বাংলা ছোটগল্পে প্রভাত কুমারের অবদান ও কৃতিত্ব | বাংলা ছোটগল্পে প্রভাত কুমারের প্রতিভা ও ভূমিকা

বাংলা ছোটগল্পে প্রভাত কুমারের অবদান


বাংলা ছোটগল্পের জগতে প্রভাতকুমার এক স্মরণীয় পুরুষ। তাঁর এই স্মরণীয়তার কারণ একাধিক। প্রথমত, বাংলা গল্পের সীমা প্রসারণ। দ্বিতীয়ত, বহু স্বভাবের মানুষ আমদানী – তাদের সামাজিক এবং ব্যক্তিসত্তার যথানুপাতি রূপদান, তৃতীয়ত, হাস্যরসের অফুরন্ত উৎস সৃষ্টি, আর সর্বশেষে বলা যায়—গল্প পাঠককে আকর্ষণের সহজাত নিপুণতা। প্রভাত কুমারের সামগ্রিক গল্প গ্রন্থের সংখ্যা বারো, গল্পের সংখ্যা একশো আটটির মতো। তার গাল্পিক সাফল্যের কারণ গল্প রচনার সহজাত ক্ষমতা এবং ঘটনা সংস্থানের সুকৌশল বিন্যাস ও কৌতুকের স্নিগ্ধ নির্ঝরে তার গল্প মনোগ্রাহী। আম-জাম-শিমুল-পলাশের ছায়ার তলা দিয়ে তাঁর গল্প গ্রন্থ ছোট নদীর মতো প্রবাহিত। তাতে রবীন্দ্রনাথের পদ্মার দার্শনিক বিস্তৃতি নেই, কখনো কখনো বান হয়তো ডাকে—কিন্তু পদ্মার মতো দুকূল প্লাবিত রুদ্রতা তাঁর মধ্যে নেই, নভোচারী কল্পনা বা সুতীক্ষ্ণ অনুভবের আলোকে অন্তরের অন্ধকার সরণীতে পদক্ষেপ করেননি, তবু ছোটখাটো বিষয়গুলির সাহায্যে Climax সৃষ্টি করে ভাষার ঈশিত্ব ও প্রসাদ গুণে তার গল্পগুলি সর্বজন ‘হৃহৃদয় সংবেদ্য' হতে পেরেছে।


ছোটগল্পে প্রভাত কুমারের গল্পগ্রন্থ :

প্রভাত কুমারের সামগ্রিক গল্পগ্রন্থের সংখ্যা ১২টি এবং গল্পের সংখ্যা ১০৮টির মতো। তার গল্পগ্রন্থগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল— (১) ‘নবকথা’ (১৮৯৯) (২) 'ষোড়শী' (১৯০৬) (৩) দেশী ও বিলাতী' (১৯০৯) (৪) ‘গল্পবিথী’ (১৯১৩) (৫) ‘পত্ৰপুষ্প’ (১৯১৩৭) (৬) 'যুবকের প্রেম' (১৯২৮) (৭) নতুন বউ (১৯২৮) (৮) জামাতা বাবাজী (১৯৩১) (৯) গহনার বাক্স ও অন্যান্য গল্প ১৯২১ (১০) হতাশ প্রেমিক ও অন্যান্য গল্প (১৯২৩) (১১) বিলাসিনী (১৯২৬) (১২) গল্পাঞ্জলী (১৯১৩)


প্রভাত কুমারের এইসব গল্পগুলির মধ্যে আকাশচারী কল্পনা বিলাস নেই। নেই ঘটনার ঘনঘটা সেখানে আছে কেবল আমাদের বাস্তব জীবনের সুখ-দুঃখ মিলন, বিরহ, হাসিকান্নার পোষ-ফাগুনের পালা। আর এখানেই প্রভাত কুমার তাঁর ছোটগল্পের জন্য শ্রেষ্ঠত্বর দাবী রাখতে পারেন।


প্রভাত কুমারের ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য :

ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য বিষয়ে প্রভাত কুমার নিজেই বলেছেন—“ছোটগল্পে চরিত্র বিকাশের স্থান নাই। বর্ণিত চরিত্র বিকশিত ভাবেই পাঠকের সম্মুখে উপস্থিত করা এবং ঘটনাটির সঙ্গে সে চরিত্রের সামঞ্জস্য বিধান করিয়া দিতে পারিলেই লেখকের কার্য সম্পন্ন হইল।” এই ধারা অবলম্বন করে তিনি গল্প লিখতেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় তার গল্পগুলি— “হাসির হাওয়ায়, কল্পনার ঝোকে পালের উপর পাল তুলিয়া একেবারে হু-হু করিয়া ছুটিয়া চলিয়াছে, কোথাও যে কিছুমাত্র ভাব বা বাধা আছে তাহা অনুভব করিবার জো নাই।”


প্রভাত কুমারের ছোটগল্পগুলির জনপ্রিয়তার কারণ এবং সমগ্র গল্পগুলিকে সঠিক পর্যালোচনার নিমিত্তে বিভিন্ন বিভাগে এমনভাবে বিভাজিত করা যেতে পারে—


ছোটগল্পে প্রভাত কুমারের কৌতুকময়তা :

কৌতুক আর রঙ্গ wit আর Fun প্রভৃতি কুমারের ছোটগল্পের মূল্যবান অভিজ্ঞান। শ্লেষমা কলেও জীবন ও জীবনাতীত সম্বন্ধে অম্লাক্ত তির্যকতা যেখানে বিরল দৃষ্ট। আবার ত্রৈলোক্যনাথের মতো অদ্ভুত কল্পনা ও রূপকের ইন্দ্রজাল ইন্দ্রধনুচ্ছটায় আচ্ছন্ন হয়নি তার গল্পজগৎ। তিনি শান্ত, স্নিগ্ধ, সংযত, আত্মতৃপ্ত, তার কৌতুকের গল্পের কোষাগারের মধ্যে ‘প্রণয় পরিণাম, বলরাম জামাতা মাষ্টার মহাশয় বিবাহের বিজ্ঞাপন, রসময়ীর রসিকতা, অদ্বৈতবাদ ইত্যাদি উল্লেখ্য সম্পদ। প্রণয় পরিণামে চোদ্দ বছরের স্কুলে পড়া মানিকলালের সঙ্গে এগারো বছরের কুসুমের প্রেমে পড়ার উপভোগ্যময় কাহিনী। 'বলরাম জামাতায়' নবনীত কোমল দেহ নলিনীর ব্যায়াম চর্চায় নিজেকে বলশালী করার প্রয়াস, বিবাহের বিজ্ঞাপনে জুয়াচোরের জালিয়াতিতে বিবাহ রসিক রাম অবতারের দুর্গতি। রসময়ীর রসিকতায় কলহ ক্রন্দন্ধনা বনচণ্ডী স্ত্রী রসময়ী মৃত্যুর পরেই স্বামীকে যন্ত্রণা দেবার অভিনব প্রয়াস অবশ্যই অপ্রত্যাশিত ও কৌতুককর। এছাড়া ‘যোকার কাণ্ড’, ‘কুড়ানো মেয়ে’, প্রমুখের মূল্য, মাতৃহীন' প্রভৃতি গল্পে হাস্যকৌতুকের উচ্ছ্বাসময় ফল্গুধারা নিত্য বহমান।


ছোটগল্পে প্রভাত কুমারের সমাজচেতনা :

সমকালীনতা প্রভাত কুমারের গল্পের অন্যতম লক্ষণ, বলাবাহুল্য তার জনপ্রিয়তার একটি অন্যতম কাণ্ডের মধ্যে নিহিত। পরিবর্তিত সমাজের মধ্যে বিচরণশীল বর্তমান কালের মানুষ অনেক কৌতুহলোদ্দীপক সামাজিক রীতিনীতির সেকালীন যুগের অনেক খবর তার গল্পে পেতে পারেন। যেমন—বসয়ময়ী বাসকর্তায় মোহনবাবুর পরিচয়—“মাথায় ঝাকড়া চুল মুখমণ্ডল প্রচুর গোঁফ দাড়িতে আবৃত, হাতে বড়ো বড়ো নখ, এক কথায় লোকটি থিয়োসফিষ্ট।” ‘পোষ্টমাস্টার’ গল্পে বিমলনের পদোন্নতির বিবরণের সরকারী শাসনের বিরুদ্ধে শ্লেষ : “বিমল আত্মপ্রাণ তুচ্ছ করিয়া সরকারের টাকা রক্ষা করিতে চেষ্টা করিয়াছিল, এই বিশ্বাসে সদাশম গভর্নমেন্ট তাহাকে ইন্সপেক্টর পদে উন্নীত করিয়াছিলেন।” ‘কাশিবাসিনী’ গল্পে ‘মাসিক ভাড়া ৩০ টাকায় পাওয়া ভাড়া বাড়ির ছবি আছে, আছে ‘আদরিণীতে’ জয়রাম মোক্তারের “মাসিক তের সিকায় একটি বাড়ী ভাড়ার কথা। ‘কুড়ানো মেয়ে’ গল্পে শুনি চারসের চালের মূল্য ছিল চার আনা। অনুরূপ— গহনার বাক্স, অঙ্গহীনা, বসবাস জামাতা প্রভৃতি গল্পকারের সমাজচেতনা অত্যন্ত সুপ্রকট।


ছোটগল্পে প্রভাত কুমারের বাস্তবচেতনা :

প্রভাত কুমারের গল্পের সর্বত্র রূঢ় বাস্তবের তাপ ও ভাপ না থাক আছে জীবনের উত্তাপ, চরিত্রেরা আমাদের চেনা মানুষ একেবারে নিকটতম প্রতিবেশী, পটলডাঙা, বেনেটোলার মেসবাসী কলেজের ছাত্র, হেদো বিডন গার্ডেনের বিবরণকারী পেনসন ভোগীবৃন্দ চিৎপুরের জ্যোতিষী, মফঃস্বল আদালতের মোক্তার, নিঃসঙ্গ বিকৃত সুখান্বেষী পোষ্টমাস্টার, পুজোপলক্ষে শ্বশুর বাড়ী যাত্রী জামাই, পর্যটক বাজীকর, কাশীবাসিনী বিধবা, লণ্ডনের ল্যান্ডডৌ ইত্যাদি রকমারী মানুষ তাঁর সৃষ্টির আসরে নির্বিচারে উপস্থিত। বাস্তবতার সপক্ষে গল্পকার নিজেই স্বীকারোক্তি দিয়েছেন: “ঘটনাটি এমন হওয়া চাই যাহাতে পর্দায় পর্দায় চরিত্রটির সঙ্গে মিলিয়া যায়। অথচ তাহার কোন অংশ নিরর্থক পড়িয়া না থাকে, ঘটনা ও চরিত্র যদি জমাট না বাঁধিল তাহা হইলে দুই-ই বিফল” আবার অদ্বৈতবাদ, হীরালাল, দেবীর মতো রিয়ালিস্টিক ধাঁচের উজ্জ্বল গল্প সেন লিখেছেন, তেমনি আদরিণীতে মৃত্যুতে মাতৃহীন গল্পের বেদনায় ঘটনার বাস্তবতা চিত্ত স্পর্শ করে। এই জমাট বাধার জন্য দেখা যায় তাঁর গল্পে আছে আকস্মিকের বিস্ময়বোধ, কথারসের মনোময় সুন্দরতা। প্রকৃতপক্ষে ঘটে যা তা সত্য নয়—যা ঘটা উচিত ছিল ঘটলে জীনের পরিণতি হয়ে ওঠে সুখান্ত প্রভাত কুমারের আগ্রহ সোদকেই।


ছোটগল্পে প্রভাত কুমারের ট্র্যাজেডি :

রচয়িতার মানসিকতা যে কতদূর ট্র্যাজেডি সম্বন্ধে সচেতন ছিল তার পরিচয় পাওয়া যায় 'দেবী' গল্পটি দিয়ে নবকথা গল্পগ্রন্থটির উপসংহারে অনিচ্ছা দেখে—“দেবী Tragedy উহাকে একেবারে শেষ গল্প করা সঙ্গত মনে করি না।” গল্পকারের পাঠক মনের সহনশীলতা সম্পর্কে উদ্বেগও হয়তো এই সিদ্ধান্তের আড়ালে নিহিত, তার করুণরসাত্মক গল্পগুলির মধ্যে ‘কাশীবাসিনী’ আদরিণী ও দেবী গল্পগুলি যেন শতনারীর মণিরত্ন স্বরূপ। ‘এক বিন্দু নয়নের জল' গল্প তিনটির মধ্য দিয়ে যেন মূর্ত। 'কাশীবাসিনী’তে পদস্খলিতা জননীর মর্মবেদনা ও প্রায়শ্চিত্য প্রয়াসের ছবি লেখকের গভীর ও নিবিড় সমবেদনার দ্যোতক, প্রতিভা নারীর অন্তর বেদনার মধ্যে মধ্যে যে সৌন্দর্য মাধুর্য ও পবিত্রতার ছবি প্রতিফলিত তাতে মনে পড়া স্বাভাবিক রবীন্দ্রনাথের বিচারক গল্পের ক্ষীরোদার কথা। '‘আদরিণী' পারিবারিক নাম—একটি সস্নেহ কোমলতা যেন নামটির সঙ্গে সঙ্গে বিজড়িত, আদরিণী জয়গোপাল মুখুজ্যের সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের প্রতীক। আদরিণীতে—শরত্চন্দ্রের মহেশ গল্পের ছাপ থাকলেও সেই ব্যাপ্তি নেই, তবে গৃহপালিত পশুর প্রতি মমতার রসমোচনে এবং জয়রামের একান্ত দুঃখাত্মক পরিণামে সময় সাগর পেরিয়ে তা আজও পাঠক মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। প্রভাত সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রত্ন ‘দেবী’ গল্পটি। গল্পটির পরিকল্পনার লেখক রবীন্দ্রনাথের কাছে ঋণী, শ্বশুর কালী কিঙ্করের স্বপ্নাদেশের বিশ্বাসে মানবী দয়াময়ীর দেবীত্বে, রূপায়ণ ও অবশেষে দেবীর আত্মহত্যায় কাহিনীর যবনিকাপাত অবশ্যই অশ্রু ভাবাতুর মানব রসে হৃদয়গ্রাহী, গল্পটির সর্বতোমুখী শৈল্পিক প্রতিভা এটাই প্রমাণ করে যে আর একটু আত্মস্থ ও সাধন নিষ্ঠ হতে পারলে তার সে হাত জলতরঙ্গ বাজাতে অভ্যস্ত, তা মৃদঙ্গে মৃদু বোল তুলতে পারতো।


তাই সুপ্রচুর ও সহজ সরল গল্প লিখে বাঙালী পাঠকের মনোলোকে প্রভাত কুমার চিরস্মরণীয় হয়ে উঠেছেন। তার আসন দখল একরম প্রায় অসম্ভব। কেননা বর্তমান যুগের লেখকরা পাঠকের কাছে যাঁরা নগ্ন জিজ্ঞাসা ও উগ্র ব্যক্তিত্বের প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে উপস্থিত, তাঁদের শক্তি অবশ্যই শ্রদ্ধার্হ, কিন্তু সংস্কার ভাঙা স্পষ্টতা এবং সমস্যার তিক্ততা সাধারণ মানুষের অবোধ্য। তাই তাঁরা পূজা পান—কিন্তু সত্যোৎসারিত প্রেম সহজে উদ্ভাসিত হয় না। এই প্রীতিলাভ করতে গেলে যে শান্ত, স্থির, স্নেহকোমল, কিছুটা সংরক্ষণশীল এবং সহজ প্রিয়ংবদ হওয়া প্রয়োজন—প্রভাত কুমারই তার শেষ উত্তরাধিকারী। বর্তমান যুগের লেখকদের তা পেতে হলে কালাতিক্রমের মধ্যে পদক্ষেপ করতে হবে। প্রভাতকুমারের গল্পে টুর্গেনিভের কাব্য ব্যঞ্জনা নেই, নেই এসিল জেলার মর্মপীড়া, অথচ চলমান জীবনের সৌরভকে, দিনানুদৈনিক অনুভূতিকে অনুভব করে তিনি তার হুবহু স্কেচ এঁকেছেন। রবীন্দ্রনাথের মত প্রভাত কুমারও উত্তর সূরীদের কাছে অফুরন্ত প্রেরণার উৎস।