বাংলা সাহিত্যে শঙ্খ ঘোষ-এর অবদান ও কৃতিত্ব | বাংলা সাহিত্যে শঙ্খ ঘোষ-এর প্রতিভা ও ভূমিকা

বাংলা সাহিত্যে শঙ্খ ঘোষের অবদান ও স্থান


আধুনিক কাব্য জগতের ক্ষেত্রে শঙ্খ ঘোষ একটি বিশিষ্ট নাম। কবির আসল নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। জন্ম–বর্তমানে বাংলাদেশের চাঁদপুর গ্রামে ১৩৩২ খ্রিস্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি। শৈশব থেকেই প্রতিভার স্ফূরণ, দেশিয় সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও সাহিত্যের প্রতি ছিল গভীর টান। জন্মভূমি গ্রামের প্রতি ছিল গভীর ও অকৃত্রিম আকর্ষণ। উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য কবি চলে আসেন কলকাতায়। এখানে কবির স্পর্শকতার, অনুভূতিসম্পন্ন মন বার বার দোলায়িত হয়েছে তাঁর ফেলে আসা স্মৃতিমধুর গ্রাম বাংলার ঘাস, কাঁশ আর নদ-নদীর হাতছানিতে।


কবি ধর্মের বৈশিষ্ট্যে শঙ্খ ঘোষ অন্তর্মুখী। কবি হলেও তিনি কখনোই সামাজিক দায়ভার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেননি। সময় ও সমাজের যন্ত্রণাদায়ক প্রদাহে কবি—সর্বদাই জর্জরিত হয়েছেন। যন্ত্রনির্ভর যান্ত্রিক মন ও বিকারগ্রস্ত মানসের, ঘৃণ্য-হৃদয়ের নগ্নতায় কবি খুঁজে বেড়ান মুক্তির ছায়া সুনিবিড় বিতান। স্কুল শিক্ষক পিতা মনীন্দ্রকুমার ঘোষের মতোই শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। সাহিত্যরসের অমিয় সাগরে রস সন্ধানের অভিযাত্রী হিসেবে নিজেকে শুধু বাংলাভাষা ও সাহিত্যই নয়, বিদেশি সাহিত্যের রস আস্বাদন করেছিলেন। বিশেষ করে ইংরেজি সাহিত্যেও তাঁর অসাধারণ ব্যুৎপত্তি।


শঙ্খ ঘোষ তাঁর কবিতার ভাষাকে কখনোই অভিধানমুখী করে তোলেননি। সহজ কথা সহজ করেই বলার ভংগী তার প্রথম থেকেই করায়ত্ব। যেমন দেখেছেন তেমনি লেখার ক্ষমতা তার অসাধারণ মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ রবীন্দ্র-কথিত এই আপ্তবাক্যে তিনি চিরকাল স্থিত এক প্রাপ্ত সত্তা। মানুষের দুঃখ, শোক, যন্ত্রণা, হতাশা, স্বপ্নভঙ্গের প্রকাশে ব্যক্তিক অভীজ্ঞা মিশে গেলেও ব্যাষ্টি ছাড়িয়ে সমষ্টি চেতনায় উত্তরিত হয়েছেন। যার পরিণতিতে তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে সর্বজনীন, তিনি উত্তরিত হয়েছেন জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক স্তরে।


শঙ্খ ঘোষের কাব্যগ্রন্থ :

তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলি হল—'দিনগুলি রাতগুলি’ (১৯৫৬), ‘নিহিত পাতাল ছায়া' (১৯৬৭) 'এখন সময় নয়’ (১৯৬৭), ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা' (১৯৭০), ‘আদিম লতাগুল্মময় (১৯৭২), ‘মুর্খ বড়ো সামাজিক নয়’ (১৯৭৪) ‘বাবরের প্রার্থনা' (১৯৭৪), 'তুমি তো তেমন গৌরী নও' (১৯৬৭), 'পাজরে দাঁড়ের শব্দ' (১৯৮০), ‘প্রহর জোড়া ত্রিতাল' (১৯৮২), ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে' (১৯৮৪), 'বন্ধুরা মাতি তরজায়' (১৯৮৪), 'ধুম লেগেছে হৃৎকমলে' (১৯৮৭), 'লাইনেই ছিলাম বাবা’ (১৯৯৩), ‘গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ' (১৯৯৪), ‘শব্দের ওপরে শামিয়ানা' (১৯৯৭), 'ছন্দের ভিতের এত অন্ধকার' (১৯৯৯) প্রভৃতি।


শঙ্খ ঘোষ গদ্যরচনাতেও সমান পারদর্শী। বাংলা কবিতার ছন্দ নিয়ে তাঁর গবেষণামূলক গ্রন্থ রয়েছে। অসাধারণ বিদ্বান বলতে যে বোঝায় শঙ্খ ঘোষ তাই। রবীন্দ্রসাহিত্যেও রয়েছে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য। এ পর্যন্ত অনেকগুলি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন, তবুও এর মধ্যে উল্লেখ করতেই হয় ‘ধূম লেগেছে হৃৎকমলে' কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি 'রবীন্দ্র পুরস্কার' লাভ করেছেন ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে, আর 'বাবরের প্রার্থনা' কাব্যগ্রন্থের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার।


তাঁর লেখা গদ্যগ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য—'নিঃশব্দের তর্জনী’, ‘ছন্দের বারান্দা', ‘শব্দ আর সত্য’ ‘শব্দ নিয়ে খেলা', 'সকালবেলায় আলো’, ‘ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ’, ‘কালের মাত্রা ও রবীন্দ্র নাটক, ‘এ আমির আবরণ’, ‘নির্মাণ আর সৃষ্টি', 'কল্পনার হিস্টিরিয়া’, ‘জার্নাল’, ‘ঘুমিয়ে পড়া অ্যালবাম' প্রভৃতি।