বাংলা সাহিত্যে প্রবন্ধকার বঙ্কিমচন্দ্রের অবদান | বাংলা সাহিত্যে প্রবন্ধকার বঙ্কিমচন্দ্রের কৃতিত্ব

বাংলা সাহিত্যে প্রবন্ধকার বঙ্কিমচন্দ্রের ভূমিকা


প্রবন্ধ সাহিত্য বলতে মনন সমৃদ্ধ একটি বিশেষ রচনার প্রকৃষ্ট অনুশীলিত রূপায়ণ বুঝি। এটি একটি গদ্য শিল্প কিন্তু রচনা রীতি। বক্তব্য বিষয় ও ভঙ্গী অন্যান্য গদ্যরচনা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বঙ্কিমচন্দ্র রসসাহিত্যের সম্রাট হিসাবে বাংলা সারস্বত ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ করলেও প্রবন্ধ সাহিত্যে তিনি নিঃসন্দেহে একটি অবিসংবাদিত সম্রাট। এর অনুপম রূপবৈচিত্র্যের চারুশিল্পে ও সীমাহীন ভাব সত্তার স্রষ্ঠা বঙ্কিমচন্দ্র। যে প্রবন্ধ এতদিন রামমোহন থেকে অক্ষয়কুমার দত্ত পর্যন্ত নাকি সূক্ষ্ম রুক্ষ্ম চিন্তা মননের বাহন ছিল যা কতকগুলি জ্ঞান বিজ্ঞান তথ্য ও তত্ত্বের ভারে ক্লিষ্ট ছিল, যা গতি মন্থরে শিথিল ছিল তা বঙ্কিমচন্দ্রের নবীন প্রতিভার স্পর্শে ছন্দ স্পন্দনে জীবন তরঙ্গের অভিঘাতে এক আশ্চর্য লাবণ্য প্রবাহে সৃষ্টি করল। অশনিতুল্য তীক্ষ্ম দীপ্তি ও দ্রুত গতি প্রাণশক্তি দুর্বার উল্লাসে প্রবন্ধের বস্তুভার হঠাৎ যেন লঘু হয়ে বঙ্কিম ভারের ছোঁয়ায় লীলা সঞ্চারণের শক্তি লাভ করল, কঠিন দৃঢ় চিন্তা শক্তির সঙ্গে প্রয়োজনবোধে শ্লেষ ব্যঙ্গের তীর্যক তীক্ষ্ণতা, পরিহাস, রসিকতার চমক, আবেগ, থর থর ভার মুগ্ধতা, গীতিকবিতার সুরবিলাস জীবন পর্যবেক্ষণের গভীর অন্তর্মুখীতা, অনুভূতি সর্বব্যাপী ভাবসঞ্চারণী শক্তি—সব মিলে বঙ্কিমের হাতে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের প্রবন্ধ যেন নবজন্ম লাভ করে এক লহমায় আধুনিক সাহিত্যের একটি শ্রেষ্ঠ শাখায় পরিণত হলো।


একথা আমাদের জানা আছে বঙ্কিম পূর্ব যুগে প্রায় সমস্ত প্রবন্ধ বিভিন্ন সাময়িক পত্রিকার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ যুগে মনীষীদের বিচিত্র ভাবনা ও সমাজ সংস্কার সাধনা প্রচারের জন্য পত্রিকার আশ্রয় নিয়ে প্রবন্ধের আবির্ভাব হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র এর অন্যথা নন। ১৮৭২ সাল বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় কাল। তিনি ওই সময়ে যদি বঙ্গ দর্শনের সম্পাদনা ভার গ্রহণ না করতেন তাহলে উপন্যাসের রসকলা থেকে বেরিয়ে এসে তাঁর বিপুল ও বহুমুখী মনীষা ও প্রতিভার স্বরূপ শক্তির পরিচয় দিতে পারতেন না। সাময়িক পত্রিকা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রকাশনার তাগিদ সম্পাদককে স্বাভাবিক ভাবে রচনা করতে বাধ্য করেন। সাময়িক পত্রিকার কলেবর পূরণের প্রয়োজনে তাকে বিচিত্র প্রবন্ধের আশ্রিত হতে হয়েছিল।


বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধের বৈশিষ্ট্য

বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধে নানা শ্রেণীর বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। প্রবন্ধ সাধারণত মন্ময় মূলক ও তন্ময় মূলক হয়ে থাকে। আবার মন্ময়মূলক রচনা ও নানা শ্রেণীর ও নানা ভাব অনুযায়ী বিশ্লেষিত হতে পারে। তেমনি তন্ময়মূলক রচনা ও নানা লক্ষণ আমাদের কাছে পরিস্ফুট হয়। তাঁর রচনা বিষয়বস্তু গৌরব ও রচনা রসসম্ভোগে পরিপূর্ণ। বস্তু প্রধান প্রবন্ধ রচনায় তিনি তার বলিষ্ঠ বাস্তব সচেতন জীবন্ত সত্তার পরিচয় দিয়েছেন। অপরদিকে ভাব প্রধান রচনাতেও তিনি সমান সিদ্ধহস্ত। বরং তুলনা, হীনভাবে স্বীকৃত, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব, বিজ্ঞান, জীবন দর্শন, শিক্ষা-সংস্কৃতি, সমালোচনা, কৌতুক হাস্যের স্নিগ্ধচ্ছটা, ব্যঙ্গের তীব্র কষাঘাত—এ সমস্ত বিষয় ও মানস রীতিকে অবলম্বন করে তিনি যে অজস্র রসের ধারা ভাব প্রকাশের যে অনবদ্ধ শিল্পরূপ সাধ বৈচিত্র্যের অপরূপ নৈপুণ্যের প্রতিষ্ঠা করলেন। তাতে বাংলা সাহিত্য ও বাংলার রুচিবোধ ও সমাজ চেতনা এক অভিনব পর্যায়ে উন্নীত হলো। কমলাকান্তের দপ্তর (১৮৭৫), বিজ্ঞান রহস্য (১৮৭৫) বিবিধ সমালোচনা (১৮৭৬), প্রবন্ধ পুস্তক (১৮৭৯), সাম্য (১৮৭৯), কৃষ্ণচরিত্র (১৮৮৬), ধর্মতত্ত্ব (১৮৮৮) পরিশেষে উল্লেখনীয় যে বিবিধ সমালোচনা ও প্রবন্ধ পুস্তক গ্রন্থ দুটি বিবিধ প্রবন্ধ ১ম ভাগ ও ২য় ভাগ নামে অধুনা আমাদের কাছে প্রকাশিত ও প্রচারিত। উপরের নমুনা থেকে আমরা তাঁর অসাধারণ চিন্তা অনুভূতিও ভাব গভীরতার পরিচয় পাই।


‘বিবিধ প্রবন্ধের অন্তর্গত তাঁর ইতিহাস সমাজ তত্ত্ব, শিল্প ও সাহিত্য বিষয়ক বিবিধ আলোচনা গভীরতা ও অনন্যতা আমরা অনুভব করি। বাঙালীর উৎপত্তি বাংলার ইতিহাসের ভগ্নাংশ, বাংলার কলঙ্ক, বাংলা শাসনের কাল, বঙ্গে ব্রাহ্ম, নারী অধিকার, বহু বিবাহ প্রভৃতি রচনার মধ্যে ইতিহাস ও সমাজতত্ত্বের এমন নিপূণ বিশ্বাসযোগ্য যুক্তি-যুক্ত আলোচনা ইতিপূর্বে আমরা ভাবতেই পারিনি। নিরপেক্ষ ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে তিনি তাঁর বক্তব্য পেশ করেছেন। স্বদেশ চেতনার অকারণ অন্ধতা তাঁর যুক্তির পথকে আড়াল করেনি। ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ প্রবন্ধ বাংলার সমাজজীবন কৃষিজীবন ও অর্থনৈতিক জীবনের এক অভিনব ‘দাস ক্যাপিটল'। সমগ্র বাঙালী সমাজের এমন বাস্তব সচেতন জীবনমুখী মানবদরদী পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ পূর্বে তো নয়ই পরে হয়েছে কিনা সন্দেহ।


শকুন্তলা মিরান্দাও দেসদিমনা, উত্তররামচরিত, গীতিকাব্য, বিদ্যাপতি ও জয়দেব, দ্রৌপদী প্রভৃতি রচনা এবং পরবর্তীকালে সঞ্জীবনী সুধা, ঈশ্বরগুপ্তের কবিতা সংগ্রহ, বাংলা সাহিত্যে প্যারীচাদ মিত্র, দীনবন্ধু মিত্রের জীবনী, সমালোচনা প্রভৃতি সাহিত্য বিষয়ক রচনা বাংলা সাহিত্যে অবিস্মরণীয়। আজ পর্যন্ত ঈশ্বরগুপ্ত ও দীনবন্ধু মিত্রের সাহিত্য সম্বন্ধে অন্য কোন লেখক বঙ্কিমচন্দ্রকে অতিক্রম করতে পারেননি বরং তাকেই পদে পদে অনুসরণ করেছেন। এই জাতীয় প্রবন্ধে তিনি আরও একটি অভিনব দৃষ্টিভঙ্গী আবিষ্কার করেছেন, তা হলো তুলনামূলক সাহিত্যে তুলনামূলক সাহিত্য সমালোচনা। প্রাচ্য, পাশ্চাত্য এবং ভারতীয় বাংলা আলোচনা করে আমাদের চিন্তা শক্তি, অনুভব শক্তি ও সমালোচনা শক্তির পরিধি অনেকখানি প্রসারিত করেছেন।


বাঙালীর বাহুবল, ভারত কলঙ্ক, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও পরাধীনতা প্রভৃতি প্রবন্ধ সাহিত্য একদিকে যেমন তাঁর অধ্যয়ন নিষ্ঠার পরিচয় দেয় অপরদিকে স্বদেশবোধ ও জাতীয় চেতনার এক নির্ভেজাল স্বীকৃতি।


আর্য জাতীর সূক্ষ্ম শিল্প তার শিল্পবোধ সম্পর্কে একটি পরিচয় বহন করে। জ্ঞান, শঙ্খ, দর্শন, ধর্ম ও সাহিত্য, চিত্ত শুদ্ধি, গৌরদাস বাবাজীর ভিক্ষার ঝুলি, কাম, কৃষ্ণচরিত্র, ধর্ম তত্ত্ব, শ্রীমত্তাভাবল্পীরতা প্রভৃতি রচনার মধ্যে ধর্ম দর্শন ও সক্ষম তত্ত্বের বিশ্লেষণ আছে। বিশেষ করে কৃষ্ণচরিত্র গ্রন্থখানি তাঁর জীবনের অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ বিশ্লেষণী গ্রন্থ। শ্রীকৃষ্ণকে এখানে তিনি সংস্কারের জাল ছিন্ন করে নব চেতনার আলোকে পুণ্য মনুষ্যত্বের পরিচয় বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। অবতার বাদ নয়, মানববাদই তাঁর মূল লক্ষ্য।


ত্রিদেব সম্বন্ধে বিজ্ঞান শাস্ত্র কি বলে, বিজ্ঞান রহস্য প্রভৃতি গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনায় বিজ্ঞান সম্বন্ধে তার আগ্রহ ও একনিষ্ঠ অনুশীলনের পরিচয় পাওয়া যায়।


এই জাতীয় প্রবন্ধের মধ্যে আমাদের মতে সাহিত্য সংক্রান্ত বিষয়ক প্রবন্ধতে সমালোচনা গুলি নিঃসন্দেহে কালের কষ্ঠিপাথকে শ্রেষ্ঠত্বের দাবী রাখে। যেহেতু বঙ্কিমচন্দ্র রস সাহিত্যে একজন শ্রেষ্ঠ শিল্পী সেই কারণে সাহিত্যে সম্বন্ধে তাঁর প্রজ্ঞা ও সজ্ঞান (intuition) রক্ত মজ্জায় প্রতিধ্বনিত হয়েছে, কোন চেষ্টা কৃত অনুশীলন নেই।


ডি কুইন্সের কনফেসন অপ অ্যান ইংলিশ অ্যান ইংলিশ অপিয়াস এটা’ (Confession of an Engish opious eta) গ্রন্থটির কথা আমাদের মনে হয় বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্রন্থটির প্রসঙ্গে, কিন্তু এই গ্রন্থটি ঐ ইংরেজ লেখককে প্রায় সর দিক দিয়ে অতিক্রম করেছে। বাংলা সাহিত্যে এমন অভিনব গ্রন্থ পূর্বে ও পরে লিখিত হয়নি। আমরা পূর্বে যে রচনা রস সম্ভোগের কথা উল্লেখ করেছি এই গ্রন্থটি তারই শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। ডঃ শশীভূষণ দাশগুপ্ত এটিকে রচনা সাহিত্যের এক অনন্য শিল্প প্রকরণ হিসাবে মন্তব্য করেছেন। এই গ্রন্থটির মধ্যে প্রবন্ধের সুদৃঢ় সুচিন্তিত বন্ধন উপন্যাসের মতো গতিশীল কাহিনীরস, ছোটগল্পের মতো সংহত শিল্প প্রকরণ ও লিরিক কবিতার মতো আবেগময় উচ্ছ্বাস এবং রম্য রচনার মতো আপস যেখানে রসের হাটে ভেসে যাওয়ার দুরস্ত আকাঙ্ক্ষা সমস্ত কিছুরই সন্নিবেশ হয়েছে।


পরিশেষে বলা যায়, বঙ্কিমচন্দ্রের হাকিমী খোলস থেকে বেরিয়ে আসা এমন জয়োল্লাস কোথাও দেখা যায় নি। রাজনীতি, সমাজনীতি, দর্শন, ধর্ম, স্বদেশপ্রেম, জাতীয়চেতনা সর্বোপরি মানবতাবাদ, হাল্কা রস রসিকতার মাধ্যমে কাব্য সুরধনীতে অমর গাঁথা রচনা করেছে। জীবন, জীবনাকাঙ্খা স্বদেশ ও স্বজাতির জন্যে এমন ক্রন্দন, এমন বাঁধন ছাড়া হাহাকার বাংলা সাহিত্যে আর একটিও নেই। সেদিক থেকে প্রবন্ধের ঢঙে এই রস রচনাটিও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে।