'নিরুদ্দেশ যাত্রা' কবিতাটি বিশ্লেষণ করে কবির মনোভঙ্গির বৈশিষ্ট্য বুঝিয়ে দাও।

কবি-জীবনের প্রভাতকালে কোনো এক বিদেশিনী কবিকে ডেকেছিল এবং কোন্ দূর কল্পলোকের উদ্দেশ্যে তিনি তাঁরই তরণীতে যাত্রা করেছিলেন। কিন্তু সেই ‘সোনার তরী’ বহু পথ অতিক্রম করলেও যাত্রা সমাপ্তির কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কবি জানেন না, তরী তাঁকে কোথায় নিয়ে চলেছে। তরীর নাবিককে প্রশ্ন করে কোনো উত্তর পাওয়া যায় না। সে শুধু অঙ্গুলি তুলে অকূল সমুদ্রের তরঙ্গোচ্ছ্বাসের দিকে নির্দেশ করে রহস্যপূর্ণ হাসি হাসে। আকাশে সূর্য অস্তায়মান, দিন শেষ হয়ে এল, কিন্তু, কূলের কোনও নিশানা দেখা যাচ্ছে না।


রাত্রির আবির্ভাবে সমুদ্রের জলরাশি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল, মনে হতে লাগল যেন অসীম রোদন জগৎকে প্লাবিত করেছে। সেই ভীতিসঞ্চারী জলরাশির মধ্য দিয়ে তরণী ধাবমান, কিন্তু নাবিকা নিরুদ্বিগ্ন, তার মুখ নীরব হাসিতে উদ্ভাসিত।


অনেক সময় অতীত হল, কখনও সংশয়, কখনও আশা কবিচিত্তকে দোলায়িত করেছে। যে অন্ধকারের দিকে চলেছে তরী সেখানে অন্তত মরণের স্নিগ্ধতাটুকু পাওয়া যাবে কিনা, কবির এ প্রশ্নেরও কোনও জবাব মেলে না।


রাত্রির অন্ধকার গাঢ়তর হলে সঙ্গিনীর মুখখানি চোখে পড়বে না। শুধু বাতাসে ভাসবে তার দেহসৌরভ, তার কেশরাশি উড়ে এসে স্পর্শ করবে কবিকে। প্রশ্নের কোনো উত্তর মিলবে না, অন্ধকারে তাঁর নীরব হাসিও চোখে পড়বে না।


এই কবিতায় কবির যে মনোভাব প্রকাশিত তাতে আশা ও আশঙ্কা দুইই প্রকাশিত। কোনও একটি আকাঙ্ক্ষার পূর্ণতাই কবির লক্ষ্য—সে আকাঙ্ক্ষা নিরুপাধি সৌন্দর্য লাভের আকাঙ্ক্ষা। ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কবির ভাবজীবনের সেই বাসনার একটি রূপক। কিন্তু রূপকটির অন্তরালে দুটি তত্ত্ব নিহিত আছে—জীবনের নিয়ন্ত্রী এক অন্তর্যামী শক্তির উপলব্ধি, সোনার তরী বহিত্র বাহিনীরূপে যার আবির্ভাব। দ্বিতীয়ত, সৌন্দর্য সাধনায় কবির আশঙ্কা ও ক্লান্তি। সৌন্দর্যজগতের অসীমতা ভীতি সৃষ্টি করে যে আদৌ শেষ তীর্থে পৌঁছান সম্ভব কিনা। কবি আশা করেছিলেন ঐ সৌন্দর্যসাধনায় উদ্বেগ ও সংশয় দূর হয়ে যাবে, কিন্তু এখন বোধ হচ্ছে, এ পথের শেষ নেই। তাই মোহিনী নাবিকার কাছ থেকে ভরসা চান। সঙ্গিনীর রহস্যময় হাসিতে সে ভরসা মেলে। কিন্তু সংশয়ও একেবারে দূর হয় না।


‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কবিতায় যে কবির সৌন্দর্যের নিরুদ্দেশ আকাঙ্ক্ষাই প্রধান, কবিতাটির নামকরণেই তার স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কিন্তু এ আকাঙ্ক্ষা লাভ করার প্রচেষ্টাই হোক বা অন্য যে কোনো রকম প্রয়াসই হোক, কবি উপলব্ধি করেন যে জীবনের অন্তরালে বসে কোনও একটা শক্তি সকল প্রচেষ্টার ও অভিজ্ঞতার মাঝ দিয়ে তাঁকে চালিত করে নিয়ে চলেছে। জীবনের অন্তরালবর্তী সেই শক্তিকে সজীব কল্পনা করে তিনি রূপকের মাধ্যমে তাকে উপস্থিত করবার চেষ্টা করেছেন।


কবি-জীবনের নিয়ন্ত্রী শক্তি এই সজীব সত্তা যিনি এই কবিতায় নারীরূপে কল্পিতা, তাঁর উপরে ভরসা রেখেই কবি যাত্রা করেছেন। সৌন্দর্যের পরিপূর্ণ জগতে উত্তীর্ণ হবেন, এই আশা প্রাণে জাগছে। তাঁর নীরব হাসি নিশ্চয়তার আশ্বাসরূপেই কবির মনে প্রতিভাত হয়েছে, যদিও সংশয়ের ভাবটা সম্পূর্ণ দূরীভূত হয়নি। নিজের জীবনের এবং কাব্যসাধনার দিক থেকে আশা-নৈরাশ্যে আন্দোলিত কবিমানসের পরিচয় লিপিবদ্ধ হয়ে রয়েছে এই কবিতায়।