বাংলা সাহিত্যে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অবদান ও কৃতিত্ব | বাংলা সাহিত্যে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের স্থান ও ভূমিকা

বাংলা কাব্য সাহিত্যে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অবদান কবিকৃতি


সুভাষ মুখোপাধ্যায় (১৯১৯) অসামান্য প্রতিভাসম্পন্ন কবি সঙ্গে সঙ্গে প্রখর রাজনীতি সচেতন সামাজিকও বটে। তাঁর কবিতায় নিপুণ শিল্পকর্মের সঙ্গে যথার্থ রাজনীতির অচ্ছেদ্য মেলবন্ধন স্থাপিত হয়েছে—রাজনীতির কঠিন জটিল বক্তব্যকে সৃষ্টির গৌরব ও নর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন কবি। তাঁর সাম্যবাদী জীবনদর্শন কবিতায় আনে উজ্জ্বল ও সংবেদনশীল প্রত্যয় ও দীপ্তি যা মানুষকে বিপ্লবী আদর্শে উজ্জীবিত করে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা এভাবেই হয়ে উঠেছে লড়াইয়ের শাণিত অস্ত্র সংগ্রামের ধারালো হাতিয়ার।


মৌলিক কবিতা, অনুবাদ কবিতা, উপন্যাসধর্মী রচনা, ভ্রমণ রিপোর্টাজ গদ্য অনুবাদ, শিশু ও কিশোর সাহিত্য— সব মিলিয়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রায় ষাটটি গ্রন্থ রচনা করেছেন যাঁদের মধ্যে সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতার নিশ্চিত সাক্ষর রয়েছে। ‘পদাতিক' (১৯৪০) দিয়ে তাঁর কাব্যসাধনা শুরু; তার অন্যান্য বিশিষ্ট কাব্যগ্রন্থ হল—'অগ্নিকোণ' (১৯৪৮), 'চিরকুট' (১৯৫০), 'ফুলফুটুক' (১৯৫৭), ‘যত দূরেই যাই’ (১৯৬২), ‘কাল মধুমাস’ (১৯৬৬), ‘ছেলে গেছে বনে’ (১৯৭২), 'একটু পা চালিয়ে ভাই’ (১৯৭৯) ইত্যাদি। তাঁর অনুবাদ কাব্যের মধ্যে আছে ‘নাজিম হিকমতের কবিতা’, ‘পাবলো নেরুদার কবিতাগুচ্ছ’, ‘হাফিজের কবিতা' ইত্যাদি। এক সমাজ সচেতন বিদ্রোহী কবি-মানসের শিল্পিত পরিচয় তাঁর কবিতায় অনশ্বর পরিচয় রেখে গেছে।


সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রথম থেকেই সাম্যবাদী আদর্শে বিশ্বাসী। তিনি কমিউনিষ্ট পার্টির সমর্থক ও সক্রিয় কর্মী ছিলেন। পার্টির জন্যই তিনি নিবেদিত প্রাণ। তাঁর কবিতায় তাই রাজনীতি প্রধান হয়ে উঠেছে যার মধ্যে আছে হৃদয়ের আবেগ ও শিল্পীর সংবেদনা। তিনি বলেছেন— “দরদটাকে মুখের বদলে বুকের মধ্যে এবং তাৎক্ষণিকের বদলে বরাবরের করে নেবার কাব্যটাই হবে রাজনীতির সত্তা আমার কবিতার সত্তা থেকে পৃথক ছিল না"।


সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পদাতিক’ থেকেই রাজনৈতিক ভাবনার বিস্ময়কর স্ফুরণ ঘটে। এই বই পড়ে বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন—‘বাঙালি কবির হাতেও কবিতা আর শুধু বীণা হয়ে বাজছে না, অস্ত্র হয়েও ঝলসাচ্ছে। সুভাষ মুখোপাধ্যায় রোমান্টিকতার বিরোধী ছিলেন, চাঁদ ফুটুক ইত্যাদিকে তিনি পরিহার করেছিলেন কারণ তা কেবল মিথ্যা মায়া নির্মাণ করে। তিনি বললেন—

“আকাশের চাঁদ দেয় বুঝি হাতছানি? 

ওসব কেবল বুর্জোয়াদের মায়া - 

আমরা তো নই প্রজাপতি - সন্ধানী!

অন্তত, আজ মাড়াই না তার ছায়া।”


কিন্তু রোমান্স তো হারায় না, তা মিশে থাকে মেহনতী মানুষের জীবনচর্যায় তার কান্না-ঘাম-রক্তের সঙ্গে—

চিমনির মুখে শোনো সাইরেন-শঙ্খ, 

গান গায় হাতুড়ি ও কাস্তে,

তিল তিল মরণেও জীবন অসংখ্য

জীবনকে চায় ভালবাসতে। (মে দিনের কবিতা—পদাতিক)


অন্নাভাব দুর্ভিক্ষ মন্বন্তর কবিকে ব্যথিত ক্রুদ্ধ করেছে। তিনি আগুনঝরা কণ্ঠে বললেন— 

“পেট জ্বলছে, ক্ষেত জ্বলছে

হুজুর, জেনে রাখুন

খাজনা এবার মাপ না হলে

জ্বলে উঠবে আগুন” (চিরকুট—চিরকুট)। 


কবি প্রেমকে অস্বীকার করেন নি। তবে এই প্রেম নরনারীর দেহনির্ভর নয়, নিছক রোমান্টিক কল্পনা বিলাসও নয়। এই প্রেমে আছে ঝড়ের মাতন আগুনের দাহ নিষিদ্ধ ইস্তাহারের বিপ্লব বার্তা, তাই মিছিলের একটি মুখ কবিকে উজ্জীবিত করে যায় নিষ্কোষিত তরবারির দীপ্তিতে অন্যায় পাপকে নির্মূল করে আর “সমস্ত পৃথিবীর শৃঙ্খলমুক্ত ভালবাসা/দুটি হৃদয়ের সেতুপথে/পারাপার করতে পারে।” (মিছিলের মুখ-অগ্নিকোণ)। রূপদক্ষ শিল্পীর নির্মাণ-কৌশলের পরিচয় বহন কব সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা।


পার্টির প্রতি আনুগত্য সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে নিষ্ঠাবান করেছে, সংগ্রামী ভাবনায় উদ্দীপিত করেছে, সর্বহারার মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠায় প্রণোদিত করেছে। কিন্তু আদর্শচ্যুতি কবি মেনে নেন নি, তাঁর বিশ্বাসের ভিত্তি শিথিল হওয়ায় তিনি সংগ্রামের পথ থেকে যেন দূরে সরে এসেছেন। তবু ক্লান্ত বিষণ্ণ পরিবেশে, মলিন মুমূর্যু শহরে, দুঃস্বপ্নের নগরী কলকাতায় লাল নিশান নিয়ে একদল মজুরের এক বিশাল মিছিল দেখে ধর্মতলায় ট্রাম ওমটির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লেনিন চিৎকার করে বললেন—

শতাব্দী শেষ হয়ে আসছে -

একটু পা চালিয়ে, ভাই, একটু পা চালিয়ে

(একটু পা চালিয়ে ভাই)

হায়! শতাব্দী শেষ হয়ে গেল, এল না নতুন দিন। বোধ হয় মিথ্যা হয়ে গেল 'কমরেড লেনিনের আহ্বান’!