বাংলা সাহিত্যে প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান | বাংলা সাহিত্যে প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কৃতিত্ব

বাংলা সাহিত্যে প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকা


কাব্যে হৃদয়বৃত্তির স্থানমুখ্য। প্রবন্ধে চিদবৃত্তি। প্রথমটির পথ সংশ্লেষণের দ্বিতীয়টি বিশ্লেষণের। একটির লক্ষ্য কল্পনার রসায়নে সৌন্দর্য মাধুর্যের সৃষ্টি ছাড়া আনন্দলোক রচনা, অন্যটির উদ্দেশ্য তথ্য প্রয়োগে সত্য প্রতিষ্ঠা। চিন্তার প্রাখর্যে তথ্যের অন্বয়ে এবং তর্কের ক্রম সংবদ্ধতায় প্রবন্ধের সার্থকতা, কিন্তু আরো এক ধরনের প্রবন্ধ আছে, সেগুলি তথ্য-বিনির্ভর এবং যুক্তিরিক্ত, ব্যক্তিরস এবং ব্যক্তির স্বগত গুঞ্জরনই সেখানে মুখ্য, রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ রচনার জাতি আলাদা। তাঁর বিশাল ব্যক্তিত্ব মনীষা জীবনদর্শন সাহিত্যমেধা এ সমস্তের সঙ্গে কবি স্বভাবের সৃজনশীল চরিত্রধর্মের প্রকাশে ও বিকাশে প্রবন্ধ ও রচনার সাহিত্য যে ব্যাপ্তি বৈচিত্র্য ও বিশালতা গভীরতা লাভ করেছে তার সঙ্গে তুলনা দেওয়ার মতো দ্বিতীয় প্রবন্ধ লেখক এখনো বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হননি।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাগ্রন্থ :

রবীন্দ্রনাথ রচিত প্রবন্ধ গ্রন্থগুলি বিশেষ কয়েকটি পর্যায়ে বিভাজিত করে আলোচনা করা যেতে পারে। যেমন—

  • (ক) শিক্ষা-সমাজ-রাজনীতি : আত্মশক্তি (১৯০৫), ভারতবর্ষ (১৯০৬), শিক্ষা (১৯০৮), স্বদেশ (১৯০৮), সমাজ (১৯০৮) কালান্তর (১৯৩৭), সভ্যতার সংকট (১৯৪১) ইত্যাদি।

  • (খ) ধর্ম ও দর্শনমূলক : ধর্ম (১৯০৯), শান্তিনিকেতন (১৯০৯), মানুষের ধর্ম (১৯৩৩), বিশ্বভারতী (১৯৫৩)।

  • (গ) সাহিত্য সমালোচনার সমালোচনা (১৮৮৮), প্রাচীন সাহিত্য (১৯০৭), আধুনিক সাহিত্য (১৯০৭), লোক সাহিত্য (১৯০৭) ইত্যাদি।

  • (ঘ) ব্যক্তিগত প্রবন্ধ : পঞ্চভূত (১৮৯৭), বিচিত্র প্রবন্ধ (১৯০৭), লিপিকা (১৯২২)।

  • (ঙ) জীবনী ভ্রমণকথা ও পত্রসাহিত্য : য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র (১৮৮১) ছিন্নপত্র (১৯১২), রাশিয়ার চিঠি (১৯৩১), ছেলেবেলা (১৯৪০) ইত্যাদি।


কবি সার্বভৌম রবীন্দ্রনাথ বাংলা প্রবন্ধের এক অনন্য স্রষ্টা। তাঁর প্রতিভার ‘সোনার কাঠির’ স্পর্শে পাষাণ পুরীর স্বর্গ পুরীতে রূপান্তর এক স্বাভাবিক ঘটনা। শিক্ষা, রাজনীতি, সমাজনীতি, ধর্ম সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রভৃতি তথ্য নির্ভর প্রবন্ধে তিনি যুক্তি নির্ভর, তীক্ষ্ণ বাক্য সন্নিবেশে তৎপর এবং শ্লেষ ও ব্যঙ্গ প্রয়োগে সিদ্ধহস্ত। ব্যক্তিগত প্রবন্ধের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের অন্তরের অতল তলে নিমজ্জমান এবং যেখান থেকে সপ্তরঙের মায়ামাণিক্য আহরণ সাহিত্যের এক সম্পদ বিশেষ। তার ধর্ম বিষয়ক প্রবন্ধাবলী ঐশী স্পর্শ লোভাতুর কবির আবেগময় আকুতির কাব্যময় প্রকাশ, শান্তিনিকেতনের ব্যাখ্যানমূলক লেখাগুলি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ধর্মমত ও উপনিষদের প্রভাব পুষ্ট। কিন্তু তত্ত্ব এখানে অর্মত্যবাণী নয় সে দৃশ্যে, বর্ণে, গন্ধে, গানে মৃত। তাঁর শিক্ষা বিষয়ক প্রবন্ধগুলিতে লেখকের উপর মানসমুক্তি এবং প্রকাশিত শিক্ষাপদ্ধতির যান্ত্রিকতা ও অপূর্ণতা উদ্ঘাটিত। আদর্শ শিক্ষা প্রসঙ্গে অবশ্য তার মন্তব্যটিও সমর্থনযোগ্য “যিনি জাতি শিক্ষক ছেলেদের ডাক শুনলেই তার ভিতরকার আদিম ছেলেটা বেরিয়ে আসে।” তাঁর রাজনৈতিক প্রবন্ধে পাশ্চাত্য রাষ্ট্রনীতির ভোগস্পৃহা ও শোষণ বৃত্তি নিন্দিত, আর ভারতে ইংরাজ শাসনের কলংকিত অধ্যায় ধিকৃতে। মৃত্যুর প্রাক্কালে রচিত। সভ্যতার সংকট' প্রবন্ধে আপাত সমৃদ্ধ কিন্তু ভিতরে মৃত্যুহীন এই দস্যু সভ্যতার প্রতি কবির ঋষি সুলভ চরম অভিশাপবাণী উচ্চারিত, আর সেই সঙ্গে ধ্বনিত এক চিরন্তন বাণী: “মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।”


সমালোচনা সাহিত্য সৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ অদ্বিতীয়। উপনিষদ পোক্ত যে আনন্দ থেকে নিখিল বিশ্বের উদ্ভব, সেই আনন্দই মহাকবির মতে সাহিত্যের আদর্শলোক সৃষ্টির মৌল কারণ। ‘প্রাচীন সাহিত্য’ এর ‘মেঘদূত’ রবীন্দ্র সৃষ্ট নব মেঘদূত। কবি এই মেঘদূতকে নিয়ে চলে গিয়েছেন আপস কল্পরাজ্যে, যেখানে তাঁর ‘মানস সরোবরের গগন তীরে’ পরম দায়িত্ব প্রতীক্ষারত। অতলস্পর্শ বিরহ কবি চিত্তে ঘনীভূত, সেই গভীর বিরহের মধ্যে কবির আশ্বাস “এক অপূর্ব সৌন্দর্যলোকে শরৎ পূর্ণিমা রাত্রে তাঁহার সহিত চিরমিলন হইবে।” রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সমালোচনা অভিনব সাহিত্য সৃষ্টি, কবির মতে, কালিদাসের প্রকৃত মাহাত্ম্য ভোগাসক্ত প্রেমের বর্ণাঢ্য চিত্রণে নয়, উপমাশ্রিত প্রেমের নিরুচ্ছ্বাস পরিণতিতে। ‘কাব্যে উপেক্ষিতা’ প্রবন্ধে উর্মিলার প্রতি গুরু কবির উপেক্ষা কাহিনী কবিগুরুর লেখনীতে বিবৃত বাণভট্টের হাতে পত্রলেখার আতপ্ত যৌবনের অবমাননায় কবি ব্যথিত। কাব্যে উপেক্ষিতারা প্রাচীন কাব্যের যজ্ঞভূমি থেকে উত্থিত হয়ে রবীন্দ্র চিত্তের স্বর্ণ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত।


রবীন্দ্রনাথের ‘লোকসাহিত্য’ অবিস্মরণীয়। “এই সকল চূড়ার মধ্যে একটি চিরত্ব আছে* অখ্যাত গ্রাম্য কবির রচনা সম্বন্ধে মহাকবির রাজসিক প্রশস্তি—“এই স্বাভাবিক চিরত্বগুণে ইহারা আজ রচিত হইলেও পুরাতন এবং সহস্র বৎসর পূর্বে রচিত হলেও নূতন।” আধুনিক সাহিত্যের সমালোচনাগুলি রবীন্দ্রনাথের সুক্ষ্মদর্শিতার পরিচায়ক। এর মধ্যে বঙ্কিমের ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসের সমালোচনা এককথায় অসাধারণ। তবু নিক্তি নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে স্বীকার্য ‘প্রাচীন সাহিত্যে' তার সমালোচনা যতটা সৃষ্টিধর্মী 'আধুনিক সাহিত্য' তার অভাব দুষ্ট। এছাড়া স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথের বিস্ময়কর সৃষ্টি তার “বিচিত্রপ্রবন্ধ'। যুক্তিতর্ক বিনির্ভর কবির ধ্যান দৃষ্টির একটি অতর্কিত উৎক্ষেপ, স্বপ্নাতুর কল্পনার এক বর্ণাঢ্য চিত্রকল্প এবং ভাবহীন সহজের রস এখানে অপরূপ কাব্য সৌন্দর্যে অভিব্যক্ত। এখানে কারুকার্য করা ভাবার নৌকা চেয়ে লেখক যেন বিষয় থেকে বিষয়স্তরে স্বেচ্ছা ভ্রমণে রত। আর সেখানে রসস্রোতের সোনার তরী লেখকের অন্তরের স্পর্শে ও আনন্দের ফসলে ভরপুর হয়ে উঠেছে।


সর্বোপরি, রূপকাশ্রয়ী ‘পঞ্চভূত’-এর লেখাগুলি কবিত্ব এক নতুন ধরনের রচনার নিদর্শন। সারস্বতাগ্রজ বঙ্কিমের ‘কমলাকান্তের দপ্তর'-এর সঙ্গে আঙ্গিক সাদৃশ্য থাকলেও ভাব ভাষা এবং বস্তু তথ্যে রবীন্দ্রনাথের রচনা সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী, লেখকের মতানুযায়ী কম বেশী এক একটি উপাদানের এক একটি বিশেষ গুণ মানুষকে পৃথক বৈশিষ্ট্য এনে দিতে সক্ষম। পঞ্চ চরিত্রের সাথে কবি দ্রষ্টা নিজে হয়েছেন ষষ্ঠ সঙ্গী। এই দু'জনের মাধ্যমে বিচিত্র জীবন সমস্যার বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচিত, সরস টিপ্পনী, গভীর তত্ত্বে, দ্রষ্টার নিস্পৃহ দর্শনে এবং প্রেম-দীপ্তি ও কল্পনার গুণে রচনাটি অনন্যস্বাদী। প্রচ্ছন্ন পরিহাস সরস, বক্তব্যের স্পষ্টতা উপমা ও উপমানের অজস্রতা” ভাষার প্রসাদগুণ ও কাব্যধর্মিতা রবীন্দ্রপ্রবন্ধের কালজয়ীতার স্মারক। তার প্রতিটি কথায় অনুভব করা যায় অন্তর্নিহিত রসসত্তার ধ্বনিময় প্রস্ফুটন। তাই তিনি শুধু কবি রবীন্দ্রনাথ নন, প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ ও বাংলা সাহিত্যে মৃত্যুহীন কৃতিত্ব।