শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন কাব্যে সমাজ বাস্তবতা বা সমাজ চিত্র।

শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন কাব্যে সমাজ চিত্র


প্রাক-আধুনিক যুগে ধর্মের একটি সর্বাতিশায়ী ভূমিকা সংলক্ষ্যরূপ লাভ করেছিল। সমাজের ব্যষ্টি বা সমষ্টির শক্তি ছিল অবান্তর। সমাজবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে সাহিত্যের প্রকৃত মূল্যায়নের ধারাটি আধুনিক সাহিত্য সৃষ্টিও একটি সামাজিক কর্ম। কেননা, সাহিত্যের একটা পারম্পর্য আছে এবং প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার ঘাত-প্রতিঘাত অজ্ঞাতসারে হলেও সৃষ্টির মধ্যে প্রতিফলিত হয়। বাংলা প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় কাব্যের পুণর্মূল্য নির্ধারণে বিশেষ করে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন’ কাব্যের অন্তরঙ্গে বিধৃত সমাজ চিত্রের সূত্রানুসন্ধানে কথাগুলি স্মরণযোগ্য। ‘নাট্যগীতিমূলক’ এই আখ্যায়িকাটিতে লৌকিক জীবনের সমাজচিত্র বিচ্ছিন্ন ভাবে রয়েছে। সেগুলি সমাজচৈতন্যের ঐতিহাসিক ভিত্তিতে হয়তো দৃঢ়বদ্ধ নয়—তথাপি সেগুলি বিশেষ যুগের বিশেষ প্রয়োজনের স্মারকচিহ্ন স্বরূপ। কাব্যকাহিনিটির প্রতিটি স্তর স্পষ্টভাবে অনুধাবন করলে সেগুলির সন্ধান পাওয়া যায়। বিক্ষিপ্ত উল্লেখগুলিকে একত্রীকরণ করলে সমাজ পটভূমির মূল ভিত্তির সঙ্গে লৌকিক সমাজ পটভূমির একটি বিন্যস্তরূপের পরিচয়ও লাভ করা যাবে।


ব্যবহারিক জীবনচর্যার দৈনন্দিন দিক অর্থাৎ আহার-বিহার, বেশভূষা, চলন-বলন প্রভৃতি বিষয়েও কবি অভ্যাস ও সংস্কারকে ঘিরে বিভিন্ন উপাদান আহরণ করেছেন।


‘শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তনে’ সোনা, হীরা, মণি, মাণিক্য, মুক্তা, গজমুতি প্রভৃতি রত্নের উল্লেখ প্রাচুর্য সাধারণ লোকের ও স্বচ্ছল অবস্থার পরিচয়বহ। গোয়ালিনী রাধা হাটে দধি বিক্রয় করতে যাবার সময়েও তার হাতে ‘সোনার চুপড়ি’ ও ‘রূপার খড়ী'। খাট-পালঙ্ক সুবর্ণমণ্ডিত কবি রাধার অঙ্গে বিবিধ অলংকার দিয়েছেন। মাথায় সর্বত্র ‘মুকুট’, গলায় ‘সাতনরী’ (সপ্তকণ্ঠী) হার, কোথাও বা ‘গজমুতি হার’, কোথাও বা ‘গুনিআ' অর্থাৎ 'সুত-হার’, কখন ও ‘উল পুষ্পের হার’ রাধার কর্ণে ‘রতণে’ উজ্বল কুণ্ডল, হিরাধর কঢ়ী ইত্যাদির উল্লেখ আছে। হাতের অলঙ্কার হিসেবে উল্লেখ আছে ‘অঙ্গদ বাহুযুগলে’ ‘বাহুর বলয়া’, ‘রতনে জুড়িত দুই বাহু পঙ্ক', 'হাতের বাহুরী’, ‘কণক কঙ্কন’, ‘রতন কঙ্কন’, ‘কেয়ূর বলয়া’, ‘কনক যুথিকামালা বাহুযুগলে’, ‘বাহুতে কনকচুড়ী', 'মুকুতা রতনে জড়ী', 'রতকঙ্কন', ‘করমূলে কটিতে’ কনক কিঙ্কিণী চরণে কনক মল্ল ও নূপুর, পদাঙ্গুলিতে পাসলী ইত্যাদি অলঙ্কারের উল্লেখ আছে।


প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে লোকবিশ্বাসের ভাণ্ডারটি উম্মোচন করলে আমরা দেখি যাত্রাকালে বিশেষ পশু বা প্রাণী দর্শনে যে শুভ-অশুভ ফল পাওয়া যায় তার প্রতি লোকের বিশ্বাস ছিল প্রবল। যাত্রার সময়ে হাঁচি, টিকটিকির আওয়াজ পায়ে হোঁচট লাগা অশুভ হিসেবে পরিগণিত হয়। ডানদিকে সবৎসা ধেনুদর্শন, বামে শৃগাল বা পূর্ণকলস দর্শন যাত্রার পক্ষে শুভ চিহ্ন। 'শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে' বড়ু চন্ডীদাস উল্লেখ করেছেন :

কোন আসুভ খনে পাতা বাঢ়ায়িলোঁ। 

হাঁছী জিবী আয়র ঊঝট না মানিলোঁ।।

শুন কলসী লই সখী আগে জাত্র। 

বাঞর শিআল মোর ডাহিনে জাত্র।।

বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন থেকে এ জাতীয় আর একটি উদ্ধৃতি—

কথো দূর পথে মোঁ দেখিল সগুণী। 

হাথে খাপর ভিখ মাঙ্গ এ যোগিনী।। 

কান্ধে কুরুআ লআঁ তেলী আগে জাত্র। 

সুখান ডালেতে বসি কাক কাঢ়ে রাত্র।।


লোকাচার ও লোকবিশ্বাসের ক্ষেত্রে 'দধি' মঙ্গলের প্রতীক। আমাদের সর্বপ্রকার মাঙ্গলিক আচার-অনুষ্ঠানে দই ব্যবহৃত হয়। সামাজিক মর্যাদায় উচ্চবর্ণ ভুক্ত না হয়েও তাই গোয়ালিনীর দই বিক্রির জন্য দেওয়া হাঁক অশুভ লক্ষণ হিসাবে বিবেচিত হয় না। পূর্ণ কলসে হাত দেওয়া, গুরুর আসনে বসা, মাটিতে জলের দাগ দেওয়া এবং ভাঙ্গা কুলোর বাতাস লাগা ইত্যাদি প্রসঙ্গগুলি প্রাচীন লোকবিশ্বাসে অশুভরূপে পরিগণিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বড়ু চন্ডীদাস 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে' উল্লেখ করেছেন :

পূর্ণ কলসে কিবা ভরিলো হাথে।

তেকারণে বাঁশী চুরী দোসি জগন্নাথে।।

গুরুর আসনে কিবা চাপিআঁ বসিলো।

জলের আখর কিবা ভূমিত লেখিলোঁ৷৷

খণ্ড বিচনীর কিবা বাঅ তুলী লৈলোঁ গাত্র

তেকারণে কাহ্নাঞি বাঁশী চুরী দোষাত্র।।

ভাদ্রমাসে চতুর্থীকে নষ্টচন্দ্র বলা হয়। বড়ু চন্ডীদাস ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’ উল্লেখ করেছেনঃ

ভাদর মাসের তিথি চতুর্থীর রাতী।

জল মাঝে দেখিলোঁ মো কি নিশাপতী।।

তৎকালীন মানুষের মনে বিশ্বাস ছিল যে ভগবান পাপীর দণ্ড ও পুণ্যের পুরস্কার দেন :

পুণ্য কইলেঁ স্বগ্‌গে জাইত্র    নানা উপভোগ পাই এ

পাপেঁ হত্র নরকের ফল।

অভীষ্টসিদ্ধির আশায় লোকে কি কি করত তার উল্লেখ পাই 'বৃন্দাবনখণ্ডে'—

কেনা কুশক্ষেত্রে বিধিবর্তে কৈল দান। 

কাহার ফলিল পুক্ষর পুণ্য সিনান।।


এইভাবেই ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে বাঙালির ভাবচেতনা ও জীবনরসবোধ তৎকালীন সমাজজীবনের খণ্ড খণ্ড উপস্থাপনায় স্পষ্টোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।