কৃত্তিবাসী রামায়ণে মৌলিকতা | বাংলা রামায়নের আদি কবি কৃত্তিবাস ওঝা ও তার কৃতিত্ব

কৃত্তিবাসী রামায়ণে মৌলিকতা


কেউ কেউ মনে করেন, কৃত্তিবাস এই পাঁচালী রচনা করেছিলেন পন্ডিতদের মুখে এর কাহিনি শুনে শুনে। তবে, মধ্যযুগের ভারতীয় ভাষার কোন কবিই প্রাদেশিক ভাষায় রামায়ণ-মহাভারতাদি অনুবাদ করার সময়ে মূলের আক্ষরিক অনুসরণ করেননি। নিজ নিজ অঞ্চলের চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে তাঁরা মূল্য কাব্যকে প্রয়োজনমতো অদল বদল করে নিতেন। অর্থাৎ সেকালে আক্ষরিক অনুবাদের চেয়ে ভাবানুবাদের দিকে তাঁদের অধিকতর দৃষ্টি ছিল। কৃত্তিবাসের পাঁচালী কাব্যও অবিকল অনুসরণ নয়, আক্ষরিক অনুবাদ তো নয়-ই। তিনি বাল্মীকির কোনো কোনো কাহিনি বা প্রসঙ্গ বর্জন করেছেন কোথাও মূল কাহিনিকে কিছু পরিবর্তিত করে নিয়েছেন, কোথাও বা নিজ কল্পনা থেকে কাহিনি তৈরি করে নিয়েছেন। তবে তিনি বাল্মীকির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতেও ভোলেননি—

বাল্মীকি বাসিন্দা কৃত্তিবাস বিচক্ষণ।

পাঁচালী প্রবন্ধে রচে বেদ রামায়ণ।।


তাঁর সবচেয়ে বড়ো কৃতিত্ব হল তিনি কোথাও কোথাও বাল্মীকিকে পরিত্যাগ করে অন্য কোনও উৎস থেকে কাহিনি সংগ্রহ করেছেন। যেমন—লঙ্কাকাণ্ডে মেঘনাদের সঙ্গে যুদ্ধে রামচন্দ্র ও লক্ষণ মূর্ছিত হলে হনুমানের ঔষধ আনা প্রসঙ্গে বলেছেন—“নাহিক এসব কথা বাল্মীকি বকন্তে।” উত্তরকাণ্ডে লবকুশের দ্বারা ভরত, শত্রুঘ্ন ও লক্ষ্মণ পরাভূত ও নিহত হলেও দৈব প্রসাদে পুনর্জীবিত হলেন। এ কাহিনি বাল্মীকি রামায়ণে নেই। এর উৎস রূপে কৃত্তিবাস নির্দেশ করেছেন—“এসব গাহিল গীতি জেমিনি ভারতে।” ওই থেকে প্রমাণিত মূল বাল্মীকি রামায়ণের সঙ্গে তাঁর বিশেষ পরিচিতি ছিল। যখন তিনি বাল্মীকি ছেড়ে অন্য কোনও গ্রন্থ থেকে কাহিনি সংগ্রহ করেছেন তখন তার উৎসও নির্দেশ করেছেন।


আর্য রামায়ণের বিপুল কাহিনি সম্ভার থেকে কৃত্তিবাস অতি সতর্কতার সঙ্গে নিম্নোক্তে কাহিনিগুলি পরিত্যাগ করেছেন কার্ত্তিকের জন্ম, বশিষ্ট বিশ্বামিত্র বিরোধ, বিশ্বামিত্র কথা, অম্বরীষ যজ্ঞ, রামচন্দ্র কর্তৃক আদিত্য হৃদয় স্তব পাঠ। এই কাহিনিগুলি বাল্মীকি থেকে নেননি, আবার অন্যদিকে নিজ কল্পনা থেকেই এই কাহিনিগুলি নির্মাণ করেছেন— সৌদাস-দিলীপ-রঘুর কাহিনি- দশরথের রাজ্যে শনির দৃষ্টি গণেশের জন্ম, সম্বরাসুর বধ, কৈকেয়ীর বরলাভ, গুহকের সঙ্গে মিতালি, অনুমান কর্তৃক সূর্যকে কক্ষতলে ধারণ, বীরবাহুর যুদ্ধ, তরণী সেন- মহিরাবণ- অহিরাবণ কাহিনি, রাবণ বধের জন্য রামচন্দ্র কর্তৃক দেবী চন্ডীকার অকালবোধন এবং ১০৮টি নীলপদ্মের কাহিনি, গণকের ছদ্মবেশে হনুমান কর্তৃক মন্দোদরীর নিকট থেকে রাবণের মৃত্যুবাণ হরণ। মুমূর্যু রাবণের নিকট রামচন্দ্রের রাজনীতি শিক্ষা, দেবর-বধূদের অনুরোধে সীতা কর্তৃক খড়ির দ্বারা রাবণের মূর্তি অঙ্কন, তা দেখে রামে মনে সীতা সম্বন্ধে সংশয়, লবকুশের যুদ্ধ ইত্যাদি।


কৃত্তিবাস বাল্মীকির কোনো কোনো কাহিনি ইচ্ছামত রদবদল করে নিয়েছেন, কোথাও বা অন্য পুরাণ থেকে গল্প সংগ্রহ করেছেন। যেমন—আদিকাণ্ডে দস্যুরত্নাকর ‘মরা’ ‘মরা’ বলে পাপ মুক্ত হয়েছিলেন, এ কাহিনি বাল্মীকিতে নেই। অধ্যাত্ম রামায়ণে অযোধ্যা কাণ্ডে আছে। হরিশচন্দ্রের উপাখ্যান নানা পুরাণ উপপুরাণে আছে, তবে কৃত্তিবাসে বোধ হয় এটি দেবী ভাগবত ও মার্কন্ডেয় পুরাণ থেকে নিয়েছেন। ভগীরথের জন্মবৃত্তান্ত বাল্মীকি রামায়ণ বহির্ভূত, এটির উৎস পদ্মপুরাণ। গঙ্গা আনয়ন প্রসঙ্গ ‘স্কন্দপুরাণ’ থেকে নেওয়া। দেবীর অকাল বোধন দেবী ভাগবত থেকে নেওয়া, অদ্ভুত রামায়ণে আছে সহস্র স্কন্ধ রাবণ বধের জন্য সীতার দেহ থেকে চৌষটি যোগিনীর আবির্ভাব হওয়ার কাহিনি কৃত্তিবাস কুম্ভকর্ণ হত্যা বর্ণনায় এই চৌষটী যোগিনী নিয়োগ করেছেন। রামের রাজ্যপ্রাপ্তির পর হনুমানকে মূল্যবান স্বর্ণহার দিলে পবন নন্দন তা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে কারণ তাতে রাম নাম লেখা ছিল না। একাহিনি অধ্যাত্ম রামায়ণে আছে। দশরথের রাজ্যে যে শনির প্রকোপ বর্ণিত হয়েছে তার মূল উৎস—স্কন্দপুরাণ ও কালিকা পুরাণ। লবকুশের সঙ্গে রাম ভরত লক্ষ্মণ শত্রুঘ্নের যুদ্ধ বিবরণ জেমিনি ভারত থেকে সংকলিত হয়েছে।


এ সমস্ত থেকে সহজেই অনুমেয়, কৃত্তিবাস কোন কোন কাহিনি নিজস্ব কল্পনা বলে সৃষ্টি করেছিলেন, কিছু বা নানা পুরাণ থেকে গ্রহণ করেছিলেন। তবে ছোটো বড়ো ঘটনা বাদ দিলেও কৃত্তিবাসের রচনায় যে ভক্তির স্পষ্ট প্রভাব আছে সেটাই হচ্ছে তাঁর মৌলিক অবদান। বাস্তবিক কৃত্তিবাসের ভক্তিবাদ বাল্মীকি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ব্যাপার। কিন্তু একটু অনুসন্ধান করলেই দেখা যাবে যে এই বৈশিষ্ট্য কৃত্তিবাসের একার নয়। রাম-কথাযুক্ত নানা পুরাণ বা অন্য রামায়ণ কাব্যে মন্দোদরী রাবণ, কুম্ভকর্ণ, বিভীষণ ও কালনেমি প্রচ্ছন্ন রাম-ভক্ত রূপেই উল্লিখিত হয়েছেন। রাবণ যখন জানতে পারলেন যে, বিষ্ণুর হাতে মৃত্যু হলে অস্তিম মোক্ষলাভ হবে তখন তিনি বিষ্ণু অবতার রামচন্দ্রের হস্তে নিহত হবার বাসনা করেই সীতাকে হরণ করলেন। অধ্যাত্ম রামায়ণে এই ভাবে প্রচ্ছন্ন ভক্ত রাবণের কথা বর্ণিত হয়েছে।

কৃত্তিবাসী রামায়ণে যে শৈব, শাক্ত ও বৈষ্ণব প্রভাব দেখা যায়, তা যে পরবর্তীকালের সংযোজনা তা পুরোপুরি স্বীকার করা যায় না, কারণ নাগপুরাণ উপপুরাণ এবং বিভিন্ন রামায়ণে ভক্তি ভাবের অনেক কাহিনি আছে। কৃত্তিবাস সমস্ত ওই উৎস থেকেও উপাদান সংগ্রহ করে থাকবেন। তবে কৃত্তিবাস মূলতঃ বাঙালি সুলভ ভক্তিভাবের কবি।