'বিদ্রোহী' কবিতায় বাধাবন্ধহীন যৌবনের যে উল্লাস ও প্রাণাবেগ ধরা পড়েছে, কবিতার কয়েকটি বিশিষ্ট চরণ উদ্ধৃত করে তার পরিচয় দাও।

‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রারম্ভেই কবির এক স্মরণীয় পংক্তি, ‘উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর পংক্তিটিতে কবি নিজেকেই ‘চিরবিস্ময়’ অভিধায় চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু এই কবিতাটিও সৃষ্টির প্রথম লগ্ন থেকেই কবিতা পাঠকদের মনে বিস্ময়ের তরঙ্গ সৃষ্টি করে চলেছিল। কবির ভাগ্যে অভিনিন্দন ও অভিনন্দনের ভরা ডালি কবিকে ‘বিদ্রোহী কবি' রূপে বরণ করে নিয়েছিল। পাঠক মনে প্রশ্নও নানা, উত্তরও নানারকম। কে ‘আমি’? তার স্বরূপই বা কি! কারো মতে এই অনবদ্য কবিতাটি আমেরিকার জাতীয় কবি ওয়াল্ট হুইটম্যানের 'One's-self I sing' কবিতার সঙ্গে তুলনীয়। কারো কথায় শেলীর Promotheus Unbound এর একমাত্র তুলনা। কেউ আবার বলতে চেয়েছেন, এর মধ্যে যে ভাব তা ভারতীয় ‘সোহহং' তত্ত্বের ছন্দোময় প্রকাশ। আমিত্বের এই বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে কবির একাত্মবোধের তত্ত্বই এ সোহহং তত্ত্ব। এ ভিন্ন ‘শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা, ‘যত্র জীব তত্র শিব' প্রভৃতি তত্ত্ব কথাও এখানে প্রকাশ পেয়েছে। সুফী সম্প্রদায়ের ‘আনাল’ হক’ তত্ত্বের প্রতিধ্বনিও এখানে শোনা যায়।


আবার, ‘বিদ্রোহী' কবিতায় সহসা নিজেকে চিনতে না পারা 'আমি'র যে বিদ্রোহ ঘোষিত হয়েছে, প্রাথমিকভাবে এই বিদ্রোহ ভগবানের বিরুদ্ধে, খেয়ালী ভগবানের সৃষ্ট এই সৃষ্টির বিরুদ্ধে, এই জগতের অনিয়ম বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে এবং এই বিদ্রোহ মানুষের যে-কোনো রকম পরাধীনতার বিরুদ্ধে।


কিন্তু এ সব তো তত্ত্বগত উপলব্ধির কথা, এ সবকে পিছনে রেখে কবিতাটি পাঠ করার সঙ্গে সঙ্গে প্রাথমিকভাবে যে ভাবনাটি পাঠক মনে সঞ্চারিত হয়, তা হচ্ছে যৌবনের জয়গান, যৌবনের অমিত উল্লাস। কবি মনে উত্থিত 'যৌবনের এ জল তরঙ্গ রোধিবে কে?


তাই কারো মতে, অধিকাংশ পাঠক মনই এই দলে। যৌবনের উদ্দাম প্রাণাবেগ, ভাবাকুলতা এবং গতিই এই কবিতার অন্তস্থিত শক্তি। আর এই প্রাণাবেগে চঞ্চল কবি নিজেই নিজেকে চেনেন না। আর তাই—

আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা, 

করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পঞ্জা,

আমি উন্মাদ, আমি ঝঞ্ঝা!


উন্মাদ! তা বিশ শতকের প্রথম পাদ-ই তো উন্মাদনার যুগ। বাংলার বুকে তরুণ মন নানা কারণে অশাস্ত্র, অস্থির। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রামের সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা, সামাজিক অস্থিরতা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা, সমাজের চলিত মূল্যবোধের মূল ধরে নাড়া দেয়। রবীন্দ্রনাথের মতো কবিও তরুণ মনের এ অশাস্ত ভাবনাকে স্বাগত জানিয়ে ‘আয়রে আমার সবুজ, আয়রে আমার কাঁচা' বলে ‘সবুজের অভিযান' কবিতায় যৌবনের বন্দনা করেছিলেন নজরুলের ‘বিদ্রোহী' কবিতা সেই যৌবন-বন্দনারই উজ্জ্বল প্রকাশ। কবি আপনার দুর্দমনীয় হৃদয়ের প্রাণাবেগকে প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন—

আমি অনিয়ম, উচ্ছৃঙ্খল,

আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!

আমি মানিনাকো কোন আইন,

আমি ভরা-তরী করি ভরা ডুবি, আমি টর্ণেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!


কবি আরো বলেন—

আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস,

আমি আপনাকে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ।

আমি বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার

আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা-হুঙ্কার।

আমি পিনাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দণ্ড,

আমি চক্র ও মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচণ্ড!

আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা-বিশ্বামিত্র শিষ্য,

আমি দাবানল দাহ, দাহন করিব বিশ্ব।


এইভাবে ‘বিদ্রোহী' কবিতায় নানা প্রচণ্ড শক্তির সহায়তা সূচক রূপকল্পের সমাহার করে কবি আপন হৃদয়ের দুরন্ত আবেগের দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছেন। মহাবিশ্বের মহাকাশ বিদীর্ণ করে ভূলোক, দ্যুলোক, গোলক ভেদ করে, চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা ভেদ করে, খোদার আসন অতিক্রম করে তার আবির্ভাব যেন নাটকীয় ক্রমোন্নতির দিকে এগিয়ে চলে।


কিন্তু মহাভয়ঙ্করের ভয় ধরানো রুদ্র শক্তির আবির্ভাবই তাঁর কবিতার শেষ কথা নয়। বিদ্রোহী বাসুকীর ফণা জাপটে ধরে, শ্রাবণ-প্লাবন বন্যারূপে পৃথিবীকে শস্যশ্যামলা করে তোলার দায়িত্বও তারই থাকে। তাই কবি বলেন—

আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,

আমি অবসান, নিশাবসান!

এও তো নব সৃষ্টির উন্মাদনায় বিদ্রোহী যৌবনেরই স্বপ্ন। 


এই বিদ্রোহী বীর কবি-মানুষটি শুধুই দুরন্ত, দুর্বার, ভয়াবহ, দুর্বিনীত, কল্লোলিত, উচ্ছ্বলিত নয়, সে যৌবনের স্বপ্নে রোমান্টিকও বটে। সে—

আমি বন্ধন-হারা কুমারীর বেণী, তন্বী নয়নে বহ্নি,

আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম-উদ্দাম, আমি ধন্যি।

  ..………..            ………

আমি গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল করে দেখা অনুখন, 

আমি গোপন মেয়ের ভালোবাসা, তার কাঁকন চুড়ির কন্-কন্!

আমি চির শিশু, চির কিশোর,

আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচর কাঁচলি নিচোর!


আপাত দৃষ্টিতে কবির ‘বিদ্রোহী' কবিতার সঙ্গে এই রোমান্টিক কল্পনার সংযুক্তিকে কল্পনার বৈপরীত্য বলে মনে হয়। কিন্তু যৌবন স্বপ্নের সামগ্রিক উপলব্ধিতে এটাই তো স্বাভাবিক। বার্নার্ড শ'য়ের কথায়, যিনি যুদ্ধ ক্ষেত্রে মহাসেনাপতি, তিনি আবার লজেন্সও খান। গ্রামীণ বাংলা প্রবাদে, যিনি রাঁধেন তিনি চুলও বাঁধেন। কবিও বলেন— 

আমি ইন্দ্রাণী-সূত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য,

মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য।


এই বাঁশি ও রণ-ভূর্যের সম্মিলিত ধ্বনিতেই বিদ্রোহীর যৌবন স্বপ্ন সম্পূর্ণতা লাভ করেছে। এবং সব মিলিয়ে আবেগের দুর্বার তীব্রতায় যৌবনের সহনশীলতার পরিবর্তে উন্মাদনার খরস্রোতা পাহাড়ী নদীর যে বন্ধনহীন রূপ ‘বিদ্রোহী'তে ঘটেছে তারই বাঙ্ময় প্রকাশ।


এরপর কবিতাটি এক পরম পরিণতির মহাসঙ্গমে এসে উপনীত হয়। ইতিহাস, পুরাণ, উপপুরাণের বিচিত্র পটভূমিকায় নানা বৈপরীত্য ভাবনার সমাবেশে বিভিন্ন চিত্রকল্পে ধ্বংস ও সৃষ্টির দ্যোতনা প্রকাশের মধ্য দিয়ে যৌবন রঙে রাঙানো হৃদয়ের উত্তাপ পরিশেষে এসে সমাপ্ত হয়। শুধু জেগে থাকে পাঠকের শিরায় শিরায় বিপ্লাবনী রক্ত কণিকার অনুরণন। অক্লান্ত কবির কণ্ঠে উচ্চারিত হয়—

আমি সেইদিন হব শান্ত,

যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, 

অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না

বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত।


কিন্তু এই-ই তো শেষ নয়। অক্লান্ত কবি কণ্ঠে তাই আবার মহামন্ত্র উচ্চারিত হয়— 

আমি ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন, 

আমি স্রষ্টা-সূদন; শোক-তাপ-জ্বালা খেয়ালী বিধির

বক্ষ করিব ভিন্ন।


—পুরনো পৃথিবীর অবশেষ নিয়ে নতুন পৃথিবী গড়ার যৌবন স্বপ্নই নব-উল্লাসে কবিতাটির সর্বাঙ্গে প্রকাশিত। কভু প্রশান্ত কভু অশান্ত কবির বিদ্রোহ চেতনা এইভাবেই অস্থির উদ্দামতা, আবেগকুলতা একটা কেন্দ্র বিন্দুতে স্থির হয়।