'‘বিদ্রোহী' কবিতার বিষয়বস্তু সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করে এই কবিতার মূল বক্তব্য পরিস্ফুট করো।

আত্মশক্তিতে ও নবচেতনালোকে উদ্বুদ্ধ মানবকে তথা নিজেকে, অর্থাত্তরে দেশের যুবশক্তিকে, ‘বীর’-রূপে কবি আহ্বান জানিয়েছেন। আত্মবোধের নব-উপলব্ধিতে দৃপ্ত কবি বলেছেন যে তাঁদের শির চির উন্নত। এই সুউন্নত শিবের কাছে হিমালয়ের সুউচ্চ চূড়াও অবনত হয়। স্রষ্টা বিশ্ব বিধাতার চির-বিস্ময় হচ্ছে এই মানুষ। স্বর্গ, মর্ত্য এমনকি সৌরজগৎ সমন্বিত মহাকাশকে পেরিয়ে ঈশ্বরের মহিমময় সিংহাসনও ছাড়িয়ে এই নবজাগ্রত মানুষ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। ভগবান রুদ্র মানুষের কপালে রাজটীকারূপে জ্বলজ্বল করছেন।


শুধু মানুষের সর্বজয়ী পরিচয়ই নয়, নবজাগ্রত মানুষের প্রচণ্ড ধ্বংসাত্মক বিদ্রোহী রূপের পরিচয়ও কবি দিয়েছেন। ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা নিয়ে এই বিদ্রোহী শক্তি প্রলয়ের দেবতা নটরাজের মতো, বিধ্বংসী সাইক্লোনের মতো, অকাল বৈশাখীর রুদ্ররূপের মতো ভয়াবহ টর্পেডো বা ভাসমান মাইনের মতো দুর্দমনীয়। খেয়ালী বিশ্ব-বিধাতার খেয়ালী সৃষ্টির বিরুদ্ধে এই মানুষ চিরবিদ্রোহী।


শুধু ধ্বংসই এই বিদ্রোহীর একমাত্র কাম্য নয়, নতুন সৃষ্টির জন্যই জরা-জীর্ণ পুরাতনকে সে ভাঙতে চায়। তাই মুক্ত জীবনের আনন্দে কখনো সে চপল, চঞ্চল, আবার প্রয়োজনে সে বিশ্বের ত্রাস। শাসন-শোষণের অবসান ঘটিয়ে চিরঅধীর এই শক্তি চির উন্নত শির।


একই সঙ্গে সৃষ্টি ও ধ্বংস এই শক্তিরই দ্বিমুখী প্রকাশ। এর এক হাতে বাজে সৃষ্টির আনন্দ সঙ্গীত অন্য হাতে নিনাদিত হয় প্রলয়ের তূর্য্য ভালে। সূর্য, হাতে চন্দ্র কার্তিকেয় এই দ্বিমুখী শক্তিরই প্রতীক।


এই শক্তি কখনো প্রশান্ত, কখনো অশান্ত। সেই সঙ্গে এরই মধ্যে রয়েছে অনাসক্তি, রয়েছে বৈরাগ্যের সুর। এই শক্তি বেদুইন, চেঙ্গিস খাঁর মতোই উদ্দাম স্বাধীন, ইন্দ্রের বজ্র, ইস্রাফিলের শিঙা, ধর্মরাজের দণ্ড, ক্ষ্যাপা দুর্বাসার মতোই ভয়ঙ্কর, আবার নৃত্যচপল ঊর্মিমালার উচ্ছল উজ্জ্বলতার মতোই মধুর।


আপন শক্তির প্রচণ্ডতা যেমন কবি নিজে অনুভব করেছেন তেমনি মাঝে মাঝে বিদ্রোহীর রুদ্ররূপ রোমান্টিক চেতনায় কখনো শান্ত হয়ে উঠেছে, শান্ত হয়ে উঠেছে উৎপীড়িতের সঙ্গে সহমর্মিতায়। তরুণীর গোপন কটাক্ষ এবং উদ্দাম ভালোবাসার সঙ্গে, বিধবার ক্রন্দন, বঞ্চিত ও গৃহহীনের ব্যথা-বেদনার সঙ্গে নিজেকে এক করে ভেবেছেন। এই বিদ্রোহ মন শুধু শুষ্ক কঠোরই নয়। তিনি একই সঙ্গে উত্তুরে হাওয়া, দক্ষিণা মলয় পবন এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে উদাসী, বিবাগী। আত্মোপলব্ধির মধ্য দিয়ে সহসা নিজের স্বরূপ তাঁর কাছে উদ্ঘাটিত হয়, সঙ্গে সঙ্গে সীমার বাঁধন তাঁর খুলে পড়ে। এই ভাবঘন মুহূর্তে ভাল-মন্দের তথাকথিত বিচার তাঁর কাছে অর্থহীন মনে হয়। ভাবের প্রচন্ড আবেগে তিনি উন্মাদ। নিজেকে নিয়ে কি করবেন তিনি ভেবে পান না। জাপটে ধরেন বাসুকির ফণা, সাপটে ধরেন জিব্রাইলের আগুন-পাখা।


বারবার তিনি আপন উপলব্ধ শক্তির সম্মোহিনী রূপ ও তার ভয়ঙ্কর প্রমত্ততা অনুভব করেছেন। এই শক্তিতেই তিনি অর্ফিয়াসের মতো, শ্রীকৃষ্ণের মতো আপন বাঁশির মোহিনী প্রভাবে বিশ্বকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে পারেন। আবার তাঁর রুদ্রমূর্তি দেখে নরকের ভয়ঙ্কর আগুনও নিভে যায়।


এই শক্তিই বন্যার মতোই ধরণীকে কখনো উর্বর, কখনো ঊষর করে তুলবে। একদিকে তিনি উচ্চা, শনি, ধূমকেতুর মতো চরম অশুভ শক্তি। রুদ্রাণীরুপে ভয়ঙ্করী ছিন্নমস্তা চণ্ডী। এই প্রলয় ও ধ্বংসের মধ্যেই তিনি আবার অমলিন পুষ্পের হাসি, শ্রী ও সমৃদ্ধি।


আত্মোপলব্ধির চরম মুহূর্তে কবির মধ্যে আত্মবোধের যে প্রসারণ ঘটে তার ফলে বিশ্বের সবকিছুর মধ্যেই তিনি নিজেকে অনুভব করেন। বিশ্বের চেতন, অচেতন সবকিছুর মধ্যেই তিনি চিরনবীন, চিরঅমর, অক্ষয়, অব্যয়। ভাবনার তুরীয় অবস্থায় কবির বিশ্বাত্মার সঙ্গে যোগে নিজেকে পুরুষোত্তম বলে মনে হয়, পরম সত্যের মুখোমুখি হন। আত্মবোধের এই অবস্থা সাধারণ অবস্থা নয়, তাই এই অবস্থা বোঝাতে নিজেকে উন্মাদ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছেন না।


আপন এই অজেয় শক্তি নিয়েই তিনি হয়ে উঠবেন পরশুরামের কুঠার, বলরামের হল। কুঠার দ্বারা অন্যায় অত্যাচার নির্মূল করে হল দ্বারা বহু কর্ষিত জমিতে নতুন সৃষ্টির ফসল ফলাবেন।


চরম উপলব্ধির অপগত মুহূর্তে ক্লান্তির কথা মনে হলেও উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোলকে শান্ত না করা পর্যন্ত তাঁর এই বিদ্রোহে ক্ষান্তি নেই। ভৃগুর মতো তিনিও কঠোর পদাঘাতে দুঃখ-কষ্ট-স্রষ্টা খেয়ালী বিধাতাকে ধ্বংস করবেন। অত্যাচারীকে দমিত করতে বিশ্বজয়ী উন্নত মস্তকে তিনি থাকবেন চির-বিদ্রোহী।


১৯২১ খ্রিস্টাব্দের দুর্গাপূজার কাছাকাছি সময়ে তালতলার এক বাসায় একদিন সারারাত আলো জ্বালিয়ে নজরুল এই কবিতাটি লেখেন। ঐ সময়ের বাংলা এক অশান্ত বাংলা, একদিকে প্রথম মহাযুদ্ধের ধূমাচ্ছন্ন কালিমা ও শ্বাসরোধী পরিবেশ এবং সেই সঙ্গে শক্তিমত্ত ব্রিটিশ রাজশক্তির দমন-পীড়ন, স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গিত অগণিত তাজা প্রাণের বলি, সেকালের দেশপ্রেমিক মানুষের মনে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও বিদ্রোহ যে অনির্বাণ শিখায় জ্বলে উঠেছিল নজরুলের 'বিদ্রোহী' কবিতা তারই ভাষারূপ। পরাধীনতাজনিত দহনজ্বালা কবিতার উৎসমুখে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে উদ্‌গীরিত লাভাস্রোতের মত বেরিয়ে এসেছে। এই জ্বালাবোধ থেকেই তিনি উন্মাদ হয়ে গেছেন, ‘দিল্লীশ্বরো’ বা ‘জগদীশ্বরো’ বা বিদেশী শক্তির সাজান-গোছান যক্ষপুরীকে তিনি লণ্ডভণ্ড করে দিতে চান, চান ধ্বংস করতে। এই পরাধীনতার বিরুদ্ধে, এই শোষণ, অত্যাচার, অনাচরের বিরুদ্ধেই তাঁর বিদ্রোহ। আর এই বিদ্রোহকে সফল করতেই তিনি তাঁর মধ্যে শক্তির জাগরণ, ভয়ানকের জাগরণ জাগিয়ে তুলতে চাইছেন। তাঁর এই বিদ্রোহ তাই বিদেশী শাসকের বিরুদ্ধে, সমাজের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে, শোষক ও শাসকের বিরুদ্ধে এবং খামখেয়াল-খুশিতে ভরা খেয়ালী বিধির বিধানের বিরুদ্ধে। অবশ্য শুধু ভাঙ্গাই তাঁর বিদ্রোহের শেষ কথা নয়। তিনি ভাঙতে চান গড়বার জন্যই। বিশ্বকে উপড়ে ফেলবেন, বিশ্বকে উর্বর করে নতুন সৃষ্টির ফসল ফলাবার জন্যই। তাঁর রুদ্ররূপের শেষকথা রুদ্ররূপ নয়, শান্তরূপ। তাই কবির ‘এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তূর্য”। শুধু ভাঙ্গার বিদ্রোহ নয়, গড়ারও বিদ্রোহ।


কবিতাটি রচনার সমকালীন দেশের ক্ষোভ, যুগ-বাসনা ও যুগ-মানসিকতা এই ‘বিদ্রোহী’ কবিতার পটভূমি রচনা করেছে। কবিও আত্মশক্তিতে, আত্মবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে দেশের 'বীর' মানুষ ও ‘বীর’ যুবকদের আহ্বান জানিয়েছেন বিদ্রোহের মন্ত্রে দীক্ষা নেবার জন্য। কিন্তু এই বোধ ও এই বক্তব্যেই কবিতাটি শেষ হয়ে যায় নি। কবিতাটির মধ্যে নজরুল আত্ম-উপলব্ধির আরো গভীরে অবতরণ করেছেন। আত্মবোধের প্রসারণের মধ্য দিয়ে তিনি বিশ্ববোধে, বিশ্বাত্মবোধে উত্তীর্ণ হয়েছেন। বিশ্বে চেতন-অচেতন সবকিছুর সঙ্গে শুধু সহমর্মিতা নয়, সবকিছুকেই নিজের সঙ্গে এক বলে ভেবেছেন। এই ভাবনাবোধ কবিকে রোমান্টিক-মিষ্টিক বোধের দ্বারপ্রান্তে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। কবির আত্মবোধ, আত্মশক্তির এই মহাজাগরণের ফলেই কবি বলে উঠেছেন, 'আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ।' এই বোধ শুধু রোমান্টিক কবির বোধ নয়, এই বোধ সাধক কবির বোধ। এই ভাবঘন মুহুর্তের তুরীর অবস্থাতেই কবি বলতে পারেন,

“আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়, 

আমি 'অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়।

      …………..     ………….

জগদীশ্বর ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য

আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!!

আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ।।”


এই বিশ্বাত্মবোধের মধ্য দিয়ে কবি-মনে যে 'বড় আমি’র উপলব্ধি, 'ছোট আমি'র অহংকারের কোরক ভেঙে ‘বড় আমি'র অহংবোধের জাগরণ, 'অহং'-এর মধ্যে 'সোহহং'-এর উপলব্ধি, তারই স্বাক্ষর ছড়িয়ে রয়েছে ‘বিদ্রোহী' কবিতার সর্বাঙ্গে। একদিক দিয়ে কবির এই বিদ্রোহ তার 'ছোট আমি'র বিরুদ্ধে ‘বড় আমি’র বিদ্রোহ, আপন ক্ষুদ্রতা, তুচ্ছতা, সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং বিশ্বের সঙ্গে একাত্মবোধের দ্বারা বিশ্বকে ভালোবেসে বিশ্বের যা-কিছু অসুন্দর যা-কিছু অন্যায়, যা কিছু অনাচার, অবিচার, শাসন, শোষণ সবকিছুর বিরুদ্ধেই তাঁর বিদ্রোহ বিঘোষিত হয়েছে। প্রয়োজনে তিনি বিশ্ব-বিধাতার বিরুদ্ধেও বিদ্রোহে পশ্চাৎপদ নন। কারণ বিশ্বকে চিনে বিশ্ব বিধাতাকে চিনে তিনিও তো বিশ্ববিধাতার সমকক্ষই হয়ে উঠেছেন। 'ব্রয়জ্ঞ ব্রখৈব ভবতি।' ব্ৰষ্মকে জানলে ব্রষ্মই হয়ে যায়। এই ঈশ্বরের শক্তি নিয়েই তিনি ঈশ্বর-সৃষ্ট জগতের ত্রুটি সংশোধন করবেন। সুন্দর ও শান্তি প্রতিষ্ঠা কামনায় এই জাগতিক সর্বপ্রকার অসুন্দরের বিরুদ্ধে চিরবিদ্রোহের বাণীই তাঁর ‘বিদ্রোহী' কবিতায় ধ্বনিত। কবির এই বিদ্রোহ গভীর মানবপ্রেম থেকেই সঞ্জাত।