‘চর্যাপদের’ সামাজিক পটভূমিকা (ঐতিহাসিক পটভূমি)

চর্যাপদের ঐতিহাসিক পটভূমি


খ্ৰীষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী—সেই দু’শ বছর বাংলা দেশের সামগ্রিক ইতিহাসে একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য সময়। এই সময়ে ঘটেছে ইতিহাসের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা পাল রাষ্ট্রের পতন, সেন রাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তার এবং বাংলাদেশে মুসলমান আক্রমণের ফলে সেই রাজত্ব কালও ধীরে ধীরে বিলীন হয়েছে, মুছে গেছে বাঙালির ইতিহাসে হিন্দু আধিপত্যের গৌরবময় তিলকচিহ্ন। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, আধিপত্যের উদগ্র আকাঙ্ক্ষা, একদিকে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি সামাজিক আদর্শ ও ভাবধারার প্রসার, অন্যদিকে আর্যপূর্ব-সংস্কৃতি ও সমাজচিন্তার জীবনবিন্যাস এবং জীবনাদর্শের প্রতিরোধ প্রচেষ্টা। দারিদ্র্য অভাব অনশন অত্যাচার পীড়ন শোষণ ; অন্যদিকে বিলাস ব্যসন কামচর্চা। একদিকে জ্ঞানসাধনা ধর্মসাধনা কঠোর চরিত্রানুশীলন, অন্য দিকে বিশ্বাসের অভাব। মনোজগতে নৈরাজ্যের আবহাওয়া মতবিরোধ, সব নিয়ে উত্তাপ তরঙ্গ বিক্ষুদ্ধ সমুদ্রের মতই এই দু’শ বছরের বাংলা দেশের ইতিহাস অস্থির ঘটনা চাঞ্চল্যে আন্দোলিত। এই দু'শ বছরের বিস্তৃতিতে বিভিন্ন সিদ্ধাচার্যদের দ্বারা রচিত হয়েছে বলে চর্যাপদের সামাজিক পটভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।


ভারতবর্ষে আর্যসভ্যতা প্রতিষ্ঠার পর সমগ্র বঙ্গদেশ জুড়ে সমাজ ও জীবনে ঘটে চরম বৈপরীত্য। আর্য সংস্কৃতির ধারক ও বাহক রূপে প্রতিষ্ঠা পেল ব্রাহ্মণ শ্রেণি। সমাজজীবনে ও ব্যক্তিজীবনের সমস্ত দিকে ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যের বজ্রকঠিন প্রভাব সুগভীর ও সুদৃঢ় রূপে প্রতিষ্ঠা পেল। এই ব্রাহ্মণদের প্রধান বৃত্তি ছিল ধর্মকর্মানুষ্ঠান এবং অন্যের ধর্মানুষ্ঠানে পৌরোহিত্য, শাস্ত্রাধ্যয়ন ও শাস্ত্রাধ্যাপণা। পরবর্তীকালের বৌদ্ধ রাজাদের আমলেও, ব্রাষ্মণের এই উচ্চ সোপান এবং সম্মানের আসন সমান মর্যাদার সঙ্গে স্বীকৃত হয়েছিল। তার কারণ বৌদ্ধরা বেদ বিরোধী হলেও আর্য সংস্কারের বিরোধী ছিল না। তাই বৌদ্ধরা ব্রাহ্মণ শ্রেণিকে বিশেষ মর্যাদার আসনে বসিয়ে ছিলেন। কিন্তু যারা ব্রাহ্মণ নয়, সমাজে উচ্চতম সক্ষম এবং প্রতিষ্ঠা যারা নিতান্তই জন্ম সূত্রে অর্জন করতে পারেনি তাদের অবস্থা কেমন ছিল? সমাজের নিম্নতম পর্যায়ে যারা অন্ত্যজ নাম নিয়ে বাস ? করতো তাদের বাড়ীতে জাত খোয়াবার ভয়ে অন্নগ্রহণ ছিল ব্রাহ্মণদের নিষিদ্ধ। এ নির্দেশ অমান্য করলে প্রায়শ্চিত্ত কৃচ্ছসাধন ইত্যাদিরও ব্যবস্থা ছিল। অবশ্য বিপদে পড়লে বর্জিত দ্রব্য, পায়েস ইত্যাদি খেতে ব্রাহ্মণদের নিষেধ ছিলনা— সামান্য মনস্তাপ প্রকাশ করলেই দোষ কেটে যেত। গ্রাম শহরের প্রান্তটিলায় ঘর বেঁধে এই অন্ত্যজরা বাস করতো। অন্ত্যজদের অধিকাংশই ছিল ব্রাহ্মণদের অস্পৃশ্য, তাদের ছায়া মাড়ালেও ব্রাহ্মণদের পাপ হোত। স্পর্শ বিচারের নানা বিধি নিষেধ ব্রাক্ষ্মণশাসিত সমাজে উদ্ধৃত উগ্রতায় প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে ছিল।


অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সমাজে ব্রাহ্মণের কোনও ধন উৎপাদনের ভূমিকা ছিল না। বণিক সমাজ বলে যাঁরা সমাজে স্থিত তাঁরা আবার বৈশ্য অথবা শুদ্র অস্ত্যজ শ্রেণির সমাজ-শ্রমিকেরা সমস্ত রকম সামাজিক সুযোগ থেকে বঞ্চিত। কৃষিনির্ভর, কুটিরশিল্প নির্ভর নবম দশম শতকের বাংলা দেশে সমাজে ধনোৎপাদনের ভূমিকা যারা নিয়েছিল, তাদের প্রধান অবলম্বন ছিল কায়িকশ্রম। এই কায়িক শ্রম ছিল ব্রাহ্মণদের দ্বারা নিন্দিত। ধর্মে কর্মে আচারে ব্যবহারে বিধি নিষেধ ইত্যাদির ক্ষেত্রে চর্যাপদের সমকালীন বাংলা দেশে ব্রাহ্মণের ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। ফলে এই নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ব্রাহ্মণ্য শাসিত সমাজে নানা কদাচার ও নৈতিক অধঃপতনের জন্ম দিয়েছিল। সমাজে এই বিকৃত ধর্মীয় প্রভাবের মাত্রাতিরিক্ততার ফলে হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয় ধর্মেরই শেষ পর্যায়ে ধর্মগ্রন্থাদিতে ও ধর্মাচারণে যেমন দেখা দিয়েছিল নীতিবোধের অভাব, তেমনি সমাজে নরনারীর যৌন আচরণে প্রকাশ পায় শালীনতাবোধের নির্লজ্জ দীনতা। সমাজের গতি এবং শক্তি সজীবতা ও প্রাণবন্ততা ধ্বংস করে দিয়েছিল বিকৃত ধর্মবিশ্বাস এবং তদানুযায়ী ঘৃণ্য ধর্মাচরণ। এর সঙ্গে অভিশাপ হিসাবে ছিল বর্ণভেদ এবং বর্ণ বিদ্বেষ। এর চারটি অভিশাপ সমাজকে যে কতটা ক্ষয়গ্রস্ত করেছিল তা তৎকালীন সাহিত্যে প্রমাণিত।


যৌন অনাচার যখন রাজা এবং সভাসদদের দ্বারা সমর্থিত, সমাজের সর্বস্তরে তা কালক্রমে পরিব্যাপ্ত হবে তা স্বাভাবিক। তবে এর বিপরীত অবস্থা ছিল সমাজের নিম্নস্তরে। সেখানে ছিল অবিচ্ছিন্ন অভাব-দারিদ্র্য শোষণ-অত্যাচার-অবিচার। এই নিরবচ্ছিন্ন অভাব ও দারিদ্র্য সমাজের এক বৃহৎ অংশে পরিব্যাপ্ত ছিল বলে চর্যাপদের সাধকদের কাব্যে অবধারিত ভাবে একটা নৈরাশ্য ও শূন্যতা বোধ ছড়িয়ে আছে। চর্যাপদের বিভিন্ন গানের নানা পঙক্তিতে জীবনের যে খণ্ড চিত্র ছড়ানো রয়েছে সে সব ছবির মধ্যে করুণ বেদনার রংই প্রধান। এই গীতিকাব্যের প্রায় সর্বত্রই একটা দুঃখ ও নিরানন্দের ব্যথাময় সুর অনুরণিত। সে সমাজে সাধারণ মানুষের কামনা বাসনা তথা সুখে জীবন ধারণের সামান্যতম প্রেরণাও নানা বিধি নিষেধে বিঘ্নিত সেখানে মন থেকে বাসনা ছেদন করার জন্য নির্দেশ দেবেন সিদ্ধাচার্যরা, এটাই স্বাভাবিক। মানুষের মন সর্বদাই আশা আনন্দ, ভোগ ও কামনার দিকে যখন নিত্য বহমান তখন সে জীবনে সমস্ত ভোগের জিনিসকেই দুহাত বুকে টেনে নিতে চায়, জীবন উপভোগের আনন্দ ভরে ওঠে কানায় কানায়।


কিন্তু অসাম্য অনিয়ম কঠোর শাসন এবং নিপীড়ন, অত্যাচার ও অনাচারের জরাজীর্ণ যে সমাজ সেখানে এ ধরনের স্বতঃস্ফূর্ত স্ফুরণ কীভাবে সংঘটিত হবে? সমাজ যেখানে দরিদ্রের প্রতি সহানুভূতি হীন, মানবিকতার মূল্য দিতে অনিচ্ছুক, সেখানে চর্যাপদের কবিরা নীতিবাক্য আওড়ানো ছাড়া আর কি বলতে পারেন? সুখ ও আনন্দের চেতনা যা সাধারণ মানুষের জীবনে সদা জাগ্রত তা থেকে সামাজিক কারণেই বঞ্চিত সে যুগের সাধারণ মানুষ। এই সাধারণ মানুষের ক্রন্দন ও বেদনার প্রতিকার করা যদিও সিদ্ধাচার্যদের দায়িত্ব নয় কিন্তু এই ব্রুন্দন ও বেদনার প্রতি তাঁদের হৃদয় ছিল সদাজাগ্রত, সেজন্য জীবন সম্ভোগের নানা সহজ সাধনার কথা যেমন তাঁরা বলেছেন, তেমনি ব্রাহ্মণ শাসিত সমাজের নানা বিধি নিষেধকে তাঁরা কঠোর ভাবে বিদ্রুপও নিন্দ। করেছেন। বাহ্য আচার অনুষ্ঠানে এবং নিষ্প্রাণ নিয়ম সর্বস্বতার মধ্যে আবদ্ধ ব্রাহ্মণদের সামগ্রিক ক্রিয়াকলাপই প্রমাণ দেয় নিম্নস্তরের মানুষের প্রতি উচ্চকোটির ছিল কী নিদারুণ অবজ্ঞা ও অবহেলা। কবিরা হৃদয় ও বুদ্ধি দিয়ে সমাজের এই অসংগতি এবং অসম বিধিব্যবস্থার স্বরূপ বুঝেছিলেন বলেই তাঁরা সহজ সাধনার সমতার ক্ষেত্রে মানবত্মাকে আহ্বান করেছিলেন। তাই সিদ্ধান্ত করা চলে সামাজিক অবিচার-সঞ্জাত প্রত্যক্ষ অভাব বোধই তাঁদের কাব্যে শূন্যতা বোধ সৃষ্টি করেছে।


চর্যাপদের সমকালীন বাংলাদেশের সামগ্রিক চিত্রটি হল— একদিকে সামাজিক গোঁড়ামি, ঐশ্বর্য বিলাস এবং কামবাসনার আতিশয্য। কাব্য কবিতাগুলির অধিকাংশই যৌনকামবাসনায় মদির এবং মধুর, লাম্পট্য, চারিত্রিক অবনতি ও দেহগর্ত বিলাস, ধর্ম আচরণে ভেদবুদ্ধি, নিন্দনীয় যৌনকামনা, অমানুষিক ঘৃণা ও অবহেলা— জীবনের সমস্ত দিকের কদর্যতার সমাবেশ। আর অন্যদিকে নিদারুণ দারিদ্র্য, ক্ষুধা, অভাব, পীড়ন, শোষণ, যন্ত্রণা ও মৃত্যু।


এই নিশ্ছিদ্র সর্বব্যাপী সুগভীর অন্ধকারের বেড়াজালে চর্যাপদের সমকালীন বাংলাদেশ দুরপনেয় চারিত্রিক কলঙ্কের ক্রমবর্ধমান অভিশাপে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছে— কোথাও কোনো আশা নেই। নিপীড়িতের যন্ত্রণা প্রকাশের ভাষা নেই, মানবধর্মে নেই ক্ষীণতম বিশ্বাস। সমস্ত বাংলাদেশই যেন এই অন্ধকারের সুকঠোর পেষণে মৃত্যু যন্ত্রণায় ক্রন্দন করছে–‘ভাই ভবিত্তি কিল কা হামারি'। এগিয়ে এলেন সিদ্ধাচার্য কবিকূল, ঘোষণা করলেন প্রতিকারের নীতি—সেগুলি একত্রিত হয়ে আত্মপ্রকাশ করলো 'চর্যাপদ' নামে।