আচরণবাদোত্তর চিন্তাধারার বৈশিষ্ট্য | রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় আচরণবাদোত্তর চিন্তাধারার বৈশিষ্ট্য

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় আচরণবাদোত্তর চিন্তাধারার বৈশিষ্ট্য


আচরণবাদোত্তর আন্দোলনের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। এই নতুন আচরণবাদের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি অনুধাবন করা আবশ্যক। তা হলে এই নতুন আচরণবাদী ধারণা সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত হওয়া যাবে। এ প্রসঙ্গে ডেভিড ইস্টন তাঁর The Political System গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। ইস্টন এই বৈশিষ্ট্যগুলিকে ‘প্রাসঙ্গিকতার বিশ্বাস' (Credo of Relevance) বলে অভিহিত করেছেন।


(ক) কৌশলের পরিবর্তে বিষয়বস্তুর উপর গুরুত্ব আরোপ: আচরণবাদোত্তর আন্দোলনের কৌশলের পরিবর্তে মৌল বিষয়বস্তুর উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বলা হয় যে, বিষয়বস্তুর তুলনায় কৌশল অধিক প্রাধান্য পেতে পারে না। কৌশলের আগে বিষয়বস্তুকে প্রাধান্য দিতে হবে। এই নতুন বিশ্লেষণে সমকালীন গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যাসমূহের সমাধানের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় গবেষণা ও আলোচনার উপর জোর দেওয়া হয়।


(খ) অভিজ্ঞতাবাদী রক্ষণশীলতার অভিযোগ: অভিজ্ঞতাবাদী রক্ষণশীলতার অভিযোগে আচরণবাদকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। রাষ্ট্রনীতির আলোচনায় তথ্যাদি ও ঘটনার বিচার-বিশ্লেষণ করা দরকার। তা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু এই সবের উপর অধিক পক্ষপাতিত্ব থাকলে ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়বস্তু অনুধাবন করা যাবে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা তথ্য ও ঘটনাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে বিষয়বস্তু আড়াল হয়ে যায়।


(গ) আচরণবাদে রাষ্ট্রনীতির কঠোর বাস্তবতা উপেক্ষিত। আচরণবাদোত্তর আন্দোলন এর বিরুদ্ধে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য হল আচরণবাদী ভাষা বা বক্তব্য যে নীরবতার বাধা সৃষ্টি করেছে তা ভেঙ্গে ফেলা।


(ঘ) আচরণবাদোত্তর আন্দোলন অনুসারে বিজ্ঞান মূল্যবোধ নিরপেক্ষ নয়। এই আন্দোলন মূল্যবোধ সম্পর্কিত গবেষণা ও গঠনমূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলার পক্ষপাতী।


(ঙ) এই আন্দোলন অনুসারে বুদ্ধিজীবীদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব হল সভ্যতার মানবিক মূল্যবোধ (human values of civilization) সংরক্ষণ। ইস্টনের মতানুসারে আচরণবাদোত্তর বিপ্লব হল একটি জ্ঞানগর্ভ বিষয় (learned discipline)। এই বিষয়ের সঙ্গে সংযুক্ত বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের সামাজিক দায়িত্বকে অস্বীকার করতে পারেন না।


(চ) আচরণবাদোত্তর আন্দোলন অনুসারে সামাজিক বিকাশ সাধনের স্বার্থে জ্ঞান প্রযুক্ত হওয়া আবশ্যক। অন্যথায় তা অর্থহীন। সমাজকে উন্নত করার কাজে জ্ঞানকে প্রয়োগ করা হল বুদ্ধিজীবীদের বাধ্যবাধকতা 


(ছ) এই আন্দোলন বুদ্ধিজীবীদের সামাজিক দায়-দায়িত্বের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। বাস্তবে জ্ঞানকে প্রয়োগ করা হল বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব। এই কারণে সমাজের বাস্তব সংগ্রামের সঙ্গে বুদ্ধিজীবীরা ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত।


ইস্টনের মূল্যায়ন: ডেভিড ইস্টনের অভিমত অনুসারে আচরণবাদোত্তর আন্দোলন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। এই বিশ্লেষণের ধারা নতুন দায়িত্ব ও বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের সতর্ক করেছে। তাঁর The Political System গ্রন্থে ইস্টন বলেছেনঃ “The post behavioural revolution in political science is presenting us with a new image of our discipline and the obligation of our profession.” এই নব্য আচরণবাদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় অধিকতর প্রাসঙ্গিক গবেষণা (more relevant)-র উপর গুরুত্ব আরোপ করে। এই আন্দোলন বিশ্ব প্রসঙ্গে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি করেছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মানবিক মূল্যবোধ অনুসারে রাজনীতিক জীবনের বিকাশের ক্ষেত্রে ও সামাজিক সমস্যাদির সমাধানের ক্ষেত্রে সাহায্য করবে।


বিজ্ঞান বলতে কি বোঝায়, সে বিষয়ে আচরণবাদীদের ধারণা তিনটি বিষয়ের সঙ্গে সুদীর্ঘকাল সংযুক্ত ছিল। এই তিনটি বিষয় হল: (১) বিশ্বাসযোগ্য জ্ঞানের জন্য গবেষণার ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত দক্ষতা, (২) ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ব্যস্ততার থেকে বিচ্ছিন্নভাবে মূলগত মতৈক্যকে অনুসরণ এবং (৩) বিজ্ঞানের সামর্থ্যের অতীত বিবেচনায় মূল্যবোধের জটিলতাকে বাদ দেওয়া। আচরণবাদোত্তর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা প্রযুক্তিগত দক্ষতার গুরুত্বের বিষয়টিকে অস্বীকার করেন না। কিন্তু তারা মেনে নিতে চান না যে, বিশ্বাসযোগ্য জ্ঞান ও মূলগত ঐক্যের জন্য সমাজের ব্যবহারিক ক্ষেত্রের বিষয়াদি বা ব্যস্ততা থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের বিচ্ছিন্নতা বজায় রাখতে হবে। আচরণবাদোত্তর রাজনীতিক চিন্তাবিরা এটাও বিশ্বাস করেন না যে, সকল রকম বৈজ্ঞানিক অনুশীলন থেকে মূল্যবোধকে বাদ দেওয়া যাবে।


বিজ্ঞানের সপক্ষে অন্যতম যুক্তি হিসাবে বলা হয় যে, বিজ্ঞানের কিছু আদর্শমূলক অঙ্গীকার আছে। বিজ্ঞানের এই সমস্ত আদর্শমূলক অঙ্গীকারের অংশীদার হল আচরণবাদ। অতঃপর আচরণবাদোত্তর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কিছু জবাবী বক্তব্য আছে। বিজ্ঞানের সেবকরা যদি আশু সামাজিক সমস্যাদির দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকেন, তাহলে বিজ্ঞান সম্পর্কিত ধারণার পরিবর্তন করা উচিত। উত্তর-আচরণবাদীদের অভিমত অনুযায়ী মাথাচাড়া দিয়ে উঠা সামাজিক সমস্যাদির সঙ্গে গবেষণা সংযুক্ত হবে। অর্থাৎ গবেষণার বিষয়টি হবে উদ্দেশ্যমূলক। সমকালীন সমস্যাদির সমাধান অনুসন্ধানের ব্যাপারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের একটা দায়িত্ব আছে।


রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর দায়িত্ব বিদ্যমান অবস্থা বজায় রাখা বা স্থিতাবস্থা সংরক্ষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। রক্ষণশীল রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বিদ্যমান সামাজিক বিন্যাস বা ব্যবস্থা সংরক্ষণের উপর জোর দেওয়ার কথা বলেন। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষণা কেবলমাত্র এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। সমকালীন সামাজিক সমস্যাদি সম্যকভাবে অনুধাবনের ব্যাপারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর গবেষণা প্রাসঙ্গিক হওয়া প্রয়োজন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সমকালীন সমস্যাদির সমাধানের ব্যাপারে উপায় পদ্ধতি সুপারিশ করবেন এবং অভিপ্রেত সামাজিক পরিবর্তনের ব্যাপারে সদর্থক ভূমিকা পালন করবেন।


বিদ্যমান সমাজব্যবস্থায় গভীর সংঘাতের অস্তিত্বের কারণে সংকটের সৃষ্টি হতে পারে। এই সমস্ত সংকটের সন্তোষজনক সমাধান আবশ্যক। যথাযথ সমাধানের জন্য সমকালীন রাজনীতিক কাঠামোকে ভেঙ্গে ফেলে পুনর্গঠিত করার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সততা ও দৃঢ়তার সঙ্গে সদর্থক ভূমিকা পালন করবেন। তিনি সংস্কারমূলক পথের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনে বৈপ্লবিক উপায়-পদ্ধতি সুপারিশ করবেন। তাছাড়া অভিপ্রেত লক্ষ্যে আরও সক্রিয়ভাবে উপনীত হওয়ার জন্য সমকালীন সমাজের পুনর্বিন্যাসের লক্ষ্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সাধ্যমত উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করবেন।