বাংলা মহাকাব্যে নবীনচন্দ্রের কৃতিত্ব | বাংলা মহাকাব্যে নবীনচন্দ্রের অবদান

বাংলা মহাকাব্যে নবীনচন্দ্রের অবদান কৃতিত্ব


বাংলা কাব্যের যে ক্লাসিক মহিমা মাইকেল মধুসূদন গড়ে তোলেন তাকে অনুসরণ করা বা তার উত্তরাধিকার বহন করার মতো ক্ষমতাসম্পন্ন কবি ছিলেন না হেমচন্দ্র কিংবা নবীনচন্দ্র সেন। তবু মধুসূদনের পরে ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই দুই কবিই জনপ্রিয় হয়েছিলেন। ডঃ সুকুমার সেন লিখেছেন—“এমন একসময় ছিল যখন নবীন চন্দ্রকে কাব্যমোদীরা হেমচন্দ্রের প্রতিযোগী তো বটেই তার চেয়ে বড়কবি বলে মনে করতেন।” বস্তুত নবীনচন্দ্রই বাংলা মহাকাব্যধারার শেষ কবি। বাংলাদেশের এই শিক্ষিত যুবক কলকাতায় এসেই নানা বিখ্যাত পত্র-পত্রিকায় গীতিকবিতা লিখে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। নিতান্ত বাল্যকাল থেকেই নবীনচন্দ্র এই জাতীয় কবিতা লিখছিলেন। মহাকাব্য রচনা করলেও নবীনচন্দ্রের কবি প্রতিভা মূলত গীতিকবির। গীতিকবি সুলভ ভাবাবেগের ঐশ্বর্য ও রোমান্টিক কল্পনার প্রসাদ তিনি পেয়েছিলেন। কিন্তু ভাবাবেগের প্রকাশে সংযমের অভাব তার কবিধর্মের প্রধান ত্রুটি ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর আর কোন কবির কাব্যে কবির ব্যক্তিগত জীবনের প্রায় সরাসরি প্রতিফলন এভাবেই লক্ষ্য করা যায় না। গীতিকবির কাবধর্ম নিয়েও মধুসূদনের প্রভাব এড়াতে না পারায় হাকাব্য রচনা করেছেন। মহাকাব্যের গাম্ভীর্যপূর্ণ ব্যঞ্জনা লিরিকের তরল স্রোতে ভেসে গেছে।


নবীনচন্দ্র সেনের প্রথম যৌবনে লেখা গীতিকবিতাগুলি সংকলিত হয়েছে ‘অবকাশ রঞ্জিনীর’ দুই খণ্ডে (১৮৭১-১৮৭৮), এর কবিতাগুলিতে যথার্থই গীতিকবিতার বৈশিষ্ট্য ধরা পড়েছিল।

“নিবুক নিবুক প্রিয়ে দাও তারে নিবিবারে

আশার প্রদীপ।

এই তো নিবিতে ছিল কেন তারে উজলিলে

নিবুক সে আলো, 

আমি ডুবি এই পারাবারে।”

কিন্তু নবীনচন্দ্রের প্রতিভায় গীতিকবির ঐশ্বর্য থাকলেও সংযমের অভাবে সে প্রতিভাকে তিনি পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারেননি।


নবীনচন্দ্রের প্রথম আখ্যানকাব্য ইংরেজ কবি বায়রনের ধরনে লেখা এবং স্পেনসারের স্তবক রীতিতে পাঁচ সর্গে বিভক্ত ‘পলাশীর যুদ্ধ' (১৮৭৫)। এই আখ্যানকাব্যই নবীনচন্দ্র সেনকে প্রথম জনপ্রিয়তা এনে দেয়। অমৃতবাজার পত্রিকায় সম্পাদক মতিলাল ঘোষের প্রভাবে ইতিহাস মিশ্রিত স্বাদেশিক আখ্যানকাব্যটি রচনা করেন। তরুণ বয়সের এই রচনায় কবি ইতিহাসকে যথাযথ ব্যবহার করতে পারেননি। ইতিহাসের এই পরিচিত ঘটনার বর্ণনায় ইতিহাস অপেক্ষা দেশপ্রেমের আবেগতাড়িত কল্পনাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। বস্তুত হেমচন্দ্রের মতো রাজনৈতিক বুদ্ধির সতেজ প্রবর্তনা নবীনচন্দ্রে কবিমানসে ছিল না। গীতিকবির উচ্ছ্বাস বা অনিয়ন্ত্রিত কল্পনা ও হৃদয়াবেগই তাঁকে চালিত করেছিল। ইতিহাসের বস্তুনত্যও কল্পনার কাব্যসত্যকে মেলাতে না পারায় ‘পলাশীর যুদ্ধ’ প্রথম শ্রেণীর ঐতিহাসিক কাব্য হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু পাঠ্যপুস্তক হিসাবে ব্যবহৃত হওয়ায় কবির জনপ্রিয়তা বাড়ে। নীবনচন্দ্র সেনের অন্য দুটি আখ্যানকাব্য – (ক) 'ক্লিওপেট্রা' ও (খ) 'রঙ্গমতী' (১৮৮০)। 'ক্লিওপেট্রা'য় কবি বিশেষ কোন প্রতিভার সাক্ষর রাখতে পারেননি। রঙ্গমতী কাল্পনিক রোমান্টিক দেশপ্রেমের কাহিনী। ‘পলাশীর যুদ্ধে’ পরিচিত ইতিহাস থাকায় পাঠক সমাজে তা গৃহীত হয়েছিল, কিন্তু ‘রঙ্গমতী' সম্পূর্ণ কাল্পনিক দেশপ্রেমের আবেগ উচ্ছ্বাস হওয়ায় তার দ্বারা নবীনচন্দ্র কোন খ্যাতিই পাননি।


নবীনচন্দ্র সেন মহাকাব্য রচনায় হস্তক্ষেপ করেন প্রৌঢ় বয়সে। তাঁর তিনটি পৌরাণিক আখ্যানকাব্য মহাকাব্যের পটভূমিকায় রচিত হওয়ায় ‘রৈবতক’ (১৮৮৭) 'কুরুক্ষেত্র’ (১৮৯৩) এবং ‘প্রভাস’ (১৮৯৬) কে একত্রে ত্রিয়ী মহাকাব্য’ বলা হয়। কৃষ্ণের জীবনকথাই এই তিনটি কাব্যের অবলম্বন। মহাকাব্যের বিস্তৃত পটভূমিকে নেওয়া হলেও নবীনচন্দ্র আদর্শ মহাকাব্যের ধর্মরক্ষায় সফল হননি। দীর্ঘ চৌদ্দ বছর ধরে কবি এই মহাকাব্য সমাপ্ত করেন। নানা ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও এই কাব্যে কবির কতকগুলি মৌলিক পরিকল্পনা ছিল। তিনি ক্ ওকে ভগবান বা অবতার রূপে না এঁকে শ্রেষ্ঠ গুণসম্পন্ন মহামানব রূপে আঁকতে চেয়েছেন। আধুনিক ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান, নীতিশাস্ত্র, সমাজ ও রাষ্ট্রনীতির আদর্শে কৃষ্ণকে গড়তে চেয়েছেন।


ডঃ অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন—“কৃষ্ণাক দিয়ে তিনি ভার্ব ভারতের রাজনৈতিক সামাজিক ও ধর্মীয় ঐক্য প্রচার করে নিয়েছেন।” অনেকে এর মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণচরিত্রে’র প্রভাবকে লক্ষ্য করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র নিজে অবশ্য নবীনচন্দ্রের প্রশংসা করেননি।


তিনি বলেন, “লোকে কবিকে নিন্দাই করবে। তারা বলবে, কবি এই তিনখানি কাব্যে ঊনবিংশ শতাব্দীর মহাভারত; The Mahabharatha of the Nineteenth Century রচনা করেছেন।" পুরাণকেন্দ্রিক এই অভিনব আখ্যান কাব্যে রোমান্টিক নাটকীয় গুণ থাকলেও মহাকাব্যের বিশালতা, চরিত্র পরিকল্পনা ও ধ্বনি গাম্ভীর্য ফুটে না ওঠায় কোন ভাবেই মহাকাব্য হয়ে উঠতে পারেনি। আসলে রোমান্টিক গীতিকবির আত্মসর্বস্ব কল্পনা ঐশ্বর্য নবীনচন্দ্রের মহাকাব্যের প্রধান অন্তরায়।


নবীনচন্দ্রের অন্যান্য রচনাগুলির মধ্যে কয়েকটি মহাপুরুষের জীবনীকাব্য –‘খৃষ্ট’ (১৮৯১) ‘অমিতাভ’ (১৮৯৫) এবং ‘অমৃতাভে’ (১৯০৯) উল্লেখযোগ্য। খৃষ্ট, বৌদ্ধ এবং চৈতন্যদেবের জীবনী রচনা করতে চাইলেও ‘অমৃতাভে’ চৈতন্য জীবনী শেষ হয়নি। কিন্তু পাঁচ খণ্ডে সমাপ্ত ‘আমার জীবন' (১৩১৬-১৩২০) বাংলা আত্মজীবনী মূলক অমূল্য সম্পদ।


বাংলাকাব্যের গঠনপর্বের শেষ কবি নবীনচন্দ্র সেন। হেমচন্দ্র নবীনচন্দ্রেরা মদুসূদনের কাব্যধারাই অনুসরণের চেষ্টা করে গেছেন। তাতে কবিধর্মের দক্ষতা বিশেষ প্রমাণিত হয়নি বরং দুর্বলতাই ধরা পড়েছে। তথাপি স্বাজাত্যবোধের স্বদেশপ্রেমের উচ্ছ্বাসে হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্ররা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। নীবনচন্দ্রের কবি প্রতিভার আলোচনা করে ডঃ অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন—“মহাকাব্য রচনার পশুশ্রম না করে তিনি আরো কিছু গীতিকবিতা লিখলে বাংলা সাহিত্যের বিশেষতঃ আধুনিক গীতিকবিতার শ্রীবৃদ্ধিই হত।”