বাংলা সাহিত্যে প্রাবন্ধিক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান | বাংলা সাহিত্যে প্রাবন্ধিক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কৃতিত্ব

বাংলা সাহিত্যে প্রাবন্ধিক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান ভূমিকা


অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১-১৯৫১) জাত শিল্পী, — মনে প্রাণে শিল্পী, অস্থিমজ্জায় শিল্পী। তার শিল্প প্রকাশ পেয়েছে যেমন তুলিকায় তেমনি লেখনীতে। সাহিত্যিক অবনীন্দ্রনাথের আসন চিত্রশিল্পী অবনীন্দ্রনাথের নীচে নয়, তা ছাড়া বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথের অন্তর্বর্তী যুগের লেখকদের অধিকাংশেরই উপরে। সবচেয়ে বড় কথা রবীন্দ্রযুগে রবীন্দ্রনাথের অতীব ঘনিষ্ট সাহচর্যে বাস করেও তিনি রবীন্দ্র-প্রভাবমুক্ত, নিজ বৈশিষ্ট্যে দেদীপ্যমান।


সর্ব বয়সের সর্বশ্রেণীর মানুষের মধ্যে যে চিরশিশু ঘুমিয়ে থাকে – রূপ-কথার সোনার কাঠি ছুইয়ে তিনি তাদের ঘুম ভাঙাতে রূপলোকের মাধুর্য আস্বাদন করেছেন। অথবা কথাটা এভাবেও বলা যায়—মাটির উপর বসিয়া তিনি মাটির মানুষের মন কেড়ে নিতেছেন। যে মাটিতে চিরকালের ফসল ফলে, মানুষের শিশু নিত্য ভূমিষ্ট হয়।


অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা :

তাঁর সকল রচনায়ই রূপকথা ধাঁচে লেখা পুরাণ, ইতিহাস, বাস্তবকাহিনী। ‘ক্ষীরের পুতুল' (১৮৯৫) ও ‘শকুন্তলা' (১৮৯৫) ঊনবিংশ শতাব্দীর শতকের শেষে বাহির হয়। ইহার পর— ‘‘বাংলার ব্রত’ (১৯০৮), ‘রাজকাহিনী’ (১৯০৯), ‘ভূত পতরীর দেশ’ (বাং ১৩২২), ‘খাজাঞ্চির খাতা’ (১৩২৩), ‘বুড়ো আংলা’ (১৩৪১), ‘পথে বিপথে’ (১৯১৯), 'বাগীশ্বরী-শিল্প প্রবন্ধাবলী’ (১৯৪৮), 'জোড়া সাঁকোর ধারে' (বাং১৩৫০), 'ঘরোয়া' (১৩৪৮), ‘আপন কথা' (১৩৫৩), 'আলোর ফুলকি' (১৯৪৭)–ইত্যাদি।


সাহিত্যিক অধ্যাপক প্রমথনাথ বিশী অবনীন্দ্রনাথের রচনায় পরিচয় দিতে লিখেছেন— ‘তার সমস্ত রচনা যেন একখানা সুদীর্ঘ মসলিনের থাম; ক্রমে ক্রমে অকুণ্ডলীকৃত হয়ে খুলে চলেছে। প্রথম দিকে তারসুতাগুলি মোটা, বুনান তেমন জমাট নয়; কিন্তু কালক্রমে তা সূক্ষ্মতর ঘনিষ্টতর হয়ে উঠেছে। আবার সাদা জমিনের উপর নানা রঙের ছাপ আছে। ....এই মসলিনের থানের সবটাই একই হাতের বুনন বলিয়া—ইহার যে কোন অংশ সমগ্রের স্বাদ দিতে সক্ষম। অবনীন্দ্রনাথের সব রচনার একই রস বলিয়া কোন একখানা বই পড়িলে একরকম সব বই পড়ার কাজ হয়ে যায়।


ক্ষীরের পুতুল— অবশ্য আসল রূপকথারই বস্তু। কালিদাসের শকুন্তলা খাটি রূপকথা না হলেও দীর্ঘকালের ব্যবধানে ওটি এখন রূপকথারই বস্তু হয়ে উঠেছে। রাজকাহিনীর ঐতিহাসিক কাহিনী দেখতে লেখক রূপকথার দূরবীক্ষণ চোখে লাগিয়ে ওটিকে রূপলোকের ঘটনা করে তুলেছেন।


রাজস্থানের ঐতিহাসিক তথ্য নিয়ে অবনীন্দ্রনাথ কি অপরূপ রূপকথার ইন্দ্রজাল বুনেছেন—তার দৃষ্টান্ত দিতে 'রাজকাহিনী' থেকে কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া যাচ্ছে— “...হঠাৎ সন্ধ্যার অন্ধকারে ডানার একটু খানি ঝটাপট সেই ঘুমন্ত শিকারী পাখীর কানে পৌঁছল, সে ডানা ঝেড়ে ঘাড় ফুলিয়ে বাদশার হাতে সোজা হয়ে বসল। আলাউদ্দীন বুঝলেন তার শিকারী বাজ নিশ্চয়ই কোন শিকারের সন্ধান পেয়েছে। তিনি আকাশে চেয়ে দেখলেন, মাথার উপর দিয়ে দুখানি পান্নার টুকরোর মত এক জোড়া শুকশারী উড়ে চলেছে। বাদশা ঘোড়া থামিয়ে বাজের পা থেকে সোনার জিঞ্জীর খুলে দেন; তখন সেই প্রকাণ্ড পাখি বাদশার হাত ছেড়ে নিঃশব্দে অন্ধকার আকাশে উঠে কালো দুখানা ডানা ছড়িয়ে দিয়ে শিকারীদের মাথার উপরে একবার স্থির হয়ে দাঁড়াল, তারপর একেবারে তিনশ' গজ আকাশের উপর থেকে, এক টুকরো পাথরের মতো সেই দুটো শুকশারীর মাঝে এসে পড়ল।" — রাজকাহিনী৷


রূপকথার কাজ রূপ বা ছবি সৃষ্টি করা। উদ্ধৃতি অংশ দুটিতে—ছবি কি নিখুঁত। ভূতপত্রী, খাতাঞ্জির খাতায় বুনানি এতই সুক্ষ্ম যে, আছে কিনা আছে সন্দেহ হয়। বুড়ো আংলাতেও তাই। এ তিন খানা গ্রন্থই কিন্তুত রসের ভাণ্ড। ‘পথে বিপথে’র অধিকাংশ গল্পই গঙ্গায় স্টিমারে বেড়ানোর গল্প, কিন্তু লেখকের লেখনীর যাদুর স্পর্শে এটিও অপূর্ব রূপকথার বস্তু হয়ে উঠেছে।


‘ঘরোয়া’ ও ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’ – এই দুখানি গ্রন্থে অবনীন্দ্রনাথের শিল্প চরম পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে। সমসাময়িক ইতিহাসকে তিনি রূপকথায় পরিণত করেছেন।


দুঃখের কথা সাহিত্যিক হিসাবে অবনীন্দ্রনাথ তার যোগ্য মর্যাদা পান নি, তার কারণ অধিকাংশ পাঠকই তাঁকে শিশু সাহিত্যিক বলে মনে করেন, এবং তাঁদের ধারণা প্রত্যেক শিশু সাহিত্যিক সাহিত্যিক শিশু, একেবারে নাবালক। শিশুসাহিত্য নামে অখ্যাত এমন অনেক গ্রস্থ –বিশ্বসাহিত্যে আছে যার সংবেদন বয়স্কের সংস্কারের স্তরভেদ করে—চিরশিশুর অস্তরে গিয়ে পৌঁছায়। অবনীন্দ্রনাথের রচনা এই ধরনের শিশুসাহিত্য। অবনীন্দ্রনাথের রচনা যদি কোন বয়স্কের ভাল না লাগে বুঝতে হবে নানা সংস্কারের চাপে তার ভিতরকার চিরশিশুর মৃত্যু ঘটেছে।