বাংলা কাব্য কবিতায় সুধীন্দ্রনাথ দত্তের অবদান ও কৃতিত্ব | বাংলা কাব্য কবিতায় সুধীন্দ্রনাথ দত্তের স্থান ও ভূমিকা

বাংলা কাব্য কবিতায় সুধীন্দ্রনাথের অবদান ও কৃতিত্ব


চিত্ত ও বিদ্যার কৌলিন্য নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন গণনায় তিনি ভূষিত। সাহিত্য চর্চা থেকে এটর্নীগিরি, আইন পাঠ থেকে ফরাসী ও জার্মান ভাষা চর্চা। পত্রিকা সম্পাদনা থেকে—এ. আর. পি. র অফিসার অথবা ডি. ডি. সি. র প্রচার সচিব হওয়া। যাদবপুরের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপনা ইত্যাদি বিবিধ ক্ষেত্রে তাঁর অবাধ বিচরণ। অথচ শুধুমাত্র কাব্য চর্চা ও সাহিত্য সাধনা ছাড়া আর সবেতেই হয়েছিলেন বীতস্পৃহ। সামান্য কুক্কুটকে নিয়ে কবিতা লিখে রবীন্দ্রনাথের স্নেহ ও প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। কিন্তু কাব্যের প্রয়োজনে রবীন্দ্র জগৎকে ‘পরীর দেশ’ বলে প্রত্যাখ্যানে দ্বিধান্বিত হননি। আসলে বুদ্ধদেব বসুর ভাষায় : "সুধীন্দ্রনাথের তনু তন্ময়তার সঙ্গে মিলিছে তার আভিজাতিক সুমতি, তাঁর ইন্দ্রিয়ের ইন্দ্রলোক দুর্লভ মননশীলতায় গম্ভীর।" বস্তুত আধুনিক পৃথিবীর সমস্যা ও জীবন সত্য সন্ধান। দর্শন ও বিজ্ঞানের নানামুখী বিস্তার। মনোবিজ্ঞানের আবিষ্কার, প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের যথোচিত প্রয়োজনীয়তা—পশ্চিমী চিন্তা পদ্ধতির সবরকম প্রবণতাকে আত্মস্থ করে কবিতা লেখার গুরু দায়িত্বে হয়েছিলেন নিষ্ঠাবান। এই নিষ্ঠাই তাকে ধ্রুপদী রীতিতে কবিতা লেখায় অনুপ্রাণিত করেছিলেন।


সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যগ্রন্থ :

প্রথম প্রকাশিত কবিতা 'কুক্কুট' (১৯২৮) তন্ত্রী (১৯৩০), অর্কেস্ট্রা (১৯৩৫), ক্রন্দনী (১৯৩৭), উত্তর ফাল্গুনী (১৯৪০), সংবর্ত (১৯৫৩), প্রতিধ্বনি (১৯৫৪), দশমী (১৯৫৬) এবং বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যসংগ্রহ (১৯৬২)।


কবির প্রথম কাব্য ‘তন্ত্রী’তে প্রথম যৌবনের আবেগ প্রবণতা ও রূপানুরাগ অভিব্যক্ত এখানে ‘শ্রাবণ বন্যা’, ‘বর্ষার দিনে' প্রভৃতি কবিতায় আছে সম্ভোগময় প্রেমের অনুভূতি, বেদনাবিদ্ধ স্মৃতিচারণ, রহস্যময়ী প্রেমিকার প্রতি আকর্ষণ। এই কাব্যে রবীন্দ্র প্রভাব প্রত্যক্ষভাবে নেই, কিন্তু অনুরূপ ভাবনা আছে। যেমন রবীন্দ্রনাথের মতোই মৃত্যুর পর লীলা সঙ্গিনীর সঙ্গে চির মিলনের প্রত্যাশা দেখা গেছে—“তোমার প্রমোদ কুঞ্জে কি বৈতরণী তীরে, হে মোর ক্রন্দসী।” এই প্রাথমিক রচনায় শব্দ নির্মাণের কুশলতা ও তেমনভাবে চোখে পড়ে না। কারণ সুধীন্দ্রনাথের যুক্তাক্ষর বহুল তৎসম শব্দের গাঢ় গাম্ভীর্য ও উদ্ধত মহিমা তখনও পর্যন্ত কবিতায় অনুপস্থিত।


‘অর্কেস্ট্রা’ কাব্য থেকে সুধীন্দ্রনাথের স্বকীয়তার প্রকাশ, এ কাব্যে আছে মোট বাইশটি কবিতা, প্রেক্ষাগারের বর্ণনামূলক কবিতা, সাতটি সঙ্গীতের বর্ণনামূলক কবিতা, আর সাতটি সঙ্গীত ধ্বনি নায়কের মনে যে স্মৃতি বা অনুষঙ্গ জাগিয়ে তুলেছে তার কথা।


‘ক্রন্দসী’ কাব্যের অনেক কবিতা অর্কেস্ট্রার সমকালে রচিত। কিন্তু পার্থক্যে দুই কাব্য প্রায় বিপরীত। অর্কেষ্ট্রায় আছে ক্ষণস্থায়ী প্রেমের চিরস্থায়ী আর্তি, ক্রন্দসীতে আছে রূঢ় নিষ্ঠুর। হিংস্র-উন্মত্ত জগতের প্রতি কবির দৃষ্টিপাত। এখানে দেখা গেছে কখনো অসহিষ্ণু প্রতিবাদ, কখনো মর্মান্তিক হতাশা, কখনো বা নিষ্ফল স্বপ্ন। এ কাব্যের অন্তর্ভূক্ত ‘সন্ধ্যায়’, প্রত্যাখ্যান, কাল, অকৃতজ্ঞ প্রভৃতি কবিতা গুলির মধ্যে ভাবের বৈচিত্র্য লক্ষিত হয়।


‘উত্তর ফাল্গুনী’ কাব্যটি মূলত প্রেমমূলক। এই প্রেম ভাবনার মধ্যে রোমান্টিক স্বপ্নচারিতা এবং আদর্শস্নাতি দৃষ্টি নিয়ে আমর অমৃত সন্ধানের প্রয়াস সুষ্পষ্ট। এই প্রেম যৌবনগত কবি চিত্তের আর্তি। এখানে আছে যেমন অতীত মিলনের রসোল্লাস, তেমনি ভবিষ্যৎ বিচ্ছেদের আশঙ্কা। তাই কোমল চিত্রের করুণ ব্যাকুলতা, কম্পিত প্রত্যাশা ও সরোদন মিনতিতে পূর্ণ এর অনেক কবিতা।


‘সংবর্ত’ কাব্যটি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত। কবির ভাষায়—“অথচ উক্ত যুদ্ধ যে ব্যাপক মাৎস্য ন্যায়ের অবশ্যম্ভাবী পরিণাম, তার সঙ্গে পরবর্তী কবিতা সমূহের সম্পর্কে অকাট্য।” সুন্দরের প্রশস্তি রচনায় প্রস্তুত কবি। কিন্তু বিদেশী শত্রুর আক্রমণে মানবজাতীর আকুল আর্তনাদে বিচলিত ক্ষুব্ধ কবি ভগবানের অদৃশ্য নীরবতা দেখে প্রশ্ন করেছেন—

“অদৃশ্য অম্বরে তবুও অদৃশ্য তুমি?”


‘দশমী’ কাব্যে স্থান পেয়েছে দশটি কবিতা। কবি জীবনের উপাত্ত্য পর্বে পৌঁছে বিগত মদমত্ত যৌবনের কথা ভাবেননি, পরবর্তী জীবনের কোমল অনুভূতি-সজল মুহূর্তগুলি মনে করেছেন—প্রকৃতির সুধা পান করতে চেয়েছেন অথবা অনুভব করেছেন—“বিরূপ বিশ্বে মানুষ নিয়ত একাকী (প্রতীক্ষা)। পরবর্তী 'নৌকাডুবী' কবিতায় আছে এক উজ্জ্বল প্রাকৃতিক দৃশ্য : "খালি গোলা ঘরে সারা ভাঙা পুটি শুরু। পায়ে চলা পথে কে একাকী।" নৌকাডুবি প্রতীকে কবির বক্তব্য, জীবন মরণে পূর্ণ এবং মৃত্যু সামনে না আসা পর্যন্ত ব্যক্তি আপনার স্বরূপ চিনতে পারে না। ‘উপস্থাপনা' কবিতায় কবির তাই সশ্রদ্ধ স্বীকারোক্তি :

“আমি ক্ষণবাদী : অর্থাৎ আমার মনে হয়ে যায় 

নিমেষে তামাদী আমাদের ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ, তথা 

তাতে যার জের, সে সংসারও।


সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যের বৈশিষ্ট্য :

সুধীন্দ্রনাথের কাব্যের গঠনরীতি ধ্রুপদী। তার বিভিন্ন কাব্যের বিষণ্ণ বিধুর যন্ত্রণাময় প্রেমের কবিতাগুলি তীব্র নাটককীয়তায় মণ্ডিত, সেই সঙ্গে আছে সিম্ফমিন সঙ্গীতের প্রতি তুলনা। তাছাড়াও আছে ছন্দোগত বৈচিত্র্য। 'সংবর্ত' কাব্যের ভূমিকায় তিনি বলেছেন, তাঁর কবিতা যেন শব্দ ব্যবহারের পরীক্ষারূপে বিবেচনা করা হয়। তাঁর নিজের কথা—“মূল্যহীন সোনা হয় তব স্পর্শে, হে শব্দ অপসারী।” তার কবিতার নিত্য নব শব্দসজ্জার অভিনবত্ব সেটাই প্রমাণ করে।


সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যে পুরাণ প্রয়োগ :

সুধীন্দ্রনাথের কাব্যে মানব জীবনের হতাশা ও আর্তনাদ, নৈরাশ্যময় বেদনার প্রকাশ। কিন্তু তিনি কাব্যিক মুক্তির জন্য পুরাণের শরণার্থী। এখানে পৌরাণিক চরিত্র বা শব্দসমূহ তাঁর স্ববৈশিষ্ট্য ত্যাগ করে ভিন্নতর ব্যঞ্জনা ও বক্তব্যে উপস্থিত। যেমন বৈদেহী, ফাল্গুনী, ত্ৰিশংকু দ্বৈপায়ণ ইত্যাদি শব্দগুলি পুরাণ প্রসিদ্ধ অর্থে ব্যবহৃত না হয়ে নবতর ব্যঞ্জনায়, রূপান্তরিত হয়েছে। 'তন্মী' কাব্যের উনত্রিশটি কবিতার মধ্যে এগারোটিতে পুরাণ প্রসঙ্গ লক্ষিত হয়। এখানে ‘ঊর্বশী' রবীন্দ্রনাথের মতো বিশ্ব সৌন্দর্যের প্রতিমা নয়। কবির ব্যক্তিগত ভাবনায় পরিবর্তিত :

“আজকের তোমার চ্যুত বনের লীলাখেলা।

প্রাণে জাগায় অবহেলা।

ওই যে, তোমার পাণ্ডু বুকের কৃষ্ণচূড়া

মধ্যুতে তার নেই যে সুরা।

মর্মর প্রায় তোমার উরু আর না দহে

চুম্বনে হিম ঝিমিয়ে রহে।”


এছাড়া, অর্কেস্ট্রা কাব্য গ্রন্থে রাবণ, ইন্দ্র, ফাল্গুনী, শিব, মহাশ্বেতা, কালী ইত্যাদি পৌরাণিক চরিত্র নাম দেখা যায়।


কাজেই সব মিশিয়ে বলতে হয়, ভাব কল্পনায়, শব্দমস্থায়, আঙ্গিকের ও পুরাণের নবতম প্রয়োগে—সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা কাব্যে দ্বিতীয় বিহীন কবি শিল্পী।