'বোধন' কবিতা অবলম্বনে সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবি মানসের পরিচয় | ‘বোধন’ কবিতায় আকাশ, দিগন্ত এবং স্বপ্নে সুবজ মাটিতে মৃত্যুর ঘাঁটি গাড়ার চলচ্চিত্র এই কবিতায় ফুটে উঠেছে তা ব্যাখ্যা করো।

'বোধন' কবিতা অবলম্বনে সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবি মানসের পরিচয়


বাংলার মন্বন্তর দেখা দিল ১৯৪৩ সালে, কী কারণে এবং কীভাবে এই মন্বন্তর সম্ভাবিত হল তা ইতিহাস প্রমাণ দেবে। তবে বিশেষত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ধান-চাল-গমের মূল্য বৃদ্ধি বোধ না করা, অবাদ বাণিজ্যের সুযোগ দান, জাপানী আক্রমণ প্রতিরোধে সড়ক ও পরিবহন ব্যবস্থা নষ্ট করা, কালো বাজারি বন্ধ না করা, গ্রামীণ কৃষকদের প্রয়োজনের দিকে দৃষ্টি না দেওয়া রাষ্ট্রীয় শাপকদের প্রভৃতি কারণে সংঘটিত হয়েছিল বাংলার ৪৩এর মন্বন্তর। এই সময় বাংলার শিল্পীর সাহিত্যিকদের মধ্যে যে গণচেতনার সঞ্চার ঘটেছিল এবং দেশের পরিস্থিতি অনুসারে শিল্প সাহিত্যে নতুন ভাবনাকে পরিস্ফুট করবার সে চেতনা করেছিল তার পরিচয় সর্বাঙ্গ বিদ্যমান। বিশেষ করে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা গ্রাম থেকে চলে আসা নিরন্ন মানুষকে সহায়তা দেবার যে চেষ্টা করেছিলেন তার ইতিহাস সর্বজনবিদিত।


এমনই লগ্নে কিশোর কবি সুকান্তের আবির্ভাব, তাঁর পারিবারিক পরিবেশ বিশেষ অনুকূল ছিল না। অভাব ছিল, সেই সঙ্গে ছিল কমিউনিষ্ট পার্টিতে যোনা দেবার কারণে অভিভাবকদের কিছুটা বিমুখতা। কিন্তু হৃদয় ও মসনের সামিলিত নির্দেশ উপেক্ষা করে কেবল নিজের স্বার্থের কথা যাঁরা ভাবেন তাঁরা সুকান্ত ভট্টাচার্য হতে পারেন না। একদিকে তাঁর কর্মজগতে দিন অতিবাহিত হয়ে যেত নিরাশ্রয় ও অন্নহীন মানুষকে খাদ্য ও বাসস্থান ভাবে পূর্ণ হয়ে উঠল দুর্ভিক্ষের প্রতিক্রিয়ায় রচিত কবিতায়। “আমার সোনার দেশে অবশেষে মন্বন্তর নামে” তিনি লিখলেন ‘বিকৃতি' (ছাড়পত্র) কবিতায়। সুকান্তর সর্বাদিক পরিচিত কবিতাগুলির একটি হল 'বোধন' এই দুর্ভিক্ষের পরিপ্রেক্ষিতে রচিত।



‘বোধন’ কবিতায় আকাশ, দিগন্ত এবং স্বপ্নে সুবজ মাটিতে মৃত্যুর ঘাঁটি গাড়ার চলচ্চিত্র এই কবিতায় ফুটে উঠেছে তা ব্যাখ্যা করো।

“কোথাও নেইকো পার

মারী ও মড়ক মন্বন্তর, ঘন ঘন বন্যার 

আগাতে আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন ভাড়া নৌকার পাল,

এখানে চরম দুঃখ কেটেছে সর্বনাশের খাল, 

ভাঙা ঘর, ফাঁকা ভিটেতে জমে নির্জনতার কালো।”


এ জাতীয় অনেক পক্তি পাওয়া যাবে এ কবিতায়। কিন্তু প্রগতি ভাবক্ষয় ঋদ্ধ প্রকৃত শিল্পীর মতোই সুকান্ত ভট্টাচার্য সর্বত্রই বিপর্যয় উত্তীর্ণ হয়ে স্থিতি ফিরে পাবার প্রত্যয়কে কবিতায় ঘোষণা করা হয়। উদ্ধৃত জেহাদ' লেখা হয়—

“বিপন্ন পৃথ্বীর আজ শুনি শেষ মুহুর্মুহু ডাক

আমাদের দৃপ্ত মুঠি আজ তার উত্তর পাঠক।

ফিরুক দুয়ার থেকে সন্ধানী মৃত্যুর পরোয়ানা, 

ব্যর্থ হোক কুচক্রান্ত, অবিরাম বিপক্ষের জানা।”


দুর্ভিক্ষ সংক্রান্ত কবিতাগুলি এতই আন্তরিক উপলব্ধিতে আকীর্ণ ছিল যে বহু বছর পরেও, দুর্ভিক্ষের সেই প্রত্যক্ষ স্যারের কাল থেকে অনেক দূরে সরে এসেও এই কবিতাগুলি আমাদের মনকে আলোড়িত করে। প্রতিটি কবিতাতেই অবশ্য কবি প্রায় একই পরিকল্পনা অনুসরণ করেছেন—প্রথমে মন্বস্তরের নিষ্করুণ চিত্র, তার পর প্রতিবাদের প্রদীপ্ত ঘোষণা। ফিসলের ডাক : ১৩৫১, কবিতায় তিনি স্বীকার করেছেন যে—'পরাস্ত অনেক চাষি ; ক্ষিপ্র গতি নিঃশ্বদ মরণ। পরবর্তী স্তরে তাঁর সংকল্প—'আমাকেই কাস্তে নিতে হবে, তার পর কবিতায় ঝলসে ভরে করিক প্রত্যয়—

“আমার পুরনো কাস্তে পুড়ে গেছে ক্ষুধার আগুনে

তাই দাও দীপ্ত কাস্তে চৈতন্য প্রখর-

যে কাস্তে ঝলসাবে নিত্য উগ্র দেশপ্রেমে,

যে কাস্তে শত্রুর কাছে দেখা দেবে অত্যন্ত ধারালো।”


কিন্তু বলবার কথাটি এক হলেও কবির বলবার ভঙ্গি তথা কবিতার ভাষায় এমন এক পরিণতি ওই অল্প বয়সেই অর্জিত হয়েছিল যে বাচনের ভাববস্তু এক হলেও বাক্শৈলীর বৈচিত্র্যে সেই আনির্বচনীয় ব্যঞ্জনাই ধ্বনিত হয় যা কবির কথাকে উত্তীর্ণ করে চিরায়ত কাব্যে, তাই ‘বোধন’ কবিতার বহু, পঙক্তি পরবর্তীকালে পরিণত হয়েছে প্রায় প্রবাদ বাক্যে—

১. প্রিয়াকে আমার কেড়েছিস তোরা ভেঙেছিস ঘরবাড়ি

যে কথা কি আমি জীবনে মরণে কখনো ভুলতে পারি?

২. আদিম হিংস্র মানবিকতার যদি আমি কেউ হই

স্বজন হারানো শ্মশানে তোদের চিতা আমি তুলবই।

৩. শোনরে মজুতদার

ফসল ফলানো মাটিতে রোপন করব তোকে এবার।

তারপর বহু যুগ পরে

ভবিষ্যতের কোন যাদুকরে

নৃতত্ত্ববিদ্ হয়রান হয়ে মুছবে কপাল তার

মজুতদার ও মানুষের হাড়ে মিল খুঁজে পাওয়া ভার।”


অবশ্য বলতে হয়, মন্বন্তরের কালে বাংলার প্রগতি শিবিরের লেখক শিল্পীর দুর্ভিক্ষ–সংক্রান্ত কবিতায় একটি সংকলন প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন সুকান্ত ভট্টাচার্য ছিলেন সংকলনটির সম্পাদনার দায়িত্বে। ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত 'আকাল' নামের এই সংকলেন ‘কথামুখ’ লিখেছিলেন সুকান্ত। সেই গদ্য পক্তিগুলি কোনো প্রথা সিদ্ধ ভূমিকা নয়—কবির হৃদয়ের সহমর্মিতা উজাড় করে দেওয়া একটি গদ্য কবিতাই যেন—“তেরশো পঞ্চাশ সম্বন্ধে কোনও বাঙালিকে কিছু বলতে যাওয়া অপচেষ্টা ছাড়া আর কি হতে পারে ? কেননা তেরশো পঞ্চাশ কেবল ইতিহাসের একটা সচল নয়, নিজেই একটা স্বতন্ত্র ইতিহাস। একটা দেশ শ্মশান হয়ে যাওয়ার ইতিহাস, ঘড় ভাঙা গ্রাম ছাড়ার ইতিহাস, দোরে দোরে কান্না আর পথে পথে মৃত্যুর ইতিহাস, আমাদের অক্ষমতার ইতিহাস। এই বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য কোষ ধারার কবি, তাঁর কবিমানস কোনও ভাবে সঞ্জীবিত।