বাংলা নাট্য সাহিত্যে গিরিশচন্দ্র ঘোষের অবদান ও কৃতিত্ব | বাংলা নাট্য সাহিত্যে গিরিশচন্দ্র ঘোষের স্থান ও ভূমিকা

বাংলা নাট্য সাহিত্যে গিরিশচন্দ্র ঘোষের অবদান ভূমিকা


বাংলা নাটকের বন্ধন দশা থেকে মুক্ত করে তার অঙ্গ সে যিনি নতুন যৌবনের জোয়ার আবাহন ঘটিয়েছিলেন। তিনি হলেন নাট্যকার অভিনেতা, নাট্যগুরু, নাট্যপরিচালক, স্থায়ী রঙ্গমঞ্চের পৃষ্ঠপোষক ও অভিনয় শিক্ষক গিরিশচন্দ্র ঘোষ। যে বাংলা নাটক এ যাবৎ কেবলমাত্র ধ্বনি বিলাস প্রিয় মানুষের, ইচ্ছানুক্রমেই মঞ্চস্থ হতো। সাধারণ দর্শকরা সেখানে অপাংতেয়। ধ্বনির খেয়াল খুশীতেই নাটকের গতি সচল থাকতো, কোথাও ধ্বনির গৃহে, প্রবাসান বাড়ীতে কিংবা ভাড়া করা ঘরেই এই নাটকের মর্জিমাফিক অভিনয়ের ফলে এক শ্রেণীর সাধারণ মানুষ প্রায় সর্বদাই নাটক সম্পর্কে যে কৌতূহল তা দমন করতে বাধ্য হতো। গিরিশচন্দ্র সর্বপ্রথম এই বৈষম্যকে অন্তর দিয়ে অনুভব করে অগ্রণী ভূমিকা নিলে একটা সাধারণ অথচ স্থায়ী রঙ্গমঞ্চের প্রতিষ্ঠা, যেখানে আপামর সাধারণ নারী পুরুষ অভিনয় করা এবং অভিনয় দেখার সুযোগ পাবে। তাঁরই পৌরহিত্যে ১৮৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে কলিকাতায় সর্বপ্রথম পেশাদারী রঙ্গমঞ্চ 'ন্যাশানাল থিয়েটারের’ প্রতিষ্ঠা হয় এরপর নতুন নতুন নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার তাগিদ অনুভব করে তিনি শুরু করেন নাটক রচনা, শুরু করেন অভিনেতাদের অভিনয় শিক্ষা দান, অশিক্ষিতা পণ্যরমণীকে অভিনয় শিক্ষা দিয়ে অসামান্যা অভিনেত্রীরূপে জন সমক্ষে এনে হাজির করলেন।


গিরিশচন্দ্র ঘোষ ন্যাশানাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করে নাট্য জগতে অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি করলেও বেশীদিন তিনি এখানে স্থায়ী হতে পারেনি। সহকর্মীদের সঙ্গে মতানৈক্য হওয়ায় তিনি এখান থেকে বেরিয়ে নতুন দল গড়ে ছিলেন। যাইহোক, ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠার পর কয়েকটি অসুবিধার সহজ সমাধান হয়ে গেল। আর ধনী ব্যক্তির লাভে অভিনেতাদের উন্মুখ হয়ে থাকতে হল না। অভিনেতারা শুরু করলো টিকিট বিক্রী। তার দ্বারা সাধারণ দর্শকরাও আকর্ষণ অনুভব করলো এবং টিকিট বিক্রীর টাকায় নতুন নতুন নাটক মঞ্চস্থ করার মূলধন ও সংগৃহীত হতে থাকলো। তাছাড়া, অভিনেতাদের মধ্যেকার সুপ্ত প্রতিভাগুলি এর সংস্পর্শে এসে উজ্জ্বল হতে থাকলো। প্রেরণা জাগল নতুন নতুন নাট্যকারদের, গিরিশচন্দ্র ঘোষ অপ্রতিরোধ্য গতিতে সৃষ্টি করতে শুরু করলেন নতুন নতুন নাটক এর ফলে বাংলা নাট্য জগতে তিনি চিহ্নিত হয়ে গেলেন ধ্রুবতারারূপে।


গিরিশচন্দ্র ঘোষের নাটক :

গিরিশচন্দ্র ঘোষের পূর্ণাঙ্গ নাটকের সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশখানা, এছাড়া প্রহসন, পঞ্চরং রূপক রঙ্গব্যঙ্গের নাটক ও অনুরূপ। এই প্রসঙ্গে গিরিশচন্দ্রের সমস্ত নাটকগুলিকে বিশেষ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। যেমন—


১। গীতিকাব্য ও গীতিনাট্য : গিরিশচন্দ্র নাটক রচনায় মনোনিবেশ করে সর্বপ্রথম কয়েকটি পৌরাণিক বিষয় নিয়ে গীতিনাট্য রচনা করেন। (ক) আগমনী (১৮৭৭) (খ) প্রাক্‌প্রতিমা(?) এগুলি সমস্তই অভিনয়ের দ্বারা দর্শক মাঝে আলোড়ন তুললেও এর নচেৎ গুণ ও সাহিত্যরস সৃষ্টিতে ব্যাহত হওয়ায় পরবর্তীকালে এই সকল নাটকের অভিনয় আর হয়নি বললেই চলে। আগমনী, অকালবোধ, দোললীলা প্রভৃতি রচিত হয়েছিল তাৎক্ষণিক বিষয় অবলম্বনে, ফলে যাত্রাপথে একটা দীর্ঘ স্বাক্ষর রাখতে এগুলির দ্বারা কোন মতেই সম্ভব ছিল না।


২। পৌরাণিক ভক্তিরসের নাটক : এই শ্রেণীর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নাটক হল (ক) চৈতন্যলীলা (১৮৮৪) (খ) বিশ্বমঙ্গল (১৮৮৮) ইত্যাদি। কেবলমাত্র ভক্তি রসকেই আশ্রয় করেই এই পর্বের নাটকগুলি রচিত।


৩। পৌরাণিক নাটক: কেবলমাত্র পুরাণ মহাকাব্যকে কেন্দ্র করে তার কয়েকটি বিশেষ বিশেষ কাহিনীর উপর নাট্যগুণ আরোপ করে রচনা করেন পৌরাণিক নাটক, গিরিশচন্দ্রে এই পর্বের নাটকের মধ্যে যে সমস্ত নামগুলি সর্বাগ্রে করতে হয় তা হল (ক) অভিমন্যুবধ (১৮৮১) (খ) জনা (১৮৯৪) (গ) পাণ্ডব গৌরব (১৯০০) ইত্যাদি। এই সকল নাটকের নাট্যগুণ এতই উৎকৃষ্টরূপে প্রস্ফুটিত হয়েছিল, তা পাঠ করতে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যেতে হয়, হয়তো গিরিশচন্দ্রের পূর্বে মনোমোহন বসু, রাজকৃষ্ণ প্রমুখ নাট্যকারগণ অনেক পৌরাণিক নাটক রচনা করেছিলেন কিন্তু সেগুলি তেমন নাট্যগুণে সমৃদ্ধ ছিল না। গিরিশচন্দ্র তার এই সমস্ত নাটকের মধ্যে দিয়ে আমাদের জানিয়েছিলেন—পুরাণের কোন বিষয় আমার বাস্তব জীবনের সুখ-দুঃখ আশা কামনার সঙ্গে একেবারে স্বাভাবিক ভাবেই মিশে যেতে পারে একসূত্র রচনার গুণে। এই প্রসঙ্গে তাঁর পৌরাণিক পর্যায়ের সর্বশ্রেষ্ঠ নাটক ‘জনা’র প্রধানা নারী চরিত্র ‘জনা’ পুত্রের মৃত্যুতে মাতৃত্বের গভীর শোক অথচ বীর নারীর রূপেই বিলাপের ন্যায় যে সমস্ত কথাগুলি বলেছেন তা সত্যই গিরিশচন্দ্রের প্রতিভা কোন্ মাপকাঠিতে মাপা চলে না—

চল, যথা বাসুকির শ্বাসে

দগ্ধ দিক দিগন্তর।

চল যথা ঘোর তমোমাঝে

খেলেনীল প্রলয় অনল

লক লকি বিশ্বগ্রাসী জিহ্বা।

দূরে দূরে –

হেথা তোর নাহি স্থান পুত্র শোকাতুরা। এই সংলাপের মধ্য দিয়ে তিনি যে ছন্দের সৃষ্টি করেছিলেন তা আজ গৈরিশ ছন্দ নামে পরিচিত।


৪। ঐতিহাসিক নাটক: বিংশ শতকের পাদলগ্নে সমগ্র ভারতবর্ষ যখন দেশীয় ইংরাজ শাসকের অত্যাচারে উত্তাল। জনসাধারণ দণ্ডিতের ন্যায় মূহ্যমান, বঙ্গভঙ্গের মধ্যে তখন কবি সাহিত্যিক নাট্যকারের বিরুদ্ধে বিপ্লবীদের মতো প্রতিবাদ না করে পারেননি। গিরিশচন্দ্রও পৌরাণিক রাজ্যের কল্পমরু জগৎ থেকে অবতীর্ণ করে তো স্থান নিলেন রাজনৈতিক ও স্বাদেশিকতার অঙ্গনে। এই প্রেক্ষাপটে তিনি কয়েকটি ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে রচনা করলেন স্বদেশ প্রেমের নাটক। যেমন—(ক) সিরাজদ্দৌলা (১৯০৬), (খ) মীরকাশিম (১৯০৬), (গ) ছত্রপতি শিবাজী (১৯৮৭) (ঘ) অশোক (১৩৯১) (ঙ) খত্নাম (১৯০৪) ইত্যাদি। তবে এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, গিরিশচন্দ্র ভারত ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞানী হলেও ঐতিহাসিক নাটক রচনায় ইতিহাসকে তেমন অনুসরণ করেছিলেন বলে মনে হয় না। কারণ এর ঘটনা ধারাগুলোকে তিনি প্রয়োজনমতো পরিবর্তন ও সংযোজন করেছেন। ফলে কোথাও অনৈতিহাসিকতা, অতি নাটকীয়তা, বাস্তববোধের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। ড. অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন তিনি যুগের দাবী মেটাতে গিয়ে ঐতিহাসিক নাটক লিখেছিলেন। কিন্তু বিশুদ্ধ নাটক রচনার দাবী মেটাতে পারেননি।


৫। গার্হস্থ্য সামাজিক নাটক: ভক্তি, পৌরাণিক, ঐতিহাসিক পর্বের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় পর গিরিশচন্দ্র আত্মনিয়োগ করলেন—সামাজিক নাটক, রচনায় যা দৈনন্দিন গার্হস্থ্য জীবনের চিত্র। গিরিশ চন্দ্র বাস্তবজীবন সম্পর্কে এত তীক্ষ্ণ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ছিলেন তার সম্যক পরিচয় মেলে এই পর্বের নাটক রচনার গুণ দেখে। (ক) প্রফুল্ল (১৮৮৯) (খ) হারানিধি (১৮৯০) (গ) বলিদান (১৯০৫) (ঘ) শাস্তি কি শাস্তি (১৩১৫ বঙ্গাব্দ) (ঙ) মায়াবসান (১৮৯৮) প্রভৃতি নাটক এই পর্বের শ্রেষ্ঠ রচনা এর মধ্যে 'প্রফুল্ল’ নাটকে গিরিশা ছন্দের প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটেছে, আজও প্রায় দর্শকদের মুখে মুখে ফেরে এর প্রধান চরিত্র যোগেনের সেই বিখ্যাত উক্তি “আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল।” যা একান্নবর্তী পরিবারের ধ্বংস, বিভাজন, ভাঙন-এর বাহক।


৬। ব্যঙ্গ নাটিকাঃ গিরিশচন্দ্র কি পরিমাণে রসিক এবং কৌতুকপ্রিয় মানুষ ছিলেন তার সার্থক স্বরূপ ফুটে উঠেছে এই পর্বের রচনায়। যেমন—সপ্তমীতে বিসর্জন, বেল্লিক বাজার, বড়দিনের বখাশিস, সভ্যতার পাণ্ডা য্যায়সা কি ত্যায়সা ইত্যাদি নাটকে কৌতুকের অন্তঃসলিলা রস রন্ধ্রে রন্ধ্রে সংস্থাপিত হয়তো হাস্যরসের জন্য অনেক স্থানে অস্বাভাবিক সংলাপ ও চলিত অশ্লীল ভাষার প্রয়োগ ঘটেছে তবুও কোথাও অস্বাভাবিকতার দোষে দুষ্ট নয়।


৭। অনুবাদিত নাটক: তিনি মৌলিক রচনার সাথে সাথে বেশ কয়েকটি বিদেশী নাটক অবলম্বনে অনুবাদমূলক নাটক রচনা করেছিলেন। যেমন—শেক্সপীয়রের ‘ম্যাকবেথ' নাটকটি এই প্রসঙ্গে বিশেষ উল্লেখযোগ্য।


নাট্য সাহিত্যে গিরিশচন্দ্র ঘোষের প্রতিভা বৈশিষ্ট্য:

গিরিশচন্দ্র ঘোষের সুদীর্ঘ নাট্যসম্ভারকে গভীরভাবে অনুধাবন করার পর তার সম্পর্কে যে সমস্ত অনন্য বৈশিষ্ট্য আমাদের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে তা হল—

  • তাঁর সময়েই তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্যকার কারণ ৭৯টি নাটক রচনা করে তিনি প্রমাণ করেছিলেন— তার প্রতিভা গুণ ছিল আকাশচুম্ভী।
  • নাট্য রচনার সাথে সাথে তিনি ছিলেন একাধারে অভিনেতাও বটে। তার প্রায় সমস্ত নাটকে তিনি মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
  • একজনের বলতে গেলে তিনি বিরাট নাট্য নির্দেশকও ছিলেন। কারণ তাঁরই পরিচালনায় তাঁর সমস্ত নাটকগুলিই মঞ্চস্থ হতো,
  • সর্বোপরি তিনি ছিলেন একটা সাধারণ বাঙ্গালায় প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্যোক্তা, যেখানে থেকে বাংলা নাটক-অভিনয়ের জয়যাত্রা ঘোষিত হয়েছিল।