বিষয় এক নামও এক রবীন্দ্রনাথের কোন কোন ব্যাক্যাংশ ও ব্যবহৃত হয়েছে কিংবা সেই জন্যই এটি সত্যকারের মৌলক রচনা হতে পেরেছে, রবীন্দ্রনাথকে অবলম্বন ক'রে তারপর তাঁকে ছাড়িয়ে যাওয়ার এর চেয়ে ভালো দৃষ্টান্ত বাংলা কবিতায় নেই বললেই চলে।” সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘বধূ' কবিতাটির আলোচনা করে এই মন্তব্যের যাথার্থ্য বিচার করো।

আধুনিক বাংলা কাব্যের একটি অন্যতম লক্ষ্য হ’ল, একদিকে যেমন ‘রূপদক্ষ সুশোভন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর' থেকে সরে আসা, তেমনি সেই সঙ্গেই আবার রবীন্দ্র ঐতিহ্যকে নূতন ভাবমণ্ডলে নূতনরূপে ব্যবহার করা। ইংরেজি কাব্যে টি. এস. এলিয়ট আধুনিক কাব্যের এরূপ ঐতিহ্যচর্চার ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন পূর্বগামী কবিদের কবিতার অংশবিশেষ কখনও বা বিসদৃশ ভাবনাসূত্রে। রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক বাঙালি কবিরাও তেমনি ব্যবহার করেছেন রবীন্দ্ররচনার অংশ তাঁদের কবিতার সদৃশ বা বিসদৃশ ভাবমণ্ডলে এবং এইভাবে একই সঙ্গে রবীন্দ্রোত্তরণ ও রবীন্দ্রনাথের উত্তরসাধনা মিলিত সঙ্গতি লাভ করেছে আধুনিক কাব্যসাধনায়।


সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘বধু’ কবিতাটি আধুনিক কাব্যকলার অনুরূপ কবিকর্মের এক অত্যুজ্জ্বল নিদর্শন। ‘পদাতিক' কাব্যগ্রন্থের এই কবিতাটির নাম ও বিষয় রবীন্দ্রনাথের ‘মানসী' কাব্যের অন্তর্গত ‘ৰধূ’ কবিতা থেকে নেওয়া। গাঁয়ের বালিকা বধূ হ'য়ে শহরে এসেছে ; এই শহরের ইমারতে আড়াল-করা বদ্ধ আকাশের নীচে তার মনে কোনো শাস্তিসুখ নেই,–রবীন্দ্রনাথের ‘বধূ’ কবিতার এই মূল ভাবটিই সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতাও বিষয় হয়ে কবিতার এই মূল ভাবটিই সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতারও বিষয় হয়ে উঠেছে। তাই রবীন্দ্রনাথের বধূ যেমন পাষাণকায়া নগরীর বন্ধ দেওয়ালের মাঝখানে বসে গ্রামের মুক্তজীবনে মুক্তপ্রকৃতি ও সহৃদয় সখীদের কথা মনে করে এবং মাকে স্মরণ করে অশ্রুজলে ভাসে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বধূও তেমনি নগরের অসুখী জীবনের মাঝখানে গ্রামের কথা মনে করে আত্মঠাটা-মেশোনো দীর্ঘশ্বাস মোচন করে। উভয় বধূর মনেই ধরা পড়েছে, গ্রামের জীবনের তুলনায় শহরের জীবন কতো অকরুণ নিষ্ঠুরতায় ভরা এবং উভয় কবিতাতেই বিভিন্ন অনুসঙ্গে দেখা নিয়েছে, ‘পুরণো সুর’, ‘দীঘির কালো জলে’, ‘পাষাণকায়া রাজধানী’, ‘সবার মাঝে একেলা ফেরা’, ‘হেথায় কাঁদা বৃথা' ইত্যাদি দীর্ঘশ্বাস জড়ানো কথাসমূহ, সব মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথের গোটা কবিতাটিরই সূক্ষ্ম উপস্থিতি নির্ভুলভাবে টের পাওয়া যায় সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতাটির পেছনে।


অথচ রসপরিণামে ও আস্বাদে দুটি কবিতা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। রবীন্দ্রনাথের বালিকা বধূ সমস্ত কবিতায় যে-বেদনার আতশ্বাস ছড়িয়েছে তা রোমান্টিক ব্যাকুলতারই সগোত্র। আর সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বধূর বেদনা দারিদ্র্য পীড়িত এক নাগরিক নারীর ফেলে আসা গ্রামের স্বাচ্ছন্দ্যের কামনা থেকে জাত; এ-বধূর অনুভূতিতে রোমান্টিকতার স্পর্শমাত্রও নেই। এ বধূর মনে শহরের হাব্ ভাব অনেকখানি প্রবেশ করেছে, সে তাই সদ্য-আগত গ্রাম্য বালিকাবধূর মতো শুধুই গ্রামের স্বপ্নে অশ্রুপাত করে না, নিজের বিড়ম্বিত জীবনকে নিয়ে লঘুচপল ব্যঙ্গোক্তিও করতে পারে। রবীন্দ্রনাথের বধুর মনে 'বেলা যে পড়ে এল, জলকে চল্' ডাকের সুর এক আতুর Nostalgia-র সৃষ্টি করেছে; স্মৃতির স্রোতে ভেসে গিয়ে তার মনে পড়েছে, কলসি কাঁখে নিয়ে ঘাটে যাবার সেই বাঁকাপথ, ডাইনে বাঁশবন ও বামে ধূ ধূ মাঠ, আর—

দিঘির ঘন বন    সাঁঝের আলো ঝলে,

দুধারে ঘন বন ছায়ায় ঢাকা। 

গভীর থির নীরে    ভাসিয়া যাই ধীরে

পিক কুহরে তীরে অমিয়-মাখা।

পথে আসিতে ফিরে    আঁধার তরুশিরে

সহসা দেখি চাঁদ আকাশে আঁকা।


এই গ্রামের স্মৃতিই তার সম্পূর্ণ মনকে আচ্ছন্ন করে আছে বলে শহরকে চেনবার জানবার অবকাশ তার হয়নি। আর তাই সে শহরের কাছেও ভুল করে কামনা করে গ্রামের সেই সরল স্নেহ ও অকৃত্রিম ভালোবাসা যা গ্রামের প্রকৃতির মতো নির্মল, মুক্ত ও উদার এবং এই ভুলের মাশুল পায় সবার চোখের সংশয়ে, আর শাসনের ঝড়ে। অপরদিকে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বধুর মনে কোনো স্বপ্নাচ্ছন্নতা নেই। একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে গ্রামজীবনের স্মৃতি ক্ষণিকের জন্য বিচলিত করে মনকে, তুলনায় শহরজীবনের দুঃখ আরেকটু তীব্র হয়ে বাজে বুকে, কিন্তু তারপর শহরের অনিবার্য গ্রামের কথাই মনে ভাবে সে, যেখান থেকে মুক্তি পাবার কানো পথই নেই তার। সে জেনেছে না চাইলেও এই শহরকেই মেনে নিতে হবে তাকে। তাই রবীন্দ্রনাথের বধূ ‘হেথায় বৃথা কাঁদা' জেনে যেখানে আর্তনাদ করেছে—

দিঘির সেই জল    শীতল কালো

তাহারি কোলে গিয়ে মরণ ভালো।


সেখানে এ-বধূ বলে—

বুঝেছি কাঁদা হেথায় বৃথা ; তাই

কাছেই পথে জলের কলে, সখা

কলসি কাঁখে চলছি মৃদু চালে

গলির মোড়ে বেলা যে পড়ে এল।


অর্থাৎ এ-বধূর স্বভাব স্থান পেয়ে গেছে আধুনিক নাগরি ব্যক্তিত্বের আত্মাদ্বিধা, সুখী না হলেও অনিবার্যকে মেনে নেবার মানসিক বক্রতা।


ফলত দুটি কবিতার আবহও হয়ে উঠেছে বিভিন্ন । রবীন্দ্রনাথের কবিতায় প্রধান হয়ে উঠেছে রোমান্টিক সৌন্দর্যম্বপ্নে ভরা গ্রামের প্রকৃতি, আর সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ‘গ্যাসের আলো জ্বালা’ সন্ধ্যায় এক শহরের গলি, যেখানে—

পুরণো সুর, ফেরিওয়ালার ডাকে 

দূরে বেতার বিছায় কোন্ মায়া।


উপরন্তু এই বিড়ম্বিত অসুখী বধূর মনে যখন অকস্মাৎ গ্রামের স্মৃতি, জাগল, 'পড়ল মনে খাসাঁ জীবন সেথা' তখন দেখা যায় সেই স্মৃতির ছবিটিও কোনো অর্থেই রোমান্টিক সৌন্দর্যম্বপ্নের রেখায় ফুটে ওঠেনি। গ্রাম্য স্বাচ্ছন্দ্যের স্পৃহা মাত্র উঁকি দিয়েছে দরিদ্র বধূর মনে। 

সারা দুপুর দীঘির কালো জলে

গভীর বন দুধারে ফেলে ছায়া 

ছিপে সে ছায়া মাথায় করো যদি

পেতেও পারো কাৎলা মাছ প্রিয়।


অথবা এখনও হতে পারে, বধূর মনে কল্পনা জাগে, যে তারা দুজনে অঙ্গে গেরুয়া বাস টেনে গ্রামের বাঁধা ঘাটেকুটির বাঁধতে পারে। তাহলে তাদের কাছে আসবে সেই লোকজন যারা সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীর কাছে যায় ভাগ্য ফেরাবার আশায়, আর রেখে আসে তাদের যৎসামান্য উপাজিত কড়ি। সেই কড়িতে তাহলে দিন কাটানো ভার হয়ে উঠত না এখনকার মতো। তাই বধূর মনে আর্তি জাগে—

পাষাণ-কায়া, হায়রে রাজধানী

মাশুল বিনা স্বদেশে দাও ছেড়ে 

তেজারতির মতোন কিছু পুঁজি

সঙ্গে দাও, পাবে দ্বিগুণ ফিরে।


আবার শহরে প্রকৃতিও গ্রামের প্রকৃতির মতো মুক্ত উদার নয় এতটুকু। শহরের প্রকৃতির ব্যবহার যেন সুদখোর কাবুলিওয়ালার মতো,—অতিকৃপণের সৌন্দর্যসম্বল থেকে কিছু ধার দেয় মাত্র। তাই যখন ‘ছাদের পারে হেথাও চাঁদ ওঠে, তখন দরিদ্র বধূর মনে কোনো রোমান্টিক সৌন্দর্যের কল্পনা জাগে না; বরং উল্টোপক্ষে—

দ্বারের ফাঁকে দেখতে পাই যেন

আসছে লাঠি উচিয়ে পেশোয়ারি 

–ব্যাকুল খিও সজোরে দিই তুলে।


এমনই যেখানে পারিপার্শ্বিকতা সেখানে নিষ্ঠাস্নিগ্ধ ভালোবাসারই বা স্থান কোথায়? এই শহরে সংকীর্ণ কৃত্রিম আবহাওয়ায় বধূ তাই প্রিয়হারা, এবং প্রতিবেশীদের চোখের দৃষ্টি কুটিল কৌতূহলে ভরা।

ইহার মাঝে কখন প্রিয়তম,

উধাও; লোকলোচন উঁকি মারে।


কাজেই এই ভিড়ের শহরে বহু জনতার মাঝখানে আপন দুর্ভাগ্য নিয়ে বধূ একা নিঃসঙ্গ ; শহরের বন্ধ্যা একাকীত্ব তাকে অধিকার করেছে নিষ্ঠুরভাবে। তার মনে হয়—

লেকের কোলে মরণ যেন ভালো।


অথচ তা সম্ভব নয়। অতএব অনিবার্য শহুরে নিয়মিত হাতেই নিজেকে সমর্পণ করে সে।

এমনিভাবেই লঘু ঠাট্টার সুরে শহরের এক দরিদ্র বধূর নিষ্ফল নিঃসঙ্গতাকে ব্যক্ত করেছেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথের মতো কোনো পল্লিবালিকার বাল্যস্বর্গচ্যুতির রোমান্টিক বেদনা নয়।


অথচ কবিতাটির এমনই কলাকৌশল যে, এমন অ-রোমান্টিক বেদনার কবিতাও আমাদের মনে রোমান্টিকতামিশ্র এক বেদনার বোধ জাগিয়ে তোলে, যে-বোধে বধূর শহরজীবনের নিষ্ফল শূন্যতা আরও তীব্র হয়ে বাজে। বস্তুত এখানেই কবির আশ্চর্য কৃতিত্ব। আজন্ম রোমান্টিকতাবিরোধী কবি তাঁর এই কবিতার সর্বাঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত রোমান্টিক কবিতাটিকে এমনভাবে জড়িয়ে নিয়েছেন যে, কবিতাটি পাঠ করার সময়ে আমাদের মনে রোমান্টিক ব্যাকুলতার স্পর্শ না লেগে পারে না। আর এর ফলেই কবিতাটির লঘু ঠাট্টার সুর এমন মর্মান্তিক হয়ে আমাদের চিত্তে বাজে; এর বিদ্রুপ শুষ্ক ক্ষোভের সৃষ্টি না করে সহানুভূতির বেদনায় আমাদের ব্যথিত করে তোলে। আধুনিক নগরজীবনের বন্ধ্যাত্ব ও নিষ্ফল অকরুণ শূন্যতা নিয়ে লেখা আধুনিক কবিদের অন্যান্য কবিতা থেকেও এই কবিতাটির আবেদনের পার্থক্য এজন্যই। সুধীন্দ্রনাথ, কিংবা বিষ্ণু দে অথবা সময় সেনের কবিতা পড়ে আমাদের মনে জাগে ক্ষোভ; কখনও নিরাশ্বাস বিষাদ, কখনও বা ক্রোধ, কিন্তু সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের 'বধূ' পড়ে আমরা অনুভব করি এক অসংসক্ত সমবেদনা, যা আধুনিক মননেরও অভাব নেই এ-কবিতায়, কিন্তু সে-মনন রূঢ় নয় আধুনিক কবিতার মননধর্মের মতো। সে মদনের সঙ্গে সহজেই জড়িয়ে গেছে হৃদয়ের কোমল অনুভূতি। বস্তুত আধুনিক মনন ও হৃদয়ানুভূতির এই অসামান্য সৌষম্যের গুণে কবিতাটি সত্যেই হয়ে উঠেছে আধুনিক বাংলা কাব্যের একটি যথার্থ মৌলিক সৃষ্টি ; রবীন্দ্রনাথকে অবলম্বন ক'রে রবীন্দ্রনাথকে ছাড়িয়ে যাওয়ার কারুকৌশলে আধুনিক বাংলার একটি অদ্বিতীয় কবিতা।