বাংলা সাহিত্যে কৃত্তিবাসের অবদান | বাংলা সাহিত্যে কৃত্তিবাসের কৃতিত্ব ও ভূমিকা

বাংলা সাহিত্যে কৃত্তিবাসের অবদান


কবি কৃত্তিবাস:

কৃত্তিবাস বাঙলা ভাষায় আদি কবি না হলেও অনুবাদকদের মধ্যে আদি হতে পারেন। অসুবিধে এই—তার আবির্ভাব-কাল-বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা সম্ভবপর নয়। চৈতন্যদেবের জীবনীকার জয়ানন্দ তার চৈতন্যমঙ্গল' গ্রন্থে তাঁর নাম উল্লেখ্য করলেও, চৈতন্যদেব জয়দেব-বিদ্যাপতি-চণ্ডীদাস এবং মালাধর বসুর কথা বললেও তার নিকটতম প্রতিবেশী ফুলিয়া নিবাসী কৃত্তিবাসের উল্লেখ না করায় পণ্ডিতমহলে কৃত্তিবাসের প্রাচীনত্ব নিয়ে যে সংশয় দেখা দিয়েছে, তার নিরসন আজও হয়নি।


কৃত্তিবাসের জীবনী:

কৃত্তিবাসের রচনার অজস্র পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেলেও মাত্র একটিতেই কৃত্তিবাসের আত্মজীবনীমূলক কিছুটা অংশ পাওয়া যায়। কোন কোন পণ্ডিত-সমালোচক কৃত্তিবাসের আত্মবিবরণীকে জাল বলে উল্লেখ করলেও অপর প্রায় সকলেই এটিকে মেনে নিয়েছেন এবং এটিকে ভিত্তি করেই কৃত্তিবাসের কাল নিরূপণ করে থাকেন। এই আত্মবিবরণীতে কৃত্তিবাস তাঁর পূর্বপুরুষের বিবরণ, তার পঠন-পাঠনের বিবরণ এবং গ্রন্থ উৎপত্তির সূত্রও নির্দেশ করেছেন। বিবরণটি সংক্ষেপে এই-কৃত্তিবাসের পূর্বপুরুষ নরসিংহ ওঝা (নারসিংহ ওঝা) বেদানুজ বা দনুজ নামক-রাজার পাত্র (মতান্তরে পুত্র) ছিলেন। পূর্ববঙ্গে এক সময় বিপর্যয় দেখা দিলে তিনি গঙ্গাতীরে ফুলিয়া গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেন। এই বংশেই জন্ম গ্রহণ করেন কৃত্তিবাসের পিতা বনমালী, মাতা মালিনী কৃত্তিবাসের আরাে দুটি ভাই এবং একটি বােন ছিল। বার বৎসর বয়সে কৃত্তিবাস বড়গঙ্গা (পদ্মা) পার হয়ে উত্তর দেশে পড়তে গেলেন। ব্রহ্মাতুল্য গুরুর নিকট পাঠ সমাপন করে কৃত্তিবাস রাজপণ্ডিত হবার আশায় গৌড়ের রাজসভায় উপনীত হয়ে 'সাত শ্লোকে ভেটিলাম রাজা গৌড়েশ্বরে।


কৃত্তিবাসের আবির্ভাব-কাল:

এখানে শকাব্দের কোন উল্লেখ না থাকাতেই বিপত্তি ঘটেছে। মাঘ মাসের সংক্রান্তি, শ্রীপঞ্চমী তিথি ও রবিবার—এ রকম যােগাযােগ প্রতি শতাব্দীতেই কয়েকবার ঘটতে পারে। আর পূর্ণ- স্থলে পুণ্য' ধরলে মাঘমাসের যে কোন তারিখ হতে পারে—এতে মাস-বার ও তিথির যােগাযােগ অনেক বেশী হয়। এই সমস্যার সমাধান হতে পারে, যদি গৌড়েশ্বরের নামটি পাওয়া যায়। এখানেও বিপত্তি-নামের উল্লেখ নেই। সভাসদদের সকলেরই হিন্দু নাম থেকে অনেকেই অনুমান করেন যে এই গৌড়েশ্বর অবশ্যই কোন হিন্দু নরপতি হবেন। ১৪১৫-১৮ খ্রীঃ পর্যন্ত রাজা গণেশই একমাত্র হিন্দু রাজা, যিনি সুদীর্ঘকালের মধ্যে গৌড়ের সিংহাসনে আসীন ছিলেন। এ প্রসঙ্গে কেউ কেউ গণেশ-পুত্র যদু বা জালালুদ্দিন এবং অপর কেউ তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণকেই কৃত্তিবাস-কথিত গৌড়াধিপতি বলে মনে করেন। গৌড়ের সুলতান হােসেন শাহ যখন দারােগা ছিলেন তখন তার উর্ধ্বতন কর্মচারী শহর কোতােয়াল ছিলেন সুবুদ্ধি রায়। ডঃ সুকুমার সেন মনে করেন যে কৃত্তিবাসের তালিকায় যে সব সভাসদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এদের অনেকেই প্রথম জীবনে সুবুদ্ধি রায়ের সভায় বর্তমান ছিলেন পরে তারা হােসেন শাহ সুলতান হলে তারা সেই নবাবের গৌড় দরবারে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন। বস্তুতঃ এই মতারণ্য থেকে প্রকৃত সত্য উদঘাটন করা সহজ নয়। কৃত্তিবাস-প্রদত্ত সঙ্কেত-অনুসরণে আচার্য যােগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি যে সকল তারিখে বার মাস-তিথির যােগাযােগ সাধন করতে পেরেছে, তাদের মধ্যে ১৩২০ শকাব্দের (১৩৯৮-৯৯ খ্রীঃ) ১৬ই মাঘ রবিবার শ্রীপঞ্চমী তিথিটিকেই কৃত্তিবাসের জন্মদিন বলে অধিকাংশ পণ্ডিত মনে করে থাকেন। এই তারিখ গ্রহণ করলে রাজা গণেশের (১৪১৮ খ্রীঃ) দরবারে কৃত্তিবাসের উপস্থিতিকে মেনে নিতেও কোন অসুবিধে হয় না। ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন, ডঃ ভট্টশালী-আদি ঐতিহাসিক পণ্ডিতগণও এই তারিখের সপক্ষে মত। প্রকাশ করেছে। অপর কোন প্রবলতর প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত আমরা ১৩৯৯ খ্রীষ্টাব্দকেই কবি কৃত্তিবাসের জন্মতারিখ বলে গ্রহণ করবাে।


সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও দীপক মজুমদার এই দুই বন্ধু মিলে ওয়ার্ডওয়ার্থ ও কোলরিজের লিরিক্যাড ব্যালাথ এর মত এক কাব্যগ্রন্থ প্রকাশে সচেষ্ট হন। কিন্তু সিগনেট প্রেস প্রকাশন সংস্থার কর্ণধার দিলীপকুমার গুপ্তের পরামর্শে তা শুধুমাত্র কবিতার বই-এর আকারে প্রকাশিত না হয়ে আদি কবির নামে শুধুমাত্র অরুণতম কবিদের লেখা সংকলিত ‘কৃত্তিবাস’ এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালে। এই পত্রিকার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে প্রথম সংকলনের সম্পাদক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন—“কৃত্তিবাস বাংলাদেশের তরুণতম কবিদের মুখপত্র। একেবারে তরুণদের সার্থক না হলেও ভালো নতুন কবিতার গতিপথের একটা নিরিখ যাতে পাওয়া যায় সেই উদ্দেশ্যে তাদের কবিতা এতে একত্র করা হবে।”


কোনরকম প্রচার ছাড়াই কৃত্তিবাসের প্রথম সংখ্যা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই পাঠক সমাজে তা বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করে। এই পত্রিকার সুন্দর প্রচ্ছদ উন্নতমানের ছাপা এবং তরুণ লেখকদের মৌলিক কবিতাগুলির জন্য এটি হয়ে ওঠে উগ্র আধুনিকদের লড়াই এর হাতিয়ার। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছাড়াও সহযোগী সম্পাদক ছিলেন ফণিভূষণ আচার্য উৎপল কুমার বসু এবং প্রণব কুমার মুখোপাধ্যায়।


কৃত্তিবাস কবিতা সংখ্যা ছাড়াও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায়, কমলকুমার মজুমদার ও সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের গল্পসহ একটি গল্পসংখ্যা প্রকাশিত হয়। প্রথম দিকে এটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলেও পরে এটি মাসিক পত্রিকা হিসাবে প্রকাশিত হয়েছিল। যদিও তা অবার বার্ষিক পত্রিকা হয়ে যায়।


রাজনৈতিক ভেদাভেদ, মতাবার্থক বা অন্য কোনরকম দলাদলি এই পত্রিকার গতিস্তব্ধ করতে পারেনি। এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করে একটি গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল যা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করে অনেক উচ্চ মানের লেখক আত্মপ্রকাশ করেছে। যারা বর্তমানে বাংলা সাহিত্যের সম্পদ। এইসব লেখকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়, কবিতা সিংহ, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রণবেন্দ্র দাশগুপ্ত, শক্তি চট্টোপাদ্যায়, মোহিত চট্টোপাধ্যায়, তারাপদ রায়, আল মাহমুদ, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, উৎকলকুমার বসু সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, সিদ্ধেশ্বর সেন, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রাম বসু, অমিতাভ দাশগুপ্ত, অসীম রায়, জ্যোতির্ময় দত্ত, রমেন্দ্রকুমার আচার্য, চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মানস রায়চৌধুরী, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, তরুণ সান্যাল, দিব্যেন্দু পালিত, ফণিভূষণ আচার্য, রত্নেশ্বর হাজরা, নবনীতা সেন, বেলাল চৌধুরী, বিনয় মজুমদার, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, দেবারতি মিত্র, তুষার রায়, মতি নন্দী, শামসুর রাহমান, হায়াৎ মামুদ, লোকনাথ ভট্টাচার্য, নিমাই চট্টোপাধ্যায়, দেবাশীষ বন্দ্যোপাধ্যায়, বীতশোক ভট্টাচার্য, মণীন্দ্র ঘোষ, শিবশম্ভু পাল, সন্তোষ কুমার ঘোষ প্রমুখ।


পত্রিকার প্রথম সংকলনে প্রকাশিত হয় শঙ্খ ঘোষের ‘দিনগুলি রাতগুলি'। তৃতীয় সংকলনে প্রকাশিত হয় শঙ্খ ঘোষ কর্তৃক বিষ্ণু দে-র রেখেছি কোমল গান্ধার' কাব্য সংকলনের সমালোচনা। প্রেমেন্দ্র মিত্রের নবীন লেখকদের সম্বন্ধে মূল্যবান মন্তব্য সম্বলিত চিঠি প্রকাশিত হয় অষ্টম সংকলনে। একাদশ সংকলনে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার 'বুদ্ধদেব বসু ও উত্তরকাল’ প্রবন্ধে বুদ্ধদেব কিভাবে তার উত্তরকালকে প্রভাবিত করেছেনে তা পরিচয় দিয়েছেন, পঞ্চদশ সংকলনে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী রবীন্দ্র চর্চা, বুদ্ধদেব বসু, শীর্ষক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের উপর লেখা বুদ্ধদেব বসুর একটি ইংরেজি প্রবন্ধকে কেন্দ্র করে বাদানুবাদের পটভূমিকাকে তাঁর চমৎকার সিদ্ধান্ত জ্ঞাপন করেছেন। পঞ্চবিংশ সংকলন-এর 'কৃত্তিবাসের রামায়ণ' প্রবন্ধে যা যথার্থ। কৃত্তিবাসের এক বছর পূর্তিতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার 'কৃত্তিবাসের এক বছর' শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন এক হিসেবে কৃত্তিবাসের মূল ঐতিহাসিক কারণ এখানে ভবিষ্যৎ বাংলা গতিপথের চিহ্ন রইল।'


পরিশেষে বলা যায় কৃত্তিবাস পত্রিকা শুধুমাত্র একটি লিটল ম্যাগাজিন নয় একটি প্রতিষ্ঠান। এই পত্রিকা বহু তরুণ কবিদের কবিতা রচনা ও তাদের প্রতিষ্ঠার পথকে সুগম করেছে এই ঐতিহাসিক সত্যটিকে ভুললে হবে না।


এই পত্রিকার পঞ্চাশ বৎসর পূর্তি উপলক্ষে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়েছেন, “কৃত্তিবাস একটু উচ্চকণ্ঠ ছিল ঠিকই, আমাদের দুঃসাহস ও স্পর্ধা একটু বেশি পরিমাণেই প্রকাশ পেয়েছে, ব্যক্তিগত কবিতার নয়, পত্রিকার দলবদ্ধতায় এবং এই হৈ-চৈ-এর ফলে তরুণ সমাজের মধ্যে কবিতার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে—একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। বাংলা কবিতা কৃত্তিবাসের জন্মের ঠিক আগের কয়েক বছর রক্তাল্পতায় ভুগছিল। কৃত্তিবাস যে একটা জোয়ার আনতে পেরেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই হিসেবে কৃত্তিবাস একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করতে পেরেছে।


লিটল ম্যাগাজিনের ইতিহাসে কৃত্তিবাস পঞ্চাশ বছর অতিক্রম করে তার অপ্রতিহত গতিকে উজ্জ্বল করে তুলেছে।