস্থা সংরক্ষণ। অ্যানড্রেস্কি মন্তব্য করেছেন: “By diverting the eyes from the explosive issues of the day the methodological purism act in the fact as a prop of the status-quo whatever it might be." আচরণবাদীরা হলেন উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষক। এই রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থিতাবস্থা সংরক্ষণই হল তাঁদের মূল উদ্দেশ্য। তবে এর জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনের কথাও তাঁরা বলেন। রক্ষণশীলতার পৃষ্ঠপোষকতা এই মতবাদে একটি বড় ত্রুটি। আর একটি ক্ষেত্রে আচরণবাদের রক্ষণশীলতা প্রকটভাবে প্রতিপন্ন হয়েছে। আচরণবাদীরা মার্কিন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এঁদের মতানুসারে এর কোনরকম পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই। তবে সংস্কারের প্রয়োজন হতে পারে।


(৪) বিজ্ঞানসম্মত নয়: তা ছাড়া, কোন একটি সামাজিক বিজ্ঞান সমাজের বাস্তব চিত্র সঠিকভাবে চিত্রিত করতে পারছে কিনা তার উপরই সংশ্লিষ্ট সামাজিক বিজ্ঞানের বৈজ্ঞানিক চরিত্র নির্ভরশীল। "বিজ্ঞানমনস্কতা' (scientism)-র পরিচয় প্রত্যেক ঘটনার কার্যকারণগত বিষয়াদি যথাযথভাবে অনুধাবন ও বিচার-বিশ্লেষণ, সত্য উদ্ঘাটন প্রভৃতির মধ্যেই নিহিত থাকে। কেবল কিছু কলা-কৌশলের প্রয়োগকেই বিজ্ঞান বলে না। ভৌত বিজ্ঞানের অনুশীলনে কলা-কৌশলগুলির অনুসরণ করলেই কোন সামাজিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি পুরোপুরি বিজ্ঞানসম্মত হয়ে যায় না। এবং কেবল এর দ্বারা সংশ্লিষ্ট সামাজিক বিজ্ঞানটির সাফল্য বা সার্থকতা প্রমাণিত হয় না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পদ্ধতিকে অন্ধভাবে প্রয়োগ করা ঠিক নয়। বিরুদ্ধবাদীদের মতানুসারে আচরণবাদীদের বিজ্ঞানমনস্কতা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাকে বরং অবৈজ্ঞানিক (unscienced) করে তুলেছে। স্টানকিউজ (W.J. Stankiewicz) তাঁর Aspects of Political Theory শীর্ষক রচনায় মন্তব্য করেছেন: ...scientism has not produced anything remotely resembling a substitute for political theory."


(৫) বিভিন্ন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আচরণ বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে মানবসমাজ সম্পর্কে সাধারণ কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া বা সর্বজনগ্রাহ্য কোন সত্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব কিনা এ বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়ে থাকে। কারণ মানবসমাজের একটি সামগ্রিকতা আছে। মানবসমাজ কেবলমাত্র কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর যোগফলমাত্র নয়, তার অধিক কিছু। মানব-সমাজের এই সামগ্রিক সত্তাকে উপেক্ষা করে মানবসমাজ সম্পর্কিত কোন সঠিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না।


(৬) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্বাতন্ত্র্য বিপন্ন: আচরণবাদীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাকে বিজ্ঞানভিত্তিক ও পরিপূর্ণ করার উদ্দেশ্যে আন্তঃ-সামাজিক বিজ্ঞানকেন্দ্রিক আলোচনার পক্ষপাতী। এই কারণে তাঁরা সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, পরিসংখ্যান তত্ত্ব, মনোবিদ্যা, অঙ্কশাস্ত্র প্রভৃতির সাহায্য গ্রহণ অপরিহার্য মনে করেন। তার ফলে স্বতন্ত্র বিষয় হিসাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার স্বাতন্ত্র্য ক্ষুণ্ণ হয়েছে।


(৭) সীমাবদ্ধতা: আচরণবাদে রাজনীতিক দল, উপদল, জনমত, ভোটদাতার আচরণ প্রভৃতি রাজনীতিক ব্যবস্থার উপকরণ (inputs)-এর উপর অতিমাত্রায় গুরুত্ব আরোপ করা হয়। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান যেমন, সরকার, আদালত, প্রশাসন, আইনসভা প্রভৃতিকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। তাছাড়া রাজনীতিক আচরণে সম্পূর্ণ ঘটনা ও তথ্যাদি আচরণবাদের মাধ্যমে বিচার-বিশ্লেষণ করা যায়। কারণ আচরণবাদীরা হলেন আদর্শ-ভিত্তিক আলোচনার বিরোধী। তাই যে সমস্ত রাজনীতিক আচরণ আদর্শ-নিয়ন্ত্রিত তা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা আচরণবাদীদের পক্ষে সম্ভব হয় না। আচরণবাদের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে খ্রীস্টিয়ান বে (Christian Bay) তাঁর A Critical Evaluation of Behavioural Literature শীর্ষক রচনায় মন্তব্য করেছেন: “What is more troublesome...is the anti-political orientation, the failure to see politics as potentially an instrument of reason, legitimately dedicated to the improvement of social condition."


(৮) রাজনীতির সংজ্ঞা সম্পর্কে মতপার্থক্য: রাজনীতির (Politics) সংজ্ঞা সম্পর্কে আচরণবাদীদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা যায়। ইস্টন রাজনীতিকে ‘মূল্যের কর্তৃত্বসম্পন্ন বরাদ্দ' (authori-tative allocation of values) হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন। লাসওয়েল (H. D. Lasswell) 'রাজনীতি' বলতে ‘প্রভাব ও প্রভাবশালীদের’ (influence and the influentials) সম্পর্কের কথা বলেছেন। অর্থাৎ রাজনীতির সংজ্ঞা প্রসঙ্গে আচরণবাদীদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে।


(৯) আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে এক তীব্র দর্শন-বিরোধী মনোভাব বর্তমান। সমালোচকদের মতানুসারে এই দর্শনহীনতা উদারনীতিক গণতান্ত্রিক মতবাদকে সংরক্ষণের কৌশল বিশেষ। বিরুদ্ধবাদীরা আচরণবাদকে দার্শনিক বিপথ-গমন বলে অভিযুক্ত করেছেন। স্টানকিউজ (W.J. Stankiewicz) বলেছেন: "Scientism and behaviouralism are also philosophical aberrations."


(১০) জটিলতার সৃষ্টি: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাকে বিজ্ঞানভিত্তিক করার নামে আচরণবাদীরা নতুন ও কঠিন পরিভাষা প্রয়োগ করেছেন। তার ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা অযথা জটিল হয়ে পড়েছে। লিও স্ট্রাউস স্টোরিং কর্তৃক সম্পাদিত Essays on the Scientific Study of Politics গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: "The break with the commonsense understanding of political things compels new political science to abandon the criteria of relevance that are relevant in political understanding."


(১১) রাষ্ট্রহীন আলোচনা অচল: আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আচরণবাদ হল এক রাষ্ট্রহীন (state-less) মতবাদ। এই মতবাদে রাষ্ট্রকে অপ্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে প্রতিপন্ন করা হয়। কিন্তু রাষ্ট্র হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় বিষয়। তাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কোন পূর্ণাঙ্গ ও অর্থবহ আলোচনা হতে পারে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কিত অধিকাংশ গ্রন্থই রাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং তার বিভিন্ন দিক ও বিষয় নিয়ে রচিত হয়েছে। সমালোচকদের আরও অভিমত হল যে আচরণবাদের রাষ্ট্রহীন আলোচনা হল পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের শোষণ-পীড়ন ও অত্যাচারের অমানবিক দিকটিকে আড়াল করার এক অপচেষ্টা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যা আচরণবাদের জন্মভূমি হিসাবে পরিচিত, সেখানেই রাষ্ট্রহীন ব্যবস্থার আলোচনা কার্যকর হতে পারেনি।


(১২) ব্যক্তির রাজনীতিক আচরণ বিচ্ছিন্ন বিষম নয়: ব্যক্তির বহুবিধ আচরণেরই একটি অংশ হল রাজনীতিক আচরণ। কোন বিশেষ একটি সুস্পষ্ট আচরণের মাধ্যমে ব্যক্তির রাজনীতিক বিশ্বাস, অঙ্গীকার ও মতামত ব্যক্ত হয় না। তাই ব্যক্তির রাজনীতিক আচরণের পরিপূর্ণ পরিচয় পাওয়ার জন্য তার সকল রকম আচরণ সম্পর্কে অবহিত হওয়া আবশ্যক। অথচ আচরণবাদের আলোচনা মূলত রাজনীতিক আচরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। সুতরাং এ ধরনের আলোচনা সফল ও সার্থক হতে পারে না। তা ছাড়া ব্যক্তির বিভিন্ন ধরনের আচরণ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং পরস্পর নির্ভরশীল। সমাজবদ্ধ মানুষের আচার-আচরণের অন্যান্য দিক থেকে রাজনীতিক দিকটিকে একেবারে আলাদা করে আলোচনা করা যায় না। মানবসমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যক্তির ভূমিকা যদি না থাকে তা হলে রাজনীতিক আচরণ ঘটে না। এই অবস্থায় ব্যক্তির অন্যান্য আচরণকে আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তবেই রাজনীতিক আচরণ সম্পর্কিত আলোচনা অর্থবহ হবে। ইউলাউ তাঁর The Behavioural Persuasion in Politics শীর্ষক রচনায় বলেছেন: “...there may behavioural similarities from one institutional context to another that are politically relevant."


(১৩) বাস্তব ত্রুটি-বিচ্যুতি: সমালোচকদের মতানুসারে মানুষের আচার-আচরণের সঙ্গে বিভিন্ন বিশ্বাস ও অনুভূতি যুক্ত থাকে। তাই মানুষের যেকোন আচরণকে সহজে পরিমাপ করা বা পরিসংখ্যানের মাধ্যমে প্রকাশ করা যায় না। এ ক্ষেত্রে ব্যবহারিক বা বাস্তব অসুবিধাও আছে। ব্যক্তির বহু রাজনীতিক কাজকর্ম গোপনে সংঘটিত হয়। এ সব বিষয়ে তথ্যাদি সংগ্রহ করা যায় না। তাছাড়া নৈর্ব্যক্তিক (objective) দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া সংগৃহীত তথ্যাদির বিজ্ঞানসম্মত বিচার-বিশ্লেষণ করা যায় না। অথচ নৈর্ব্যক্তিকতা আয়ত্ত করা রাজনীতিক গবেষকদের পক্ষে মোটেই সহজ বিষয় নয়। পূর্ব পরিকল্পিত সিদ্ধান্ত, ধারণা এবং ব্যক্তিগত সুবিধা-অসুবিধা অনুসারে রাজনীতিক গবেষকরা তথ্যাদি সংগ্রহ করেন এবং তদনুসারে তা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন। সুতরাং এই আচরণবাদী আলোচনা বিজ্ঞানসম্মত হতে পারে না।


(১৪) বিপ্লব বলা চলে না: আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আচরণবাদকে বিপ্লব হিসাবে অভিহিত করা হয়। কিন্তু এ কথা ঠিক নয়। আচরণবাদকে বিপ্লব বলা যায় না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কোন আমূল পরিবর্তন আচরণবাদের মাধ্যমে সাধিত হয়নি। আচরণবাদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় কেবল কিছু নতুনত্ব আমদানি করেছে। অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞান ও ভৌত বিজ্ঞানের কিছু কলা-কৌশল ও পদ্ধতিকে আচরণবাদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় প্রয়োগ করেছে। একে বিপ্লব বলা চলে না।


(১৫) ছদ্ম রাজনীতির আলোচনা: খ্রীস্টিয়ান বে আচরণবাদীদের ‘ছদ্ম রাজনীতিক' (pseudopolitician) বলে অভিযুক্ত করেছেন। তাঁর মতানুসারে ছদ্ম রাজনীতিই হল আচরণবাদের মুখ্য আলোচ্য বিষয়। তিনি প্রতিবাদের সুরে বলেছেন: "I object to the tendency in much of the behaviour literature to deal with pseudopolitical aspects of behaviour almost exclusively."


মূল্যায়ন: উপরিউক্ত ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনুশীলনের ক্ষেত্রে আচরণবাদী পন্থা-পদ্ধতির গুরুত্ব ও প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না। বিশেষতঃ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নির্বাচন সম্পর্কিত আচরণ, রাজনীতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ প্রভৃতি বিষয়ে আচরণবাদী বিশ্লেষণের কার্যকারিতা অস্বীকার করা যায় না। সর্বোপরি আচরণবাদ রাজনীতিতে মানুষের ভূমিকার উপর যে গুরুত্ব আরোপ করে তা যথোচিত। অনেকের মতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আধুনিক আলোচনায় আচরণবাদী তাত্ত্বিক বিপ্লব একটি বৌদ্ধিক আন্দোলন হিসাবে বিবেচিত হয়। এ দিক থেকে দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে।


উপসংহার: তবে সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে আচরণবাদী আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ইস্টনের মত আচরণবাদীদের উদ্যোগেই আচরণবাদোত্তর বিপ্লব (Post-behavioural Revolution)-এর সূত্রপাত ঘটে। এই বিপ্লবের অনুগামীরা সামাজিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ, প্রাসঙ্গিক ও অর্থবহ অনুশীলন ও গবেষণার উপর গুরুত্ব আরোপের পক্ষপাতী। বর্তমানে মার্কিন মুলুকের দার্শনিক ও প্রতিষ্ঠানগত দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।