বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্পে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান ও কৃতিত্ব | বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্পে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিভা ও ভূমিকা

বাংলা ছোটগল্পে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান ও ভূমিকা


তারাশঙ্কর বেশ কয়েকটি উচ্চমানের ছোটগল্প লিখেছেন যাতে মানুষের আদিম প্রবৃত্তিজাত জীবনবোধ, তীব্র প্রাণপিপাসা, লোকায়ত জীবনচর্যা, সংস্কার ও সংস্কৃতি, ব্যক্তিমনের জটিলতা ও সমস্যা সংকট রূপ পেয়েছে। চরিত্রচিত্রণের দক্ষতা ও প্রকাশভঙ্গীর শিল্পময়তা তাঁর ছোটগল্পে আছে। নাটকীয় দ্বন্দ্ব-সংঘাত ক্রিয়া উৎকণ্ঠা এইসব গল্পকে করেছে আকর্ষণীয়। রবীন্দ্রনাথ তারাশঙ্করের ছোটগল্প সম্বন্ধে বলেছেন—“তোমার কলমে বাস্তবতা সত্য হয়েই দেখা দেয় তাতে বাস্তবতার কোমর বাঁধা ভান নেই। গল্প লিখতে বসে গল্প না লেখাটাকেই যাঁরা বাহাদুরি বলে মনে করেন তুমি যে তাদের দলে নাম লেখাওনি এতে খুশি হয়েছি। লেখার অকৃত্রিমতাই সবচেয়ে দূরূহ”।


তারাশঙ্করের প্রথম গল্প ‘রসকলি’ ১৯২৮ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত হয় ও পরের গল্প ‘হারানো সুর' প্রকাশিত হয় ২ মাস পরে 'কল্লোল' পত্রিকায়। 'রসকলি' বৈরাগী জীবনের পটভূমিকায় নেখা, এই গল্পে ঈর্ষা-বিদ্বেষ প্রীতি-অনুরাগময় প্রাণের উচ্ছল প্রবাহ আছে, সঙ্গে সঙ্গে প্রেমের মহিমাময় রূপও ফুটেছে মূলত মঞ্জরীর মধ্য দিয়ে। ‘অগ্রদানী’ গল্পে এক লোভী উদরপরায়ণ ব্রাহ্মণের উৎকট আহার লোলুপতার নিদারুণ পরিণামের কথা ব্যক্ত হয়েছে যখন সে অকালমৃত পুত্রের শ্রদ্ধে পিওভক্ষণ করে। 'জলসাঘর’ বিলীয়মান জমিদারতন্ত্রের ছবি শেষ রশ্মি আভায় অপরূপ দীপ্ত ও বিষণ্ণকরুণ জমিদার বিশ্বস্তর রায়ের মর্যাদা ও মহিমা অস্তিত্ব রক্ষার আপ্রাণ প্রয়াসে পতনের অস্তিম ক্ষণেও জ্বলে ওঠে। ভাগ্যের অভিশাপ ও অস্তিত্বের সংকট তার যে অনিবার্য পরিণাম ঘনিয়ে আনে সে মৃত্যুও যেন তাকে মহিমান্বিত করে।


‘আখড়াইয়ের দীঘি’ গল্পে নিষ্ঠুর নিয়তি আপন কৃতকর্মের রূপ ধরে আসে যখন খুনী ডাকাত কালী বাগদী অন্ধকার রাতে নিজের ছেলেকে পথিক ভেবে পাবড়া ছুঁড়ে তার ঘাড় মটকে তাঁকে মেরে ফেলে পয়সার জন্যে।


কুসংস্কার ও লোকবিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে লেখা ‘ডাইনী’ গল্পে বৃদ্ধা স্বর্ণকে লোকে মনে করে ডাইনী যার লোলুপ দৃষ্টিতে মানুষ মরে যায়। ডাইনী আখ্যাত সেই হতভাগিনী নারীর বুকের অসহ্য জ্বালা যন্ত্রণা দাহর রূপায়ণে লেখকের গভীর মানবতাবাদের পরিচয় পাওয়া যায়।


'সাড়ে সাত গণ্ডার জমিদার' গল্পে এক সর্বস্ব খোয়ানো জমিদারের আত্মমর্যাদা রক্ষার হাস্যকর প্রয়াস বেদনার উদ্রেক করে। নিজের প্রাণ বাঁচানোর আদিম জৈবিক তাগিদে তারিণী মাঝি জলমগ্ন হয়ে তার আদরের বৌ সুখীকে গলাটিপে সত্যা করে নিজেকে বাঁচায় 'তারিণী মাঝি' গল্পে। তারাশঙ্কর এভাবেই বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পকারের মর্যাদা পেয়েছেন।


তারাশঙ্করের সাহিত্যের বিশেষত উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য

সমগ্র আলোচনার পটভূমিকায় তারাশঙ্করের সাহিত্যের বিশেষত উপন্যাসের বৈশিষ্ট্যগুলি আমরা উল্লেখ করতে পারি—


  • আধুনিক উপন্যাসের তিনি শ্রেষ্ঠ পুরুষ, সমালোচকের ভাষায় তিনি ‘স্বরাজ্যে স্বরাট’।

  • তারাশঙ্করের উপন্যাসে প্রাচীন ও নবীনের দ্বন্দ্ব ও নবীনের জয়; যেমন—‘কালিন্দী’, ‘দুই পুরুষ’।

  • সামস্ততান্ত্রিক সভ্যতার অবসান ও ধনতান্ত্রিক সভ্যতার উদ্ভব; যেমন ‘জলসাঘর’, ‘কালিন্দী’।

  • তারাশঙ্করের রচনা বাংলার প্রাণকেন্দ্র গ্রামজীবনের মহাকাব্যিক রূপায়ণ, তাঁর সাহিত্য লক্ষ মানুষের পদসঞ্চারে প্রাণচঞ্চল, কলধ্বনিতে মুখরিত, জীবন ভাবনায় স্পন্দিত; যেমন— ‘গণদেবতা’, ‘পঞ্চগ্রাম’, ‘ভুবনপুরের হাট’।

  • আদিম অসংস্কৃত ও সম্প্রতিকালে প্রায় বিলীয়মান লোকজীবন ও সভ্যতার সার্থকতম রূপকার তারাশঙ্কর; যেমন—‘হাঁসুলী বাকের উপকথা’, ‘নাগিনী কন্যার কাহিনী'।

  • দেশপ্রেম ও স্বাদেশিকতার প্রকাশ; যেমন— ‘ধাত্রীদেবতা’, ‘নুটু মোক্তারের সাওয়াল’ (দুই পুরুষ)।

  • বাংলায় আঞ্চলিক উপন্যাসের শ্রেষ্ঠ লেখক, ‘ধাত্রীদেবতা’, ‘কবি’ সে পরিচয় দেয়।

  • মানবমনের যন্ত্রণা দাহ দ্বন্দ্ব-সংঘাত আবেগ-ব্যাকুলতা সার্থক শিল্পরূপ পেয়েছে; যেমন— ‘বিচারক’, ‘সপ্তপদী' প্রভৃতি উপন্যাসে।

  • সামাজিক অর্থনৈতিক সমস্যা সংকট অনেক গল্প উপন্যাসে রূপায়িত হয়েছে।

  • তারাশঙ্কর আঙ্গিকের নিপুণ শিল্পী। তার কাহিনী দ্বন্দ্ব-গতি-উৎকণ্ঠায় তীব্র অথবা কখনো এলায়িত বিস্তারিত যার মধ্যে বিপুল দেশকালে পরিব্যাপ্ত জীবন মহাকাব্যিক মহিমায় ধরা পড়ে। রোমান্টিক ভাব ব্যঞ্জনার পরিবর্তে তীব্র জীবনসত্য প্রকাশোপযোগী একটি কঠিন বস্তুধর্মী অথচ সংকেততির্যক ভাষা তিনি নির্মাণ করেছেন, 'ভাষার এই সাংকেতিকতার সাহায্যে তিনি এক ধূসর, উদাস, মরুভূমির ন্যায় জ্বালাময় ছায়ালেশহীন জীবন-প্রতিবেশ নির্মাণ করিতে সক্ষম হইয়াছেন।