বাংলা সাহিত্যে বিষ্ণুদের অবদান ও কৃতিত্ব | বাংলা সাহিত্যে বিষ্ণুদের স্থান ও ভূমিকা

বাংলা কাব্য সাহিত্যে বিষ্ণুদের অবদান


বিষ্ণু দে-র (১৯০৯-১৯৮২) কবিতার প্রতীতি সমাজবোধ থেকে উৎসারিত। তিনি প্রাজ্ঞ মননশীল এবং বাস্তবের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্কে অন্বিত। ভাববিলাস তার অনভিপ্রেত, আকরণ আবেগ-উচ্ছ্বাসে তিনি এলায়িত নন, নেতিবাদী জীবনদর্শন তাঁকে সমাচ্ছন্ন করেনি। তিনি অস্তিবাদী কবি, তাঁর কবিতা সর্বদাই এক বিশ্বাসবোধ উদ্দীপ্ত হয়েছে। প্রাচ্য ও প্রতীচ্য সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য থেকে ঋথ গ্রহণ করে তার কাব্যকে ঋদ্ধ করেছেন বিষ্ণু দে। আধুনিক কবিদের মধ্যে তিনি সর্বাধিক গ্রন্থের রচয়িতা। জীবনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত তার অনিঃশেষ শিল্পীসত্তা সৃজনকর্মে নিয়োজিত হয়েছে—এখানেও তাঁর অনন্যতা।


বিষ্ণুদের কাব্যগ্রন্থ:

তাঁর বিশিষ্ট কাব্যগ্রন্থ হল –‘উর্বশী ও আর্টেমিস’ (১৯৩২), ‘চোরাবালি' (১৯৩৮), 'সাত ভাই চম্পা' (১৯৪৫), ‘সন্দ্বীপের চর’ (১৯৪৭), ‘নাম রেখেছি কোমল গান্ধার' (১৯৫৩), ‘তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ’ (১৯৫৮), ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ' (১৯৬৩), ‘সেই অন্ধকার চাই’ (১৯৬৬), ‘ইতিহাসে ট্রাজিক উল্লাসে’ (১৯৭০), ‘উত্তরে থাকো মৌন’ (১৯৭৭), ‘আমার হৃদয়ে বাঁচো’ (১৯৮১) ইত্যাদি।


বিষ্ণু দে পণ্ডিত অধ্যাপক, বিশ্বসাহিত্যে তার সহজ সঞ্চরণ। তাঁর কাব্যে বহুপঠনশীল বৈদগ্ধ্যের ছাপ আছে, পরিশীলিত মননের প্রকাশ আছে, প্রাচ্যের সঙ্গে প্রতীচ্যের ভাবভাবনার সমন্বয়ও ঘটেছে। বিষ্ণু দে টি. এস. এলিয়টের অনুরাগী। এলিয়টের মত তার পৃথিবীও পতিত পড়ো জমি The Waste Land—জলহীন তৃণশঙ্কহীন ধূ ধূ করা মরুপ্রান্তর এবং মানুষও ফাঁপা শূন্যগর্ভ নিষ্প্রাণ খড়ের মূর্তি। সর্বগ্রাসী অবক্ষয় ও নিষ্করুণ আত্মিক সংকটের ভাষ্য এলিয়টের কাব্য; বিষ্ণু দেও এই সমাজ ব্যবস্থায় মানুষের প্রবল হতাশা আত্মিক বিনাশের কথা বলেছেন। বিষ্ণু দের কবিতার আঙ্গিকেও এলিয়ট প্রভাব ও প্রেরণারূপে বিদ্যমান। তবে এলিয়ট শেষপর্যন্ত ধর্মবিশ্বাসকেই আশ্রয় করেছেন, বিষ্ণু দে এলিয়টকে পরিহার করে সংগ্রামের মধ্য দিয়েই মানবমুক্তির পথ নির্দেশ করেছেন। বিষ্ণু দের কাব্যে শ্রমিক কৃষক সর্বহারা মানুষের অধিকার প্রতিপন্ন করা হয়েছে। মার্কসবাদে আস্থাশীল কবি বিশ্বাস করেন জনগণই ইতিহাসের চালিকাশক্তি এবং তারাই লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে অর্জন করবে আপন অধিকার।


'চোরাবালি’র অন্তর্গত ‘ঘোড়সওয়ার’ কবিতাটি অনুর্বর বন্ধ্যা মরুরিক্ত সমাজে মানুষের জাগরণ, যথার্থ বিপ্লবীর আগমন এবং তার নেতৃত্বে মানুষের মুক্তির সংগ্রাম ও জয়ের কথা বলা হয়েছে। এটা মানুষের কবিতা, জনজাগরণের কবিতা, সংগ্রামের কবিতা। অবশ্য কবিতাটির আবেদন বহুমাত্রিক লোকসংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে পাঠকের স্মৃতি অনুষঙ্গ বেয়ে কবির মগ্নচৈতন্য উন্মথিত করে ফ্রয়েডয়ুঙের লিবিডো তত্ত্বের বিন্যাসে রিচুয়াল ও রোমান্সের ভাবনা নিয়ে সমাজ পরিবর্তনের অমোঘ বাণী এখানে উচ্চারিত। বিষ্ণু দের কাব্যে দেশী বিদেশী ঐতিহ্যানুসরণ ও পুরাণ-চেতনা বিশেষ ভাবেই দেখা যায়।


রবীন্দ্রনাথের দ্বারাও বিষ্ণু দে প্রভাবিত ও প্রাণিত হয়েছেন। প্রথম পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ তার আক্রমণের বিষয় হলেও উত্তরকালে কবি রবীন্দ্র অনুধ্যানেই নিমগ্ন হন। ‘আবির্ভাব’ কবিতায় বললেন—“কানে কানে শুনি/তিমির দুয়ার খোলো হে জ্যোতির্ময়”। “তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ’ কবিতায় কবি তাঁর সঙ্গে একাত্ম হলেন—

যেখানে পর্বত ওড়ে আশ্বিনের নিরুদ্দেশ মেঘ

সন্ধ্যারূপে ঝিলিমিলি ঝিলমের বাঁকা তলোয়ার,

নটীর নূপুরে বাজে নদীর জোয়ার 

শিহরায় দেওদার বন।