ঐতিহাসিক নাটকের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য দিয়ে উদাহরণ সহ বিশ্লেষণ করো।

নাটকের বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় সর্বাগ্রে যে ধারাটি স্মরণে আসে তা হল ঐতিহাসিক নাটক। এই ঐতিহাসিক নাটকের সংজ্ঞা নিরূপণ করতে গিয়ে খুব সহজভাবে বলা যায়, যে নাটকের বিষয়বস্তু ইতিহাস থেকে সংগৃহীত তাকে বলা যেতে পারে ঐতিহাসিক নাটক। তবে এই ঐতিহাসিক নাটকালোচনায় কয়েকটি বৈশিষ্ট্য ও লক্ষণ এর কথা মনে রাখা আবশ্যক। প্রথমত বিষয়বস্তু যেখান থেকেই সংগ্রহ করা হোক, সাহিত্যকৃতিকে আগে নাটক হতে হবে। নাটক হয়ে ওঠার শর্ত পূর্বাপর মানতে হবে। কেবল উক্তি প্রত্যুক্তি বন্ধে রচিত হলেই তা নাটক হয় না—জীবনের দ্বন্দ্ব নাটকের প্রাণ। তা যদি ইতিহাস আশ্রিত কোনো কাহিনিতে পাওয়া যায় তা গ্রহণ করা যেতে পারে। কিন্তু ইতিহাস থেকে যে কোনো কাহিনি আহরণ করে তা দিয়ে নাটক রচনা করা যায় না। তা নাটকও হয় না, ‘ঐতিহাসিক’ নাটকও হয় না। ‘ঐতিহাসিক’ শব্দটি নাটকের বিশেষণ। ইতিহাসের কোনো কাহিনিতে উপযুক্ত নাটকীয়তার সন্ধান পেলে তাকে সমর্থ নাট্যকার নিশ্চয়ই গ্রহণ করতে পারেন, যেমন করেছেন শেকসপিয়র জুলিয়াস সীজার বা ক্লিওপোটার জীবনের দ্বন্দ্বময়তা নিয়ে অথবা দ্বিজেন্দ্রলাল রায় সম্রাট শাজাহানের পিতৃসত্তা ও রাজসত্তার দ্বন্দ্ব নিয়ে।


দ্বিতীয়ত ইতিহাসের সভ্যতা ও ইতিহাসের প্রতি শিক্ষা নিয়ে, নাটক রচনা করতে হবে। ইতিহাস পাঠ নেবার জন্য যেমন কেউ ঐতিহাসিক নাটক পড়েন না, তেমনি ইতিহাসের ধারণাকে বিকৃত করার অধিকারও কোনো সাহিত্যিকের নেই। সাহিত্যিক যেহেতু ঐতিহাসিক নয়, ইতিহাসের খুঁটিনাটি তথ্য সম্বন্ধে তিনি অবহিত থাকবেন এটা আশা করা উচিত নয়—যেমন মুঘল আমলের কোনো একটি ঘটনা বা রাজপুত জাতীয় ইতিহাসে সংগঠিত কোনো ঘটনার প্রত্যেকটি অনুপুঙ্খ লেখক বিবৃত করবেন এটাও কখনও প্রত্যাশিত নয়। কারণ, তিনি ইতিহাসের বিবরণ দিতে বসেননি। কিন্তু সেইসঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রাপ্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে কোনো চরিত্র সম্বন্ধে সে ধারণা গড়ে তুলেছেন তা বিকৃত করার অধিকারও নাট্যকারের নেই। জুলিয়াস সীজার সম্পর্কে একটি ধারণা ঐতিহাসিকগণ গড়ে তুলেছেন। নাটক পড়ে যদি সে ধারণা ভেঙে যায় তাহলে তার জন্য দায়ী থাকবেন নাট্যকার। তিনি স্বসৃষ্ট চরিত্রের প্রতিকৃতি নির্মাণ করতে পারেন, কিন্তু ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে পাওয়া চরিত্রকে পালটে দিতে পারেন না।


তৃতীয়ত ইতিহাস থেকে নাটক বা উপন্যালের তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে তার প্রকৃতি কী রকম হবে, অর্থাৎ ইতিহাস ও কাব্যের পারস্পরিক সম্পর্ক কী, সে বিষয়ে অ্যারিস্টটল সংক্ষেপে তাঁর poetics গ্রন্থে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছেন। তাতে মনে রাখবার মতো কথা হল—যা ঘটে তার বর্ণনা দেওয়া নাট্যকার বা ঔপন্যাসিকের কাজ নয়, সেটা করে ইতিহাস— সাহিত্যিক সৃষ্টি করেন সম্ভাব্যতার সূত্রে মেনে যা ঘটতে পারে তাই। সুতরাং ইতিহাস ব্যক্তিগত মানুষের বিশেষ কালের কাহিনি, সাহিত্য সাধারণভাবেই মানুষের সর্বকালের কাহিনি । সেইজন্যই ইতিহাস অপেক্ষা সাহিত্য অনেক উচ্চস্তরের।


সম্ভবত এই মহত্বের ধারণা মনে রেখেই ঐতিহাসিক নাটকে ঐতিহাসিক চরিত্র অবলম্বন করে কোনো কোনো নাট্যকার কোনো না কোনো মহৎ ভাব প্রচার করতে চান। অবশ্য কখনো কখনো সে চরিত্র ঐতিহাসিক চরিত্রও না হতে পারে যেমন—'মেবার পতন' নাটকে দ্বিজেন্দ্রলাল ব্যক্তিপ্রেম, স্বদেশপ্রেম এবং বিশ্বপ্রেম পরিস্ফুট করবার জন্য যথাক্রমে বেছে নিয়েছিলেন— কল্যাণী, সত্যবতী এবং মানসী তিন নারী চরিত্রকে। সম্ভবত যারা প্রত্যেকেই অনৈতিহাসিক। এদের মধ্যে আবার জয়যুক্ত হয়েছিলেন মানসী তাঁর বিশ্বপ্রেমের বাণী নিয়ে। কিন্তু ঐতিহাসিক ধারণা থেকে বিশেষ বিচ্যুত না হওয়ায় অনেকেই ‘মেবার পতন'-কে সার্থক ঐতিহাসিক নাটকরূপে চিহ্নিত করেছেন। তবে মূলগতভাবে এই বিষয়টি ঐতিহাসিক নাট্য ধারণার বিরোধী। কারণ, কিছু অনৈতিহাসিক চরিত্র সৃষ্টি করে লেখকের আত্মসত্তুষ্টি ঘটতে পারে, কিন্তু দর্শক মনে ক্রমেই এ ধারণা সঞ্চারিত হলে এ নাটকের শিল্পমূল্য কমে যায়। যাইহোক ঐতিহাসিক নাটক রচনায় যে সমস্ত নাট্যকার কৃতিত্ব রেখেছেন তাদের মধ্যে নাম করতে হয় গিরিশ ঘোষ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, মধুসূদন দত্ত প্রমুখ ব্যক্তিগণের।


একটি ঐতিহাসিক নাটক :

প্রসঙ্গক্রমে মধুসূদন দত্তের 'কৃষ্ণকুমারী' নাটকখানি বেছে নেওয়া যেতে পারে। কারণ ভারতীয় পুরাণ অবলম্বনে শর্মিষ্ঠা এবং গ্রিক পুরাণ অবলম্বনে ‘পদ্মাবতী' নাটক তিনি রচনা করলেও ইতিহাসের কাহিনি আশ্রয় করে তাঁর প্রথম এবং শেষ সম্পূর্ণ নাটক ‘কৃষ্ণকুমারী’ একটি সার্থক ঐতিহাসিক নাটক। এই সার্থকতার পশ্চাতে যেসকল কারণগুলি বিদ্যমান তা এমনভাবে নিরূপিত করা যায়—


প্রথমত কৃষ্ণকুমারী নাটক একটি পূর্ণাঙ্গ নাটক, অর্থাৎ পঞ্চমাঙ্ক সমন্বিত নাটক। এই নাটকের মূল বিষয় সংগ্রহ করা হয়েছে টডের রাজস্থান বিষয়ক গ্রন্থ থেকে, মূল চরিত্র জগৎ সিংহ, ভীম সিংহ, কৃষ্ণকুমারী প্রভৃতি ইতিহাস থেকেই সংগৃহীত। নাটকের প্রাণশক্তি যে দ্বন্দ্বময়তা এখানে তাও বিচিত্ররূপে প্রকাশিত। উদয়পুরের রাজা ভীম সিংহের কন্যা কৃষ্ণকুমারীর পানি গ্রহণের আশায় জয়পুরের রাজা জগৎ সিংহ এবং মরুদেশের রাজা মানসিংহের মধ্যে সংগ্রামের সম্ভাবনা এবং পরিণতিতে কৃষ্ণকুমারীর করুণ আত্মহনন এই নাটকের উপজীব্য। সুতরাং নাটকের প্রার্থিত দ্বন্দ্ব এখানে আগাগোড়াই রক্ষিত হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, নাটকে ইতিহাসের তথ্য নিষ্ঠা যেটুকু রক্ষিত হওয়া প্রয়োজন তা এখানে রক্ষিত হয়েছে। জয়পুরের রাজার চরিত্র দোষ এবং লাম্পট বৃত্তির সমর্থন ইতিহাস থেকে পাওয়া যায়, কৃষ্ণকুমারীর করুণ অপমৃত্যুও ইতিহাস-সত্য । নাটকটির মধ্যে কিছু ছোটোখাটো বিচ্যুতি আছে, যেমন—ভীম সিংহের চরিত্র পরিকল্পনায়। তবে নাট্যকার যেহেতু ঐতিহাসিক নন, তাই অভিযোগ করা যায় না। মোটামুটি ঐতিহাসিক ধারণাটি মধুসূদন বজায় রাখতে পেরেছেন বলেই মনে হয়।


তৃতীয়ত, ইতিহাস ও কাব্যের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতে গিয়ে যে সম্ভাব্যতা ও সার্বজনীনতার কথা অ্যারিস্টটল বলেছেন, সে সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে গেলে মধুসূদনকেই প্রশংসা করতে হয়। ইতিহাসের যে তথ্য তিনি সংগ্রহ করেছেন তাতে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব নিশ্চয় ছিল। ধনদাসের ধনস্পৃহা এবং মদনিকার প্রতিশোধ স্পৃহার অবতারণা করে নাটকের সম্ভাব্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা তিনি অনেক বৃদ্ধি করতে পেরেছেন। সেইসঙ্গে একথাও বলা চলে যে, একটি বিশেষ কাহিনিকে কিছুটা শাশ্বত সত্যের মর্যাদা তিনি দিতে পেরেছেন এই কারণে যে, রাজপুত জাতির আত্মক্ষয়ী অস্তদ্বন্দ্ব এবং রাজপুত রমণীর আত্মত্যাগের প্রায় সাধারণ একটি সত্য এখানে উপস্থাপিত হয়েছে।


যেটুকু সমালোচনার অবকাশ এ নাটক রাখে তা অনৈতিহাসিক চরিত্র পরিকল্পনায়। তবে, ঐতিহাসিক নাটকে কল্পিত চরিত্র নিশ্চয়ই আসতে পারে। নাট্যকার তাদের সৃষ্টি করেন ইতিহাসের ঘটনাগত অসংগতি দূর করবার জন্য বা ঘটনার বিশ্বাসযোগ্যতা সৃষ্টি করবার জন্য। এখানেও তার প্রয়োজন ছিল। মান সিংহ ও জগৎ সিংহের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ইতিহাস সমর্থন করলেও তাদের শত্রুতার কোনো ইঙ্গিত ইতিহাস দেন না। মধুসূদন ধনদাস ও মদনিকা নামে দুটি কাল্পনিক চরিত্র সৃষ্টি করেছেন এই দ্বন্দ্ব ঘনীভূত করবার জন্য। কৃষ্ণকুমারী সম্পর্কে প্রায় কিছুই যিনি জানাতেন না, সেই জগৎ সিংহকে তার পাণিপ্রার্থী করে তুলবার কৃতিত্ব যেমন ধনদাসের তেমনি আর এক রাজপুত রাজা মান সিংহকে সুকৌশলে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সে টেনে এনেছে। একদিকে নাটকের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তারা পালন করেছে, অন্যদিকে লঘু কৌতুক রস পরিবেশন করায় চরিত্র হিসাবেও দর্শকদের কাছে তারা অত্যন্ত আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছেন। সুতরাং সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত না হলেও সমালোচক কথিত ‘কৃষ্ণকুমারী’ যেমন বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ট্র্যাজেডি তেমনি এ নাটককে উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক নাটকের শিরোপা দিতেও কোনো সংশয় থাকে না।