রামায়ণে— করুণ রস

রামায়ণে— করুণ রস


রসের দিক থেকে বিচার করলে কৃত্তিবাসের রামায়ণের ফলশ্রুতি হচ্ছে করুণ রস, এটিই প্রধান রস। মূল রামায়ণের উত্তর কাণ্ডেরও প্রধান রস হল এই করুণ রস। সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্র মতে রস 'চারটি—বীর, করুণ, আদি ও শাস্ত। এই চারটি রসের মধ্যে যে কোনটি মহাকাব্যের অঙ্গীরস হতে পারে। মূল রামায়ণেও করুণ রসের প্রাধান্য। কৃত্তিবাসও সেই একই রীতি অনুসরণ করেছেন। অযোধ্যা কাণ্ডের রাম নির্বাসন থেকে আরম্ভ করে উত্তর কাণ্ডের সীতা নির্বাসন ও সীতার ধরিত্রী মাতার অভ্যস্তরে আশ্রয় গ্রহণ—সর্বত্রই করুণ রসেরই প্রাধান্য। দশরথের দেহত্যাগ, রামের নির্বাসনে অযোধ্যাবাসীদের বিলাপ, কৌশল্যার আর্তনাদ সীতা হরণ, সীতা-শূন্য কুটিরে ফিরে রামলক্ষণের বিলাপ। বালীবধে তারার ক্রন্দন, লংকা কান্ডে রাবণবংশ ধ্বংস, রাবণের পতন। তাঁর বিধবা পত্নীদের বিলাপ সীতার অগ্নি প্রবেশ— সমস্ত ঘটনার পিছনে আছে করুণ রসের প্রবাহ।


উত্তর কাণ্ডে সীতার নির্বাসন, রামের বিষণ্ণতা, সীতার পাতাল প্রবেশ এবং চার ভ্রাতার সলিলে তনুত্যাগ—ইত্যাদি অন্যকোন মহাকাব্যে এত বেদনার পরিচয় পাওয়া যায় সরযূ না। পাশ্চাত্য মহাকাব্যের অধিকাংশেই রণদামামা প্রতিধ্বনিত। এখানে করুণ রসের অবকাশ থাকলেও বীর রস প্রধান রস বলেই গৃহীত হয়েছে। কিন্তু রামায়ণ ধীরে ধীরে বিষণ্ণ পরিণতির দিকে অগ্রসর হয়েছে। যদিও কৃত্তিবাসের প্রতিভা বাল্মীকির মতো ভূলোক দ্যুলোক সঞ্চারী নয়, তবু করুণ রসে তিনি যথেষ্ট দক্ষতা দেখিয়েছেন। মধ্য যুগের বাংলা কাব্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, করুণ রসেই বাঙালির অন্তর সমধিক সাড়া দিয়েছে। কৃত্তিবাসও তার উপর ভিত্তি করে রামায়ণ পাঁচালী রচনা করেছিলেন। সেকালের বাঙালি সমাজ রামচন্দ্রকে পূর্ণ ব্রষ্ম জেনে ভক্তি নিবেদন করেছে। রামচন্দ্রের দুঃখহত পরিণামকে দৈবীলীলা মনে করে আশ্বস্ত হয়েছে, কিন্তু সমস্ত কিছুই চলেছে বাঙালির সুখ দুঃখে গড়া জীবনকে অবলম্বণ করে। সীতার মধ্যে বাঙালি নারী সমাজের সুখ দুঃখকেই যেন উপলব্ধি করতে চেয়েছে। সীতা চরিত্র বাঙালির কাছে শুধু একটি প্রাচীন পৌরাণিক নারী চরিত্র নয়, তার মধ্য দিয়ে বাঙালি সর্বংসহ স্ত্রীসমাজকেই প্রত্যক্ষ করতে চেয়েছে।


কৃত্তিবাসী রামায়ণের আদিকাণ্ডে দৃষ্ট হয় রাক্ষস বধের জন্য ঋষি বিশ্বামিত্র রাম লক্ষণকে নিয়ে যাচ্ছেন। বিদায় মুহূর্তে দশরথের আকুল ক্রন্দন কাব্যে করুণ রস সৃষ্টিতে বিশেষ সহায়ক হয়েছে—

কত দূরে গিয়া রাম হন অদর্শন। 

ভূমিতে পড়িয়া বাছা করেন ক্রন্দন।

তবে পিতার মতই রামলক্ষ্মণও থেমে থাকেননি তাঁরাও—

রাজার দুঃখেতে দুঃখী শ্রীরাম লক্ষণ।

রাজার ক্রন্দনে কাঁদেন ভাই দুইজন।


এর পর রামের বনবাসে অযোধ্যা যখন ক্রন্দনের রোলে মুখরিত ঠিক সেই সময় অরণ্য মাঝে অকস্মাৎ রাবণ কর্তৃক সীতা অপহৃত হওয়ায় রামের যে বিলাপ তা বিস্ময়ের উদ্রেক করে—

কান্দিয়া বিফল রাম জলে ভাসে আঁখি

রামের ক্রন্দনে কান্দে বন্য পশু পাখি।


সীতাকে হারিয়ে রামচন্দ্র মাল্যবান পর্বতে উপনীত হলে, সেখানে রামের বিলাপে আকাশ বাতাস মুখরিত হতে থাকলো। বর্ষার অঝোর ধারাও জানিয়ে দিল রামচন্দ্র দুঃখিত। কারণ—“সীতা লাগি শ্রীরাম কান্দেন বারমাস।”


রামচন্দ্র হয়ে উঠেছেন বাঙালি পুরুষ। কাজেই অতি সহজে তার চরিত্র হতে বীরোচিত ধৈর্য্য, গাম্ভীর্যের চিত্র বিদূরিত হয়েছে। সীতার জন্যে রামের যে আচরণ দৃষ্ট হয় তা— কাপুরুষোচিত হলেও অতি বাস্তব। কারণ স্ত্রীকে জ্বলন্ত অগ্নি কুন্ডে প্রবেশ করতে দেখে রামচন্দ্র পাগল হন।

‘দেখেন সংসার শূন্য যেমন পাগল। 

ভূমে গড়াগড়ি যায় হইয়া বিকল।।


শুধু রাম কেন, রামের সঙ্গে উপস্থিত সভাসদ সবাই কাঁদছেন। আর “রামের ক্রন্দনে কাঁদে সর্ব দেবগণ।” অর্থাৎ সমগ্র রামায়ণ জুড়ে সীতার বিহনে রামের মর্মক্রন্দন প্রতিধ্বনিত হয়েছে। সীতা অপহরণ থেকে শুরু করে, অগ্নিপরীক্ষা, এমনকি পাতাল প্রবেশ পর্যন্ত রামের অশ্রু বিনির্গত হয়েছে। প্রশ্ন জাগে শুধু অশ্রু দিয়ে কি এই বিশাল মহাকাব্য সৃষ্টি করা হয়েছে, সীতা বিসর্জনের দ্বাদশ বর্ষ পর মহাকবি ভবভূতি রামের মনের অবস্থাকে ব্যক্ত করতে লিখেছেন—“স্পটিপাক প্রতীকাশোরামস্য করুনো রসঃ।” অর্থাৎ ছিদ্রহীন লৌহপাত্রে জল উত্তপ্ত হলে তার বাষ্প যেমন বাইরে আসতে পারে না, অনুরূপ, রামের মর্মস্থলও অবরুদ্ধ ‘সন্তাপে দগ্ধ হচ্ছে। রামের এই অন্তহীন দাহ ও বিষাদের ক্ষেত্রে কৃত্তিবাসের রামের কোনও তুলনা আছে কি?


পরিশেষে বলতে হয়, কাব্যমধ্যে কৃত্তিবাস অল্পস্বল্প বীররসের পরিচয় দিলেও তা স্বতঃস্ফূর্ত হয়নি। অভিজ্ঞতার অভাবে কৃত্তিবাসের রাম রাবণের যুদ্ধ বর্ণনা যাত্রা দলের লম্ফ ঝম্পে পরিণত হয়েছে। সবচেয়ে মারাত্মক হয়েছে বীররসের সঙ্গে ভক্তির অনধিকার প্রবেশ। রাবণ, বীরবাহু তরণী সেন—সকলেই ভক্ত, কেউ প্রকাশ্যে কেউ বা প্রচ্ছন্নভাবে। সুতরাং তাদের মৃত্যুতে বীররসের গাম্ভীর্যের হানি হয়েছে। মধ্যযুগের কোনও রচনাতেই যুদ্ধ বিগ্রহের বর্ণনা যথেষ্ট বাস্তবধর্মী হতে পারেনি। বরং ভারতের অন্যান্য প্রদেশের মধ্যযুগীয় কাব্যে যুদ্ধবিগ্রহের বর্ণনা অনেকটা জীবন্ত হতে পেরেছে। কিন্তু পুরাতন বাংলা কাব্যের যুদ্ধ বর্ণনা অত্যন্ত কৃত্রিম। কৃত্তিবাসও তার বাইরে যেতে পারেননি। কাজেই সব মিলিয়ে বলতে হয়, কৃত্তিবাসী রামায়ণে বহু দুঃখজনক ঘটনা এবং তার জন্য হাহাকার যেমন করুণ রস সৃষ্টি করেছে তেমনি বিরাট যুদ্ধ বর্ণনা চিত্র প্রকটিত হলেও সার্থকভাবে বীররসের সৃষ্টি হয়নি।