বাংলা নাট্য সাহিত্যে দীনবন্ধু মিত্রের অবদান ও কৃতিত্ব | বাংলা নাট্য সাহিত্যে দীনবন্ধু মিত্রের অবদান ও ভূমিকা

বাংলা নাট্য সাহিত্যে দীনবন্ধু মিত্রের অবদান


মধুসূদন বাংলা নাট্য সাহিত্যে প্রথম উজ্জ্বল সার্থক প্রতিভা। মহাকাব্যের পাশাপাশি বাস্তব জীবনের সমতল ভূমিতে নিরীক্ষণ করবার এক কৌতূহলী মানসিকতা নিয়ে তিনি এসেছিলেন বলেই বাংলা নাট্যশিল্পকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক আকর্ষণ তাকে বেশীক্ষণ মানব জীবনের অন্তর্লীন সমভূমিতে নামতে দেয়নি। এইরকম একটি শূন্যময় পরিস্থিতিতে দীনবন্ধু মিত্রের আবির্ভাব। তার চাকুরী জীবন এবং ঘন ঘন স্থান পরিবর্তন অসংখ্য মানুষের ভিতরের খবর জানবার সুযোগ করে দিয়েছিল। যাকে বলা যেতে পারে অভিজ্ঞতা। একদিকে তার অভিজ্ঞতা অন্যদিকে তার বাস্তব চৈতন্যবোধ মানব জীবন, রহস্য সন্ধানে তীক্ষ্ণ নিরীক্ষণ ও কৌতূহলী মনোভাব জীবন রহস্য সন্ধানে তাঁকে একজন শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের রসদদান করেছিল। বাস্তবজীবন, অভিজ্ঞতা, জীবনবোধ ও সহানুভূতি বা সমবেদনা তার নাট্য শিল্পের প্রধান লক্ষণ। তিনি প্রথম নাট্যকার যিনি পরিপূর্ণ কল্পনার হাতে নিজেকে সমর্পণ না করে মানব লোকের দর্শনে তার জীবনকে অনুভব করবার চেষ্টা করেছেন। গভীর জীবনবোধকে অনুভব করবার চেষ্টা করেছেন। গভীর জীবনবোধকে সহজ করবার জন্যেই তিনি হাস্য-পরিহাসের ভূমিকা নিয়েছিলেন। নাট্যকারের শ্রেষ্ঠ লক্ষণ নিস্পৃহতা, পক্ষপাতহীন এক উদার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী। দীনবন্ধু মিত্রের সেটাই ছিল মৌলিক সম্পদ।


দীনবন্ধু মিত্রের রচনাসমূহ:

বঙ্কিমচন্দ্র দীনবন্ধু সম্পর্কে যে সমালোচনা করেছে, তা আজ পর্যন্ত অবিতর্কিত। তিনি বলেছেন “কেবল অভিজ্ঞতায় কিছু হয়না, সহানুভূতি ভিন্ন সৃষ্টি নাই। দীনবন্ধুর সামাজিক অভিজ্ঞতাই বিস্ময়কর নহে— তাঁহার সহানুভূতি ও অতিশয় তীব্র।" এই মন্তব্যের উপর পুরোপুরি আস্থা রেখে তার নাটকগুলিকে উল্লেখ করা যেতে পারে। নীলদর্পণ (১৮৬০), নবীন তপস্বিনী (১৮৬৩), বিয়ে পাগলা বুড়ো (১৮৬৬), সধবার একাদশী (১৮৬৬), লীলাবতী (১৮৬৭), জামাই বারিক (১৮৭২), কমলে কামিনী (১৮৭৩) প্রভৃতি দীনবন্ধু মিত্রের রচিত নাটক।


দীনবন্ধু মিত্রের নাটক :


নীলদর্পণঃ নাটক বাংলা সাহিত্যে প্রথম গণজাগরণের নাটক। লোকচরিত্র বা গণচরিত্র এই প্রথম নাটকে স্থান পেল এবং এই প্রথম একটি সমসাময়িক ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়কে নাট্যকার রূপ দিলেন। নীলকর সাহেবদের, চাষীদের জোর করে নীল চাষের জন্য যে অমানসিক অত্যাচার ও নির্যাতন সমকালকে কলঙ্কিত করেছিল, দীনবন্ধু তাকেই নাট্য সাহিত্যে মূর্ত করে তুললেন। বৃটিশ শাসকের ভয়ে তিনি নিজের নাম পর্যন্ত ছাপতে পারেননি। জমিদার ও কৃষক সমাজের হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায় এই প্রথম অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হল। জমিদার এখানে শোষক নয় বরং জমিদার ও রায়ত একত্র হয়ে নীলকরদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিল। বাংলাদেশে প্রথম ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন এইভাবে নীলকর বিরোধীতার মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করল। বাংলার সামাজিক ও রাষ্ট্রিক ইতিহাসে সত্যিকারের ঐতিহাসিক দর্পণ—–যার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের কালের মানুষকে ও সমাজে অবলোকন করার সুযোগ পেয়েছি। অত্যাচারের বিরুদ্ধেও শোষণের মোকাবিলায় এইভাবেই সাধারণের মধ্য থেকেই বিদ্রোহের বাণী উচ্চারিত হয়েছিল।


এই নাটকে দুঃখ-যন্ত্রণা ব্যথা ও ব্যর্থতা হাসি ঠাট্টা সব মিলিয়ে পল্লী বাংলার একটি আশ্চর্য করুণ মধুর জনচিত্র ফুটে উঠেছে। গ্রামীণ সমাজ তার নিজস্ব চৌহাদ্দির মধ্যে থেকেও শুধু ব্যক্তিত্বের জোরে একেবারে পাদ প্রদীপের কাছে এসে পড়েছে। দীনবন্ধু মিত্র ভদ্র চরিত্র অঙ্কনে তেমন সার্থকতা দেখাতে পারেন নি। তাই গোলক বস্তুও তার পরিবার অনেকখানি নিষ্প্রভ। -কিন্তু ভদ্রেতর ব্যক্তিগুলি একেবারে সোনার অক্ষরে বাঁধা পড়েছে। তিনি যে কতখানি নিপুণ চরিত্র রূপকার তা এই শ্রেণীর চরিত্র অঙ্কনে প্রমাণ করেছেন। আমরা যে সহানুভূতির কথা উল্লেখ করেছি তা গরীব কৃষককুলের দুঃখ বেদনার সঙ্গে এমন সর্বব্যাপীত্ব অর্জন করেছে যা বিস্ময়কর। অভিজ্ঞতা তাকে এই চরম সার্থকতা দিয়েছে। তোরাপ, রাইচরণ, আদুরী, ক্ষেত্রমণি প্রভৃতি চরিত্রগুলি এত উজ্জ্বল ও জীবস্ত হয়ে উঠেছে যে এদের একটি সংলাপের অংশ বাদ দিলেই চরিত্রগুলি পঙ্গু হয়ে যায়। অনেকে এই নাটকে অশ্লীলতার প্রশ্ন তুলেছেন কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র মনে করেন এইটুকু আছে বলেই তোরাপ, আদুরী, ক্ষেত্রমণি চিরকালের অমর চরিত্র হয়ে উঠেছে। এটি যদি না থাকত তাহলে ‘কাটা আদুরী’, ছেঁড়া তোরাপকে পেতাম। দীনবন্ধু সেই অপূর্ণতা থেকে আমাদের রক্ষা করেছেন।


দীনবন্ধু মিত্রের প্রহসন :

শুধু নাটক রচনায় নয়, প্রহসন রচনায় তিনি একজন শ্রেষ্ঠ দিক্‌পাল। নীলদর্পণের পরেই এই প্রহসনগুলি তাঁর প্রতিভার দিগন্তকে আরো প্রসারিত করেছে। 'বিয়ে পাগলা বুড়ো'র মধ্যে বৃদ্ধের বিবাহের বিড়াম্বনা হাস্যকর অসঙ্গতির মধ্য দিয়ে বর্ণিত হয়েছে। একাধিক বিবাহের প্রচলিত সমাজবিধি নিধি ন্যাক্কারজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে তা এখানে উল্লিখিত।


‘জামাই বারিক’ প্রহসনে ধনী সমাজে ঘর জামাই পোষার প্রবণতার মধ্যে যে নির্লজ্জতা ও স্বার্থপরতা এবং নিষ্ক্রিয় মানসিকতার অসুস্থতা বিদ্যমতি তা হাসি ঠাট্টার মধ্য দিয়ে ব্যক্ত করা হয়েছে। জ্বালায় বিড়ম্বিত ‘পদ্মলোচনের’ সকরুণ জীবন এবং তার সর্বাত্মক বিপর্যস্ত রূপ ও সতীনের কোন্দল প্রায় ক্লাসিক রসিকতার পর্যায়ে পড়েছে।


‘লীলাবতী’ রচনায় কলকাতা শহরতলীর বাস্তব চিত্র ও হাস্য পরিহাস মুখর বিচিত্র বর্ণনার মধ্য দিয়ে একটি সমস্যাসঙ্কুল পরিবেশের মুখোমুখী হই। এখানে একটি রোমান্টিক প্রেমের ছবি আছে। কিন্তু হাস্য পরিহাসের লক্ষণ হল বাস্তবধর্মী ঘনিষ্ঠতা। সেখানে যদি রোমান্টিক চিত্রের মধ্যে হাস্যরস পরিবেশন হয় তবে তা সহজে দানা বাঁধতে পারে না। তথাপি যারা এই কৌতুকে অংশ গ্রহণ করেছে সেই নদের চাঁদ ও হেমচঁাদকে আমাদের পক্ষে ভোলা মুশকিল।


‘সধবার একাদশী' চিরকাল বাংলা সাহিত্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবী নিয়ে থাকবে। নাট্যধর্ম ও প্রহসনের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে এমন একটি রসোৎকর্ষ সৃষ্টি করেছে যা দীনবন্ধুর নাট্য প্রতিভাকে অমরত্ব দান করার পক্ষে যথেষ্ট। সেকালের কলকাতার শিক্ষিত ও অশিক্ষিত যুব শক্তির মধ্যে পানাসক্ত বারাঙ্গনা সেবা, পরস্ত্রীহরণ প্রভৃতি ব্যভিচারী দিকগুলি কি কুৎসিত পর্যায়ে পৌঁছেছিল তার কাহিনী এখানে বিবৃত। এই নাট্যধর্মী প্রহসনের উপর মাইকেলের ‘একেই কি বলে সভ্যতার’ প্রভাব আছে। কিন্তু মাইকেল শুধু প্রহসনের মধ্যে আবদ্ধ থেকেছেন। কাহিনীর action ও চরিত্রের সংঘাত সেখানে ছিল না। কিন্তু সধবার একাদশীতে নাটকের নিমচঁাদ চরিত্রটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেখ্য। তার সুখ-দুঃখ-সংলাপ আচার-আচরণ কোনটাই তার চরিত্রের বাহ্যিক পোষাক নয়, ধমনীর রক্ত প্রবাহের মতো অনিবার্য ও অত্যাবশ্যকীয়। তাঁর চরিত্রের মধ্য দিয়ে তৎকালীন সমাজের একটি প্রতিনিধি স্থানীয় সম্প্রদায়কে প্রকাশ করা হয়েছে। নিমচঁাদ দত্ত আদর্শবাদী উচ্চশিক্ষিত কিন্তু সংযম তার চরিত্রে অনুপস্থিত। সুরার স্রোতে ভাসতে গিয়ে নিজেকে সে দেউলে করেছে। সে সুন্দর কথা বলতে পারে, হাসতে ও হাসাতে পারে। ব্যঙ্গের ছুরিকে ঝলসাতে পারে কিন্তু এ সবের অন্তরালে তার মধ্যে রয়েছে এক বেদনাময় জীবনের চোরাস্রোত। পিছনে পড়া আদর্শ চ্যুত এক ব্যক্তিত্বের অকালে ফুরিয়ে যাওয়ার এক করুণ রেখা আসলে সে কাঁদতে গিয়ে হেসে ফেলেছে। দীনবন্ধু নিজেও সে হাসিতে কতখানি যোগ দিয়েছেন জানি না তবে তার ভিতরের বিপুল যন্ত্রণা ও আত্মঘাতী ধ্বংসকে লক্ষ্য করেছেন বলেই সহানুভূতির আলোকে সে এত উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সধবার একাদশী এদিক দিয়ে একটি সার্থক প্রহসন।


কখনো কখনো তিনি তাঁর প্রতিভা শক্তির মর্যাদা না দিয়ে যখনি তার অভিজ্ঞতার বাইরে নাটক শিখতে গেছেন তখনি তা অসার্থক হয়ে পড়েছে। তার ছবি রোমান্টিক নাটক ‘নবীন তপস্বিনী’ ও ‘কমলে কামিনী’ আখ্যান নির্বাচনে কোন ত্রুটি নেই কিন্তু কুশীলবদের রোমান্টিক প্রেম বর্ণনায় অনেকখানি অপরিণত। যেন চরিত্রগুলি ড্রয়িং রুমে সাজানো পুতুলটিকে আছে কিন্তু বেঁচে নেই। সে তুলনায় গৌণচরিত্রগুলি পরিহাস রসিকতার মধ্য দিয়ে দর্শকের অনেক কাছাকাছি এসেছে। ধরা যাক ‘নবীন তপস্বিনীর’ জলাধর চরিত্র, এটি শেক্সপীয়রের ‘ফলষ্টাপ’ চরিত্রকে স্মরণ করিয়ে দিলেও যেমন ফলষ্টাপ ও হয়নি তেমন নিছক একটি রসিক চরিত্র বলে মনে হয়েছে। রোমান্টিক আখ্যান রচনা করতে গেলে যে কল্পনা শক্তি ও বাস্তব তিরোহিত সাময়িক বোধের দরকার তা তার ছিল না। তার বাস্তব বোধ এমনিভাবে তার কল্পনার রথকে প্রতিরোধ করেছিল বলেই রোমান্টিক আখ্যান প্রণয়ণে তিনি তেমন, সার্থক হতে পারেন নি।


উপসংহার: বাংলা নাট্য সাহিত্যে দীনবন্ধু মিত্র স্বয়ং একটি অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছেন এবং গণচরিত্রের যে আবাহন তিনি করেছিলেন তা পরবর্তীকালে আরো প্রবল শক্তিতে গণনাট্য আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আধুনিক কাল পর্যন্ত শাখা প্রশাখা বিস্তার করেছে, সেদিক থেকে তিনি পথ দ্রষ্টা ও অদ্বিতীয় নাট্যকার প্রতিনিধি। বলাবাহুল্য গিরিশচন্দ্রের মতো অভিনেতা, প্রযোজক ও শিক্ষক এবং দীনবন্ধুর মতো নাট্যকার ছিলেন বলেই বাংলাদেশের শহর ও শহরবলীতে এত শীঘ্রই নাট্যভিনয় সংস্কৃতির বাহন হিসাবে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছিল।