অন্নদামঙ্গল কাব্যে সমাজ বাস্তবতা

অন্নদামঙ্গল কাব্যে সমাজ বাস্তবতা


বাংলা মঙ্গলকাব্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য অলৌকিক দেবমাহাত্ম্য কীর্তনের মধ্যেও লৌকিক বাস্তজীবনের বিশ্বস্ত চিত্রায়ন। আরাধ্য দেবদেবীকে সংসারের মঙ্গল ঘটে অধিষ্ঠিত করার কাব্য রচনা করতে গিয়ে মঙ্গল কবিদের সংসারমুখী মন বাস্তব সমাজের দুঃখময় ছবি এঁকেছে। ষোড়শ শতকের বাঙালি সমাজের এরূপ বিস্তারিত চিত্র এঁকেই কবিকংকণ মধ্যযুগের কবিদের মধ্যমণি হয়ে আছেন। শুধু চণ্ডীমঙ্গল কাব্য ধারায় নয়, অন্যান্য মঙ্গলকাব্যেরও গতানুগতিক বর্ণনায় এই সমাজচিত্রণের বিশেষ প্রবণতা অবশ্য লক্ষণীয় বিষয়। ভারতচন্দ্রের অন্নদা মঙ্গল কাব্যে বাস্তব সমাজজীবন অতি বিশ্বস্ততার সঙ্গে অঙ্কিত হয়েছে সে কথা বলাই বাহুল্য।


অন্নদা মঙ্গলকাব্যের সমাজচিত্র কেবল ধর্ম কলহ ও ধর্ম শৈথিল্যের আলেখ্যমাত্র নয়। এর ফাঁকে ফাঁকে একান্ত পার্থিব প্রয়োজনে সামাজিক জীবনেরও রেখাচিত্র কবি অঙ্কন করেছেন। কবির মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাবর্ণনা তার প্রথম নিদর্শন। ‘চারি সমাজের পতি' কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভা ছিলো তখনকার নবদ্বীপ কেন্দ্রিক বাঙালি সংস্কৃতির কেন্দ্র। সভায় একই সঙ্গে ঠাঁই পেয়েছেন কালিদাস, সিদ্ধান্তের মতো সংস্কৃত শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত, বিশ্রাম খাঁর মতো হিন্দুস্থানী সঙ্গীত বিশারদ ইত্যাদি। কৃষ্ণচন্দ্রের রাজ্যের বর্ণনা প্রসঙ্গে কবি জানিয়েছেন—

সপ্তদ্বীপ নামে ধন্য ধন্য জম্বু দ্বীপ। 

তাহাতে ভারতবর্ষ ধর্মের প্রদীপ৷

তাহে ধন্য গৌড় যাহে ধর্মের বিধান। 

সাধ করি যে দেশে গঙ্গার অধিষ্ঠান ৷৷

কিন্তু এত সাধের গৌড়বাংলার ভয়ানক বিপন্ন অবস্থা তখন বর্গীর নিষ্ঠুর আক্রমণে। নবাব আলিবর্দীর ভুবনেশ্বর লুণ্ঠনের পাপের প্রতি বিধান করতে এগিয়ে এলেন বর্গীরাজের সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিত—

“বর্গি মহারাষ্ট্র আর সৌরাষ্ট্র প্রভৃতি,

আইল বিস্তর সৈন্য বিকৃতি আকৃতি”

এমন অবস্থায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্র নিরূপায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ। তাই সাধারণ মানুষের দুর্দশার অন্ত রইল না। ধার্মিকেরও নয়। কেননা—

“নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়

বিস্তর ধার্মিক লোক ঠেকে গেল দায়॥”

অভাব ও দারিদ্র হল মানুষের নিত্য সঙ্গী।

‘কান্দিছে আপন শিশু অন্ন না পাইয়া। 

কোথায় পাইব অন্ন তোমার লাগিয়া ॥”


বর্গী আক্রমণে বিধ্বস্ত অর্থনীতির শিকার দরিদ্র ব্যক্তিদের বাস্তব আর্তনাদেরই এই প্রতিধ্বনি। কাজেই শিব ও অন্নপূর্ণার সংসারের যে ছবি এঁকেছেন কবি, সেখানে ও দেখা যায় নীরন্দ্র দারিদ্র্য। অন্নক্ষুধার যন্ত্রণায় অল্পেই ক্ষিপ্ত হল শিব এবং প্রচণ্ড ক্রোধে অগ্নি বর্ণ হয়ে উঠেন।

শিবের কঠিন কটূক্তি শোনা যায়—

কিবা শুভক্ষণে হইল অলক্ষণা ঘর। 

কুপিতা চণ্ডী এর কঠিন জবাব দেন— 

চণ্ডালের কপালে পড়ে নাম হৈল চণ্ডী।


নিছক দারিদ্র্যযুক্ত বাঙালি সমাজে দম্পত্য জীবনের এমন ঘনঘোর চিত্রর যে ফুটে উঠেছে তা বলাই বাহুল্য। এমন দারিদ্র কন্টকিত সমাজে ছিল প্রচুর যন্ত্রণা। বড় মানুষের অর্থাৎ রাজা জমিদারের বেগার খাটতে হোত শ্রমিক প্রজাদের, ভিক্ষাও করতে হতো। বিশ্বকর্মার প্রতি তাই ব্যাসদেবের উপহাসপূর্ণ বঙ্কিম অভিশাপ—

“তোর গুণধর, যত কারিগর  হইবে দুঃখী বেগার।”


কৌলীন্য প্রথা শাসিত সমাজে বহুবিবাহের নিদারুণ অভিশাপ, সতীন ঘর করার অসহনীয় জ্বালা ভোগ করতে হতো কুলীন ঘরের স্ত্রীদের। বাস্তব ছিল এই ভাবনা—

“সতীন লইলে পতি বড়ই প্রহার।”


সতিনী ঘরে থাকার যন্ত্রণা যে কী তা মর্মান্তিকভাবে বুঝেছে হরিহোড় সোহাগীকে বিবাহ করে। আধ্যাত্মিক অর্থে গঙ্গা ও উমার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই হয়তো, কিন্তু ঈশ্বর পাটুনীর মতো ব্যক্তির মনেও কৌলীন্য প্রথা ও কুলীন ঘরের রীতিনীতি সম্পর্কে বিরাগ আছে। দেবীর পরিচয় শুনে তাই –

“পাটুনী বলিছে আমি বুঝিনু সকল। 

যেখানে কুলীন জাতি সেখানে কোন্দল।”


অন্যদিকে অষ্টবর্ষীয়া কন্যাকে গৌরীদান করার সেকালীন প্রচলিত রীতি অনুযায়ী উমার বিবাহ দিয়েছেন ভারতচন্দ্র ‘সে সময়ের বালিকা গৌরীর আচরণ বাংলাদেশের গৌরীদান প্রথার নিখুঁত প্রতিচ্ছবি। এইভাবে দারিদ্র পীড়িত, কৌলীন্য প্রথাশাসিত এবং গৌরীদান প্রথা সম্বলিত বাংলার সমাজ চিত্র কবি ভারতচন্দ্র তাঁর কাব্যে সুনিপুণভাবে এঁকেছেন।


তবে বলতে দ্বিধা নেই, কবি সত্যই কি সুখী সংসার দেখেননি? হয়তো কাব্য রচনাকালে বর্গি আক্রমণে বাংলা বিধ্বস্ত হয়েছিলো, তাই বলে কি বঙ্গীয় সমাজে কোন সান্ত্বনার বাণী ছিল না। হ্যা নিশ্চয় আছে, সুগৃহিণীপনায় অতি দরিদ্রের ঘরও যে উচ্ছল আনন্দে ভরে উঠতে পারে তার সংশয়হীন পরিচয় কবি উপস্থিত করেছেন এইভাবে—

“অন্ন ব্যঞ্জনের রাশি কে বাসিবে করি বাসি

খেতে হবে খাও খাও খাও।”