প্রেমবৈচিত্র্য ও আক্ষেপানুরাগের সংজ্ঞা নির্দেশ করে এই পর্যায়ের পদ আলোচনার সাহায্যে চণ্ডীদাসের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ নির্দেশ করো।

প্রেমবৈচিত্র্য ও আক্ষেপানুরাগে চণ্ডীদাসের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ


চণ্ডীদাসের পদাবলীর যদি কোনও একটি স্থায়ী সুর থাকে, তবে তা বেদনার সুর, আক্ষেপের সুর। নিজেকে হারিয়ে ফেলার মধ্যেই চণ্ডীদাসের সুখ ও আনন্দ। চণ্ডীদাস নিরাসক্ত শিল্পী নয়, দূর থেকে লীলাস্তরের মতো রাধাকৃষ্ণের লীলাবৈচিত্র্য দর্শন করতে করতে কখন যেন নিজেকেই রাধার অঙ্গীকৃত করে নিয়েছেন। চণ্ডীদাসের ব্যক্তিজীবনে হয়তো কিছু ঘাত প্রতিঘাত জুটেছিল, যার প্রবল ঢেউ তাঁর কবি আত্মার রসসাগরে তুফান তুলেছিল। চণ্ডীদাস যে আক্ষেপানুরাগের শ্রেষ্ঠ কবি তার কারণ তাঁর কবি মনের ভাবনার বিশেষ গড়ন। বিষাদ ও বেদনার কৃষ্ণপক্ষ মেঘখণ্ড দিয়ে তাঁর মনের আকাশটি গড়া। তাই সে আকাশে যে চিত্রকল্প ফুটে উঠবে, তাতে বিষণ্ণতার স্পর্শ থাকবেই। তবে চণ্ডীদাস মনে প্রাণে আত্মবিস্মৃত কবি। অনুভূতির যে স্তরে যিনি পৌঁছেছেন, সেখানে রূপের বৈচিত্র্য নেই, আছে গভীরতম উপলব্ধির মহত্তম বাণী। গভীরতম সত্যের বাণীর চরম মম উপলব্ধিততেই চণ্ডীদাস সার্থক। তাঁর কাব্যে উপরিভাগের রূপরস গন্ধ শব্দ স্পর্শ সমন্বিত বাণী বৈচিত্র্য নেই। অন্তরতম সত্তার নির্বিশেষ রূপটি নিরাবরণ ভাষায় চিত্রিত হয়েছে চণ্ডীদাসের কাব্যে। তা তীব্র গতি পেয়েছে তাঁর আক্ষেপানুরাগের পদের দ্বারা। এটাই চণ্ডীদাসের অকৃত্রিম কবি প্রতিভা।


প্রেম বৈচিত্র্য বৈক্ষ্ণব পদাবলীর এক বিচিত্র পর্যায়। এর স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে গিয়ে ভক্ত ও দার্শনিক রূপ গোস্বামী তাঁর উজ্জ্বলনীলমণি গ্রন্থে লিখেছেন:

“প্রিয়স্য সন্নিকর্যেহপি প্রেমোৎকর্ষ স্বভাবতঃ।

যা বিশ্লেষধিয়া তিস্তৎ প্রেমবৈচিত্র্য মুচ্যতে।।”


অর্থাৎ প্রেমের উৎকর্ষ বশত প্রিয়ের সন্নিধানে তাঁর সঙ্গে বিচ্ছেদ ভয়ে যে বেদনার উপলব্ধি তার নাম প্রেম বৈচিত্র্য। আসলে প্রেমবৈচিত্ত্যের মূল কথা প্রেমের উৎকর্ষ এবং প্রেমের উৎকর্ষের জন্য নিজের ভাগ্যের প্রতি আক্ষেপ। তাই এতে প্রচ্ছন্ন বিরহের সুর আছে। বৈক্ষ্ণব পদাবলীতে এটাই আপেক্ষানুরাগ নামে পরিচিত। রূপ গোস্বামীর মতে প্রেমবৈচিত্র্য হেতু রাধার মনে আটটি বিষয়ে আক্ষেপের সুর জেগে ওঠে। যথা— শ্রীকৃষ্ণের প্রতি, নিজের প্রতি, সখীর প্রতি, দূতির প্রতি, মূরলীর প্রতি, বিধাতার প্রতি, কন্দর্পের প্রতি এবং গুরুজনের প্রতি আক্ষেপ।


এই আক্ষেপের সুরটিকে সমালোচক এমনভাবে ব্যাখ্যা করেছেন “প্রিয়তমের দর্শন না পাইলে ক্ষণমাত্রকে যুগ বলিয়া মনে হয়। আবার মিলন হইলে সন্দেহ হয়, পাইয়াছি তো? অভাগীর অদৃষ্টে এ সুখ স্থায়ী হইবে তো? হয়তো এখনি হারাইব। মিলনের দীর্ঘ সময়কেও পল বলিয়া মনে হয়। মনে হয় এই তো এখনই ফুরাইয়া গেল। সংসারে কেহ আপনার নাই, অপরে পরের ভাল দেখিতে পারে না। বিধাতাও বিরূপ, অন্য সব ছাড়িয়া যাহাকে আপনার বলিয়াছিলাম আজ সেই পর বলিয়া মনে করিতেছে...।” এটাই আক্ষেপানুরাগের মূল তাৎপর্য।


এই মুহূর্তে একটা তাত্ত্বিক প্রশ্ন সহজেই জেগে ওঠে–প্রেম বৈচিত্র্য্য ও আক্ষেপানুরাগ কি বৈব রসশাস্ত্রে অভিন্ন বস্তু? কোনও কোনও রসশাস্ত্রজ্ঞ বলেন প্রেম বৈচিত্র্যের যে আটটি ভাগ নির্দেশ করা হয়েছে তার মধ্যে আক্ষেপানুরাগ অন্যতম। অতএব প্রেমবৈচিত্র্যের পরিধি অনেকটাই ব্যাপক। এদিকে প্রেমবৈচিত্র্য্যের যে সংজ্ঞা নির্দেশিত হয়েছে তাতে মনে হয় এর ব্যাপকতা অনেকটা সীমিত। তবে রসশাস্ত্রজ্ঞদের নির্দেশ সঠিকভাবে মানতে গেলে যথার্থ প্রেমবৈচিত্তের পদকে আক্ষেপানুরাগ কিংবা আক্ষেপানুরাগের পদকে প্রেমবৈচিত্ত্যের পদরূপে গ্রহণ করতে দ্বিধা জাগে। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট কবি ও বৈক্ষ্ণব তত্ত্বজ্ঞ কালিদাস রায় এই দুটি বিষয়ে পদকর্তাদের ধারণাকে অস্বীকার করে বলেছেন “প্রিয়জন কণ্ঠাশ্লিষ্ট থাকিলেও উপভুক্তা মিলনসুখ মুগ্ধা নায়িকাচিত্তের যদি অন্যথাবৃত্তি হয়, তবেই তাহাকে প্রেম বৈচিত্র্য্য বলা যায়।” পক্ষান্তরে অন্যবিষয়ে তিনি বলেছেন “রাধার অনুরাগই তো আক্ষেপনুরাগ। রাধার অনুরাগ অসীম, কিন্তু বঁধুর সহিত মিলনে এত বাধা বিঘ্ন যে রাধার আক্ষেপের সীমা নাই।” অর্থাৎ প্রেমের উৎকর্ষই প্রেম বৈচিত্রের মূল কথা এবং প্রেমের উৎকর্ষের জন্যেই স্বীয় ভাগ্যের প্রতি আক্ষেপের মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন বিরহের সুর বর্তমান। তবে মানতে দ্বিধা নেই, প্রেম-বৈচিত্ৰ্য্য তথা আক্ষেপানুরাগ রূপে পরিচিত সকল বৈষ্ণব পদই যথার্থ অর্থে আক্ষেপানুরাগের পদ।


আক্ষেপানুরাগের পদে চণ্ডীদাসের কবি-প্রতিভা শ্রেষ্ঠত্বের সীমালগ্ন। আক্ষেপানুরাগে রাধা কৃষ্ণের অনাদরে বিশ্রস্ত, বিক্ষিপ্ত, বিরহ হুতাশে কাতর। যে রাগ প্রিয়কে নিত্য নতুন রূপে অনুভব করায় তা হল অনুরাগ। এই অনুরাগের বশেই রাধা আক্ষেপ করেন, কৃষ্ণকে পেয়েও তিনি যেন পাননি। তিলমাত্র অদর্শনে তাঁর কাছে বিশ্ব সংসার অন্ধকার ও শূন্য মনে হয়। রাধার দিক থেকে কৃষ্ণকে ভালোবাসায় তো ফাঁকি নেই। কুল-মর্যাদা, লোক ধর্ম, আত্ম মর্যাদা-সব কিছু বিসর্জন দিয়েছেন রাধা, সেই তবুও তিনি অধরা। তাইতো রাধা

“কি মোহিনী জান বঁধু কি মোহিনী জান।

অবলার প্রাণ নিতে নাহি তোমা হেন।।"

ঘরকে বাহির রাতকে দিন করেও সেই পরম রহস্যের সন্ধান তিনি পান নাঃ “বুঝিতে নারিনু বন্ধু তোমার পিরীতি।”


রাধা এই নিদারুণ যন্ত্রণায় নিজের অসহায়তার কথা এবং সেই সঙ্গে কৃষ্ণপ্রেম হারালে তার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থাও কৃষ্ণকে জানান—

“বন্ধু যদি তুমি মোরে নিদারুণ হও। 

মরিব তোমার আগে- দাঁড়াইয়া রত্ত।।”

বস্তুত রাধার এই মৃত্যু কৃষ্ণের বঞ্ছনার জন্যেই।


রাধাতো কৃষ্ণ বিনা আর কিছু জানে না। শয়নে স্বপনে কৃষ্ণরূপই তিনি মানস চক্ষে দর্শন করেন, ভ্রমবশে মাটিতে কৃষ্ণ নামই লেখেন। গুরুজন সমক্ষে কৃষ্ণনাম শ্রবণে “পুলকে পুরয়ে অঙ্গ আঁখি ঝরে জল।” যার জন্য সমাজ, সংসার ভাসিয়ে দিয়ে কুল ছেড়েছেন সেই কৃষ্ণ কালিয়ার অনাদর কি ভাবে রাধা সহ্য করবেন। অতি মরমীয় ভাষায় রাধা মনোবেদনা ব্যক্ত করেন

“শয়নে স্বপনে বঁধূ সদাকার ভয়। 

কাহার অধীন যেন তোমা প্রেমময়।”

তাইতো তুষের আগুনের মতো ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকে তাঁর মন

“নিশি দিশি অনুক্ষণ প্রাণ করে উচাটন

বিরহ অনলে জ্বলে তনু।”


তবে তাঁর এই দুর্ভাগ্যের মূলে আছে কালার মোহন বাঁশীর সুর। এই বাঁশির সুর তাঁর কর্ণে প্রবেশ করে ঘটিয়েছে যত অঘটন

বিষম বাঁশির কথা কহনে না যায়। 

ডাক দিয়া কুলবতী বাহির করায়।।”


তা সত্ত্বেও শ্যামবন্ধুর পিরীতি রাধার পক্ষে উপেক্ষা করা অসম্ভব। কৃষ্ণকে ভালো না বেসে উপায় নেই। কারণ তাঁর অবস্থা এখন ‘ন যযৌ ন তস্থৌ'। সে যে জেনেশুনে বিষ পান করেছে। অতএব আর ফিরবার পথ নেই। 'আকাশ জুড়িয়া ফাঁদ যাইতে পথ নাই'। এযে শ্যাম ফাঁদ।


পিরীত রসের সাগর, সকল সুখের আকর। অথচ রাধার দুঃখ, সেই পিরীতিই তাঁর জীবনে নিদারুণ দুঃখ বহন করে এনেছে। কিন্তু রাধা জানেন এর জন্য দায়ী তিনি স্বয়ং, কারণ তিনি জানতেন না পিরীতির এমন জ্বালা। তবে সুখের আশায়ই তো সে প্রেম সরোবরে ঝাঁপ দিয়েছিলেন, যাকে ভেবেছিলেন সুশীতল শান্তির সাগর, সেখানে স্নানে পেলেন গরলের প্রচণ্ড জ্বালা। শ্রীমতী চরম বেদনায় তাই আপেক্ষ করেছেন “আমার পরাণ যেমতি করিছে তেমতি হউক সে।”


বিশ্ব সংসারে রাধা তাঁর নির্দয় প্রিয়তমের জন্যে এই একটিমাত্র অভিশাপ খুঁজে পেলেন। এর মধ্যে রাধার অন্তরের একদিকে সুগভীর বেদনা ও নৈরাশ্যের নিদারুণ শূন্যতা বোধ, অন্যদিকে দয়িতের প্রতি সুগভীর ও ঐকান্তিক প্রেমের দিগন্ত বিস্তারী বিকাশের চিত্রটি প্রকাশ পায়। তাইতো সব চিন্তা দূর করে শ্রীমতী বলে— 'ভাবিয়া দেখিনু শ্যাম বঁধু বিনে আর কেহ মোর নয়।" অতএব সেই নয়ন পুত্তলিকে তিনি আঁচলে বেঁধে রাখবেন, নয়ন ভরে দেখে মানস বাসনা সফল করবেন। তার চেয়েও বেশি মনের মনি কোঠায় রত্ন সিংহাসনে চির দিনের জন্য বসিয়ে রাখবেন—

“বন্ধু আর কি      ছাড়িয়া দিব।

হিয়ার মাঝারে     সেখানে পরাণ

সেইখানে লঞা থোব।।"


চণ্ডীদাস এই ভাবে অতি সাধারণ জীবনের সরল ভাষা ও সহজ উপমার সাহায্যে কৃষ্ণপ্রেমে আকণ্ঠ নিমজ্জিতা মহাভাব স্বরূপিনী রাধার অপরূপ সৌন্দর্য সত্তাকে প্রকাশ‌ করেছেন। ফলে লৌকিক জীবন চেতনা এবং আধ্যাত্মিক ভাব ব্যঞ্জনা প্রকটিত হয়েছে। কিন্তু রাধাকৃষ্মের এই রূপক ছেড়ে দিলেও এর একটা সার্বজনীন আবেদন ধরা পড়ে। বোধ হয় বেদনা ও ব্যাকুলতা এই পদের মূল সুর বলে নিখিল মানুষের অন্তরাত্মা এতে সহজেই সাড়া দিতে পারে। এর যদি কোন কাব্য মূল থাকে, তবে তা নিহিত আছে নিরাভরণ বৈরাগ্যের গৈরিক শ্রীর মধ্যে। শব্দ ঝংকারে তিনি নিঃস্ব, তাঁর ভাণ্ডারে দু চারটি মাটির অলঙ্কার ও মাটির ফুল ভিন্ন কোন হীরামণিমাণিক্য নেই৷


তাঁর কাব্যে শিল্প নৈপুণ্য নেই। কিন্তু তাঁর যা আছে তা তুলনা রহিত। দুটি অশ্রু ভারাক্রান্ত ব্যথিত দৃষ্টি আমাদের অন্তরকে নিবিড় আবেগে স্পর্শ করে, রসের সভায় ও রঙের হাটে দেউলিয়া অন্তরকে মেলে ধরতে আমরা কুণ্ঠিত হই না। চণ্ডীদাস রাধার কণ্ঠে আধখানা কথা দিয়ে পাঠকের অন্তরে তাঁর সহস্র পদধ্বনি জাগিয়ে তুলেছে। এখানেই তাঁর কৃতিত্ব নিহিত।