'সবুজপত্র' পর্বে ছোটগল্পকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচয় দাও।

'সবুজপত্র' পর্বে ছোটগল্পকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচয়


পত্র-পত্রিকার চাহিদা না থাকলে লেখক জীবিকার তাড়নায় উদ্ভ্রান্ত না হলে একালের ছোটগল্প সাহিত্য এমন একটি স্বতন্ত্র শাখায় এভাবে পল্লবিত হত কিনা এবং তা কতদিন হতো এ সম্পর্কে যথেষ্ট সংশয় আছে। তবে বাংলাদেশে হিতবাদী পত্রিকা না এলে কবি নাট্যকার প্রাবন্ধিক ঔপন্যাসিক—সমালোচক রবীন্দ্রনাথ ক'টি ছোটগল্প লিখতেন তা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। ‘হিতবাদী'র তাগিদেই ত্রিশ বৎসর বয়সে তিনি প্রথম ধরলেন ছোটগল্পের কলম। ‘হিতবাদী’র পর ‘সাধনা’, ‘ভারতী’, ‘নব পর্যায়' বঙ্গদর্শনে চলল তার ছোটগল্পের নিঃশেষ ধারা, ১৩১৮ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত এ ধারাটি চলেছিলো। এরপর পত্র পত্রিকার তাগিদ না থাকার জন্য ছোটগল্প রচনার কিঞ্চিৎ বিশ্রাম মিলল। তার তিন বৎসর পর ১৩২১ বঙ্গাব্দে আত্মপ্রকাশ করল 'সবুজপত্র'। যার সাথে সাথে রবীন্দ্রনাথের গল্প সাহিত্যে শুরু হল দ্বিতীয় পর্যায়।


‘হিতবাদী-সাধনা-ভারতী' পর্বের ছোটগল্পের ভূমিপল্লী থেকে বেরিয়ে এসে ‘সবুজপত্র' এ মোটর মলা শহরে পথ ধরল। প্রথম যুগের শিল্পগুলিতে কবিকে বলা হয় গ্রামীণ। এই পর্বের তিনি নাগরিক। প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজপত্র’-এ তার মোট দশটি গল্প প্রকাশিত হয়। সেগুলি যথাক্রমে—হালদার গোষ্ঠী, (বৈশাখ-১৩২১), হৈমন্তী (জ্যৈষ্ঠ–১৩২২), বোষ্টমী (আষাঢ় (১৩২১), স্ত্রীর পত্র (শ্রাবণ), ভাইফোটা (ভাদ্র), শেষের রাত্রি (আশ্বিন), অপরিচিতা (কার্তিক), তপস্বিনী (জ্যৈষ্ঠ ১৩২৪), পয়লা নম্বর (আষাঢ়-১৩২৪), পাত্র-পাত্রী (পৌষ)।


উপরিউক্ত গল্পগুলির মধ্যে 'হালদার গোষ্ঠী’, ‘হৈমন্তী’, ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘পয়লা নম্বর’, গল্পগুলি রবীন্দ্র সাহিত্যে অমূল্য সম্পদ, ‘হালদার গোষ্ঠী' রবীন্দ্রনাথের তর্কাতীত এক সুমহান গল্প। এই গল্পের নায়ক বওায়ারীলালের মধ্যে একটি চিরকালীন সমস্যার ছায়াভাস ঘটেছে। শিল্পীর Ide alist সত্তার সঙ্গে পারিপার্শ্বিক বাস্তব জগতের স্থল লোকযাত্রা ও স্বার্থপরতার মধ্যে সে সংঘাত বাধে, এ গল্পটি তারই তির্যক আখ্যান। ‘দেনাপাওনা'র নিরুপমা আর ‘হৈমন্তী' গল্পের হৈমন্তীর মৃত্যুর মধ্যে সাদৃশ্য আছে। কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য গড়ে উঠেছে যুগ প্রভাবে। শিল্পী ও সুষমার অপমৃত্যু। বাঙালী মেয়ের ব্যর্থ বিড়ম্বিত জীবন তার কাছে ধরা দিয়েছে বার বার। হৈমন্তী গল্পেও তারই শিল্প-রূপের প্রকাশ। 'দেনাপাওনা’ অনাড়ম্বর সামাজিক গল্প। 'হৈমন্তী’ সৌন্দর্য আর স্থূলতায় ভাবগত দ্বন্দ্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। শিক্ষাব্রতীকালের প্রভাবে সে “নির্মল, ঋজু, সরল হইয়া উঠিয়াছে।” তা থেকে স্বার্থ কুৎসিত সংসারে—হৈম যে কিরূপ নিরতিশয় ও নিষ্ঠুর রূপে বিচ্ছিন্ন রহিয়াছে”—এই বেদনায় ‘হেমন্তী’ অশ্রু সজল। সুন্দরের সকরুণ অপঘাতে গল্পটি শেষ হয়েছে।


কিন্তু সবুজপত্রের আশ্রয়ে যুগ-সজাগ মন এখান থেকে একটি নতুন মোড় নিয়েছে। নারীর অন্তর বেদনা এবং তার প্রতিবাদ পাওয়া গেল ‘স্ত্রীর পত্রে’র মেজ বউয়ে এবং ‘পয়লা নম্বর’ এ অনিলায়। স্ত্রীর পত্র' এ গল্পের চেয়ে বক্তব্য প্রধান হয়ে উঠেছে। আক্রমণের কোথাও আবরণ নেই। হৈমন্তীর অবক্ষয়। মেজ বৌ স্বীকার করেনি। বিন্দুর বিড়ম্বিত জীবনে চরম দুর্ভাগ্যের মধ্যে তার আত্মদর্শন ঘটেছে। “আমি বিন্দুকে দেখেছি। সংসারের মাঝখানে মেয়ে মানুষের পরিচয়টা যে কি তা আমি পেয়েছি।” ‘স্ত্রীর পত্র’ এ রবীন্দ্রনাথের নাগরিক চাতুর্য ও বাক বৈদগ্ধ্যের যে পরিচয় মেলে ‘পয়লা নম্বর’ এ ও তা বর্তমান। Wit-এর দীপ্তিতে ঘন ঘন বিদ্যুৎ ঝলকিত। ইঙ্গিত সংকেত এমন গূঢ় ও মন্তব্যে এত ক্ষুরধার স্মার্ট গল্প বাংলা সাহিত্যে ‘চার ইসারী’র কথা ছাড়া আর লেখা হয়নি। চিত্রাঙ্গদা অর্জুনকে বলেছিলেন—“দেবী নহি, নহি আমি সামান্য রমণী।” 'পয়লা নম্বর' গল্পে অনিলার সেটি মর্ম কথা।


সব মিলিয়ে বলা যায়, 'সবুজপত্র' পর্বে পারিবারিক কাহিনী যুগ-প্রভাবের ফলে ব্যক্তি সাপেক্ষতা পার হয়ে বিস্তৃততর সামাজিক ব্যঞ্জনায় ব্যাপ্ত হয়েছে।