'বৈষ্ণব পদাবলীর রসভিত্তি বৈষ্ণবীয় পঞ্চরস' -সবিস্তারে আলোচনা করো।

বৈষ্ণব পদাবলীকে বিভিন্ন রস পর্যায়ে বিভক্ত করার সার্থকতা কী? আধ্যাত্মিক তাৎপর্য ও কাব্যগত উভয় দিক দিয়ে উদ্ধৃতি-সহ আলোচনা করো।

বৈষ্ণব আলঙ্কারিকদের মতে রস কয় প্রকার? প্রত্যেকটি রসের সামান্য আলোচনা করে তোমাদের পাঠ্য পদগুলি থেকে সেগুলির উদাহরণ দাও।


বৈষ্ণব সাহিত্যে ব্যবহৃত পঞ্চরসের পরিচয়


সমগ্র মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের যাবতীয় সৃষ্টির মধ্যে জনপ্রিয়তায় ও কাব্যমূল্য বিচারে বৈষ্ণবপদগুলিই যে সর্বোৎকৃষ্ট বিবেচিত হয়ে থাকে, এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। বৈষ্ণবপদের উদার মানবিকতাবোধ, মানব-মনের শাশ্বত আকৃতির সার্থক রূপায়ণ এবং ব্যক্তি প্রাণের স্পর্শে উজ্জীবিত এর গীতিধর্মিতাই বস্তুত বৈষ্ণব পদাবলীতে একটা সর্বজনীন আবেদন সৃষ্টি করে। সাধারণ পাঠকের দৃষ্টিতে পদাবলী সাহিত্য এইভাবে বিচারিত হলেও এগুলি মূলত গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ধর্ম ভাবনা থেকেই উদ্ভূত হয়েছে। চৈতন্যদেব রাধাকৃষ্ণের উপাসনার মধ্য দিয়ে যে বিশেষ ধর্মীয় দর্শন ও তথ্যের জন্মদান করেছেন, তারই অনিবার্য ফলস্বরূপ উদ্ভব ঘটেছে অসংখ্য বৈষ্ণব পদের। অবশ্য চৈতন্যদেবের বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি প্রসূত দর্শন ও তত্ত্ব প্রচারের বহু পূর্ব থেকেই বাংলায় রাধাকৃষ্ণের প্রেম অবলম্বনে বহু পদ রচিত হয়ে আসছিল, কিন্তু বিষয়বস্তুর বিচারে এগুলিও চৈতন্যোত্তর পদগুলি থেকে অভিন্ন হওয়াতে রসভোক্তারা উভয় জাতীয় পদ থেকেই সমান রস আহরণ করে থাকেন। তাই বৈষ্ণব পদাবলীর বিচারে সাধারণভাবে চৈতন্য পূর্ব এবং পদগুলিকে একসঙ্গে যোগ করায় রসাভাসের কোনো কারণ ঘটে না।


গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন-সম্মত রসশাস্ত্রে বৈষ্ণবীয় পঞ্চরসকেই শুধু স্বীকৃতি দান করা হয়েছে, যদিও সাহিত্যে-দর্শনে রসের ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীবিভাগ কল্পিত হয়েছে। বৈষ্ণবীয় পঞ্চরস বলতে বোঝায়–শাস্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য' এবং 'উজ্জ্বল’ বা ‘মধুর রস'। বৃন্দাবনের যড় গোস্বামীর অন্যতম রূপ গোস্বামী অবশ্য এই পাঁচটি রসকে স্বীকৃতি দিলেও মনে করেন যে স্বরূপ রস আসলে একটাই, এবং সেটা হল 'ভক্তিরস'। শ্রবণ কীর্তনাদির সাহায্যে ভক্তদের হৃদয়ে বিভাব অনুভাবাদি দ্বারা আস্বাদ্যতা আনীত হলে মনে জাগে ‘কৃষ্ণরতি' এবং এর স্থায়ীভাব হল 'ভক্তিরস'। পুর্ব কথিত পঞ্চরসের কোনো রস-সিক্ত বৈষ্ণবপদ যদি শ্রবণ কীর্তনাদির সহায়তায় বিভাবাদি ভাবের দ্বারা ভক্ত-হৃদয়ে কৃষ্ণপ্রেমের উদ্বোধন ঘটিয়ে দিতে পারে, তবেই আমরা স্বীকার করে নিতে পারি যে বৈষ্ণব পদাবলীর রসভিত্তি বৈষ্ণবীয় পঞ্চরস।


বৃন্দাবনের ষড় গোস্বামীদের অন্যতম রূপ গোস্বামী ছিলেন চৈতন্য মহাপ্রভু দ্বারা উপদিষ্ট। তার রচিত ‘উজ্জ্বলনীলমণি' গ্রন্থটিই গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের নিকট রসশাস্ত্র-বিষয়ক আকর গ্রন্থ-রূপে বিবেচিত হয়। তিনি পঞ্চরসের শুধু নাম উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হন নি, এর নানাপ্রকার সুক্ষ্মাবিভাগাদিও কল্পনা করেছেন। বৈষ্ণবপদকর্তারা সেই নির্দেশ শিরোধার্য করেই বৈষ্ণবপদ রচনা করেছিলেন। তিনি পঞ্চরসের মধ্যে মধুর/উজ্জ্বল রসকেই প্রাধান্য দিয়ে তার দুটি শ্রেণী ভাগ করেছেন বিপ্রলম্ভ ও সম্ভোগ। এরপর বিপ্রলস্তের আবার চতুর্থ বিভাগ কল্পনা করেছেন : পূর্বরাগ, মান, প্রেমবৈচিত্র্য ও প্রবাস সম্ভোগের দুটি ভাগ মুখ্য সম্ভোগ ও গৌণ সম্ভোগ বা স্বপ্নসম্ভোগ।


আবার বৈষ্ণব রসশাস্ত্র 'উজ্জ্বলনীলমণি' গ্রন্থে নায়িকার মনোভাব এবং আচরণ অবলম্বনে। অষ্টবিধ অবস্থা–অভিসারিকা, বাসকসঞ্জিকা, খণ্ডিতা, বিপ্রলব্ধা প্রভৃতি বর্ণিত হয়েছে। বৈষ্ণব কবিগণ এই সমস্ত বিষয়কেও তাদের পদের অঙ্গীভূত করেছেন। এতদতিরিক্ত চৈতন্য-জীবনের বাল্যজীবনের কিছু বিষয় এবং সম্ভবত তারই স্মরণে শ্রীকৃষ্ণের বাল্য ও কৈশোরের কিছু বিষয় অবলম্বন করেও তারা অনেক পদ রচনা করেছেন। এই পদগুলিতে শ্রীকৃষ্ণের নিত্যপ্রিয়া শ্ৰীমতী রাধিকা অনুপস্থিত বলে এতে মধুর রসের অভাব রয়েছে বটে কিন্তু পঞ্চরসের ব্যত্যয় হয়নি, কারণ তদুক্ত বাৎসল্য এবং সখ্যরসের পরিচয় শুধু এই পদগুলিতেই বর্তমান, অতএব তাত্ত্বিক বিচারে দেখা যায় যে, বৈষ্ণবপদগুলি যে প্রকৃতই বৈষ্ণব তত্ত্বের রসভাষ্য এ কথা অস্বীকার করবার উপায় নেই।


বৈষ্ণব পদাবলীর রসভিত্তি যে বৈষ্ণবীয় পঞ্চরস বাস্তবে এটা প্রযোজ্য কিনা, বিষয়টি এখন বিচার করে দেখা যেতে পারে। বৈষ্ণব রসতত্ত্বে পঞ্চরস হল— শাস্ত, দাস্য, বাৎসল্য, সখ্য ও মধুর।


শান্তরস: গৌড়ীয় বৈষ্ণবতত্ত্ব মতে শাস্তরসের উপাসনা সম্ভবপর নয়। উপাস্যকে ঈশ্বরজ্ঞানে ৎ-চরণে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে যে শাস্তরসের প্রকাশ সম্ভব, গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম মতে তা স্তব নয়, কারণ তাদের মোক্ষও কামনার বস্তু নয়–‘মোক্ষবাঞ্ছা কৈতব প্রধান। তবে বিদ্যাপতির - ত্মসমর্পণের পদগুলিতে (তাতল সৈকতে বারিবিন্দুসম' এবং 'মাধব, বহুত মিনতি করি তোয়') ।ই শাস্তরস উপস্থিত। বিদ্যাপতি চৈতনা-পূর্ব যুগের কবি এবং গৌড়ীয় তত্ত্ব দ্বারা শাসিত নন লেই এটা সম্ভব হয়েছে।


দাস্যরস: গৌড়ীয় বৈষ্ণবতত্ত্বমতে দাস্যভাবের উপাসনাও সম্ভবপর নয়। উপাস্যকে ঈশ্বর ওথা প্রভুরূপে গ্রহণ করার মধ্য দিয়েই দাসমনোভাবের প্রকাশ সম্ভবপর, কিন্তু গৌড়ীয় ভক্তগণ শ্রীকৃষ্ণের ঐশ্বর্যরূপের উপাসনায় কখনো আগ্রহ বোধ করেননি, তারা গোপীজনবল্লড রূপেই রাবর তাকে দেখেছেন এবং লীলাগুক-রূপে রাধাকৃষ্ণের লীলায় অংশগ্রহণ করেছেন। কাজেই স্যভাবের পদও বৈষ্ণব পদাবলীতে সহজপ্রাপ্য নয়। তবে চৈতন্য সমসাময়িক কবি নরোত্তমের এঁদে (‘সেবা দিয়া কর অনুচর) এবং বিদ্যাপতির আত্মসমর্পণের পদেও এই দাস্যরসের পরিচয় পাওয়া যায়। নরোত্তমও সম্ভবত গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন প্রচারিত হবার পুর্বেই পদটি রচনা করেছিলেন।


বাৎসল্যরস: শ্রীকৃষ্ণের বাল্যজীবনের লীলা-অবলম্বনে রচিত পদগুলি বাৎসল্যরসে একেবারে ই-টুম্বুর। চৈতন্য-পূর্ব যুগের কবিরা এ জাতীয় কোনো পদই রচনা করেননি, এমনকি চৈতন্য সমকালীন প্রধান কবিরাও এ বিষয়ে খুব উৎসাহ প্রকাশ করেননি। মাতা যশোদার সঙ্গে বালক শ্রীকৃষ্ণের সম্পর্কের মধ্য দিয়েই এই বাৎসল্যরসের প্রকাশ ঘটেছে।


পুত্র কৃষ্ণের প্রতি মাতা যশোদার বাৎসল্য প্রকাশের মধ্য দিয়া যে বিচিত্র উপাসনা রীতি প্রকাশিত হয়েছে, সমগ্র বিশ্বের অপর কোনো ধর্মমতে সম্ভবত এর কোনো দ্বিতীয় নেই। রূপ গোস্বামীর মতে এই বাৎসল্যরসও ভক্তিরস চৈতন্যসমকালীন তার পার্ষদ ও ভক্তগণ সম্ভবত গৌরাঙ্গদেবের বাল্যলীলা-দর্শনে উদ্দীপিত হয়েই শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলার পদ রচনায় আগ্রহী হয়েছিলেন এবং এবিষয়ে বলরাম, যাদবেন্দ্র, বাসুদেব, বলরাম প্রমুখ কবিরা বাৎসল্যরসের অপুর্ব নদর্শন-রাপে বেশ কয়েকটি পদ রচনা করেন। এগুলিতে ঐশ্বর্য রস নেই, মধুর রসও অনুপস্থিত, বাঙালির আটপৌরে গার্হস্থ্যজীবনের অনুপম রসাস্বাদে পদগুলি পরম রমণীয়তা লাভ করেছে। বৈষ্ণবরসও শাস্ত্র স্বীকৃত বাৎসল্যরসের শ্রেষ্ঠ নিদর্শনরূপে গৃহীত এই পদগুলির সঙ্গে তুলনীয় কোনো রচনার সন্ধান বিশ্বসাহিত্যের আর কোথাও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।


সখ্যরস: বৈষ্ণব পদাবলীর ‘গোষ্ঠলীলা’র পদগুলিতে বিশেষভাবে সখ্যরসের প্রবাহ বয়ে গেছে। শ্রীকৃষ্ণ কৈশোরে তাঁর সঙ্গীদের সঙ্গে গোচারণে কিংবা গৃহ-প্রাঙ্গণে খেলাধূলায় মত্ত থাকতেন, তখন তাদের আচার-আচরণে এবং পারস্পরিক সম্পর্কে যে সৌহার্দ্যের ভাবটি প্রকাশ পেতো, সেটিই সখ্যরস। এখানেও শ্রীকৃষ্ণের ঐশ্বর্যভাব অনুপস্থিত। বন্ধুরা তাকে সমদৃষ্টিতেই দেখতেন। অপেক্ষাকৃত পরবর্তী কালে অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের প্রথম যৌবনে তার জীবনে যখন শ্রীমতীর আবির্ভাব ঘটল, তখন থেকে সখাদের ভূমিকা গৌণ হয়ে যেতে থাকে এবং সখীরা তস্থলবর্তিনী হয়ে দাঁড়ান। রাধাকৃষ্ণ লীলায় এই সখীদেরও একটা প্রধান ভূমিকা রয়েছে, যদিও তারা এই লীলায় অংশগ্রহণ করেননি। বৈষ্ণব কবিরাও সখীদের মতোই মঞ্জরী ভাবের উপাসনায়ই রত ছিলেন। রূপ গোস্বামী সখ্যরসকেও ভক্তিরসের মর্যাদা দিয়েছেন এবং তাকে পঞ্চরসের অন্তর্ভুক্ত বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। বাল্যলীলার পদ রচয়িতাদের অনেকেই গোষ্ঠলীলার পদেও অনুপম কৃতিত্বে পরিচয় দিয়েছেন।


মধুর রস: সর্বরসের সারাৎসার মধুর রসের মধুভাশু এই বৈষ্ণব পদাবলী। পদাবলীর মধু রসাত্মক পদগুলিই বিশ্বমানবের মনে বিশেষ রসাবেদন সৃষ্টি করতে পেরেছে। রসশাস্ত্রোক্ত মধু রসে যে দুটি শ্রেণী কল্পিত হয়েছে, তাদের 'বিপ্রলন্ত' শাখায় 'পূর্বরাগ, মান, প্রেমবৈচিত্র্য ও প্রবাস নামে যে চারটি পর্যায় রয়েছে এবং নায়িকার অবস্থা ভেদে 'অভিসারিকা, বাসকসজ্জিকা, খণ্ডিতা আদি যে সকল অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে, প্রচলিত বৈষ্ণব পদাবলীর পদগুলিতে এ সব অবস্থার সার্থকতম প্রয়োগ দেখা যায়। সাধারণত পদকর্তাগণ পদরচনায় 'পূর্বরাগ, অভিসার, মান প্রেমবৈচিত্র / আক্ষেপানুরাগ, রূপানুরাগ, মাথুর / বিরহ প্রভৃতি বিষয় অবলম্বন করে থাকেন এ ছাড়া মধুর রসের ‘সস্তোগ' নামে যে দ্বিতীয় শ্রেণী কল্পিত হয়েছে, এ জাতীয় পদও আছে যথেষ্ট। বৈষ্ণব পদাবলীর ‘দানখণ্ড, ভারখণ্ড, রাসলীলা' প্রভৃতি পদে 'মুখ্য সম্ভোগ এবং ভাবজগতে মিলন কল্পনায় ‘ভাবসম্মেলনে'র পদে গৌণ সম্ভোগের উৎকৃষ্ট পরিচয় বর্তমান রয়েছে। সমগ্র বৈষ্ণবপদাবলী সাহিত্যে সংখ্যায় এবং উৎকর্ষে মধুর রসের পদগুলিরই শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত।


বিভিন্ন শ্রেণীভুক্ত বৈষ্ণব পদাবলীর পদগুলির পরিচয় বিশ্লেষণ করেও দেখা গেল যে, প্রতিটি পদই রসশাস্ত্রোক্ত বৈষ্ণবীয় পঞ্চরসের কোনো-না-কোনো একটির অন্তর্ভুক্ত। অতএব ‘বৈষ্ণব পদাবলীর রসভিত্তি বৈষ্ণবীয় পঞ্চরস' উক্তিটি সর্বথা সমর্থনযোগ্য। অথবা যদি ঘুরিয়ে বলা হয়। যে বৈষ্ণব পদাবলী বৈষ্ণবতত্ত্বের রসভাষ্য'—তাহলেও অনুরূপভাবে তা' সার্থক উক্তি বলেই প্রতিপন্ন হয়।